ভয়হর মঙ্গল দশরথ রাম ।
জয় জয় মঙ্গল সীতা রাম ।।
মঙ্গলকর জয় মঙ্গল রাম ।
সঙ্গতশুভবিভবোদয় রাম ।।
আনন্দামৃতবর্ষক রাম ।
আশ্রিতবৎসল জয় জয় রাম ।।
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম ।
পতিতপাবন সীতা রাম ।।
চিত্রকূট পর্বতে রাম, লক্ষণ, সীতা দেবী আনন্দে দিন যাপন করছিলেন । চারপাশে বনের প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভগবান রামচন্দ্র ও সীতাদেবী। কিছুকাল পড়ে দেখলেন সেখান থেকে মুনি, ঋষি আর বনবাসী সকল পলায়ন করছে। সকলের মুখমণ্ডল আতঙ্কগ্রস্ত । কোন একটা ভয় তাদের তাড়া করছে। আশ্রম গুলি অধিকাংশই পরিত্যক্ত । বাকী আশ্রম গুলি ছেড়ে তপস্যা ছেড়ে মুনি, সন্ত গণ পলায়ন করছিলেন । আশ্রম গুলি জরাজীর্ণ হল। যজ্ঞবেদী নানা বুনো ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেলো। তুলসী মঞ্চে আর তুলসী দেবী শোভা পেলেন না। বুনো লতাপাতায় আচ্ছাদিত হল তুলসী মঞ্চ । একদিন ভগবান রাম, লক্ষণ সেই পলায়ন রত মুনি ঋষি বনবাসীদের জিজ্ঞাসা করলেন- “আপনারা এই সুন্দর রম্য অরণ্য কেন পরিত্যাগ করছেন ? কেনই বা আপনারা ভয়গ্রস্ত হয়েছেন? কি উদ্দেশ্যে আপনারা এই জঙ্গল ছেড়ে প্রস্থান করছেন?” ভগবান রাম অত্যন্ত বিনয় সহকারে মুনি ঋষি দিগকে প্রনাম জানিয়ে বললেন- “হে মহাত্মাজন ! আপনারা বেদান্তিক শাস্ত্রজ্ঞ। আপনাদের ধর্ম সমগ্র জাতিকে আধ্যাত্মিক দিব্য জ্ঞান প্রদান করা। বিধাতা এই কারনেই আপনা দিগকে শাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রদান করেছেন। তথাপি আপনারা সকলে আশ্রম ছেড়ে কেনই বা পলায়ন করছেন? কে আপনাদের ভয় প্রদর্শন করলো ?” মুনি গণ বললেন- “আমরা শঙ্কিত । রাক্ষস দিগের মাত্রছাড়া তাণ্ডবে আমাদের ধর্মাচরণ লুপ্ত হতে বসেছে। দুরাচারী রাক্ষসেরা ধর্ম, পুণ্য স্বীকার করে না। যথেচ্ছ ভাবে তাণ্ডব করে বেড়ায়। আমাদের, কে রক্ষা করবে? তাই আমরা এই স্থান হতে প্রস্থান করতে বাধ্য হচ্ছি। এই রাক্ষসেরা আমাদের বিতারন করছে। রাবণের ভ্রাতা খড়, দূষণ এর রাজত্ব চলে এই স্থানে। উহাদের আদেশে রাক্ষসেরা সকল অন্যায় করে বেড়ায়।”
লক্ষণ বলল- “হে মুনিগণ ! আমার অগ্রজ দাশরথি শ্রীরামচন্দ্র পূর্বে রাক্ষস দলন করে তাড়কা, সুবাহু বধ করেছেন। মারীচকে বিতারিত করেছেন । আমরা তিন কোটি রাক্ষস নিধন করে ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের তপোবন রাক্ষসশূণ্য করেছি। আপনারা এভাবে পলায়ন করবেন না। কোথায় সেই খড় আর দূষণ ? আমরা তাহাদিগকে সংহার করে আপনাদের বিপদমুক্ত করবো।” মুনিগণ বললেন- “হে রামচন্দ্র! গোদাবোরী তীরে পঞ্চবটিতে বিরাধ নামক এক রাক্ষস বাস করে। অতীব শক্তিশালী সেই রাক্ষস পঞ্চবটিতে সকল ধর্মাচরণ স্তব্ধ করেছে। নরমাংসভোজী সেই রাক্ষস পূর্বে বহু মুনি, ঋষি ও বনবাসীদের হত্যা করে ভোজন করেছে। আপনি তাহাকে বধ করুন।” মুনি ঋষি বনবাসীরা চলে গেলে রামচন্দ্র লক্ষণ আর সীতাকে বললেন- “আমাদের এখান থেকে প্রস্থান করতে হবে। প্রথম উদ্দেশ্য সেই বিরাধ রাক্ষসের সংহার প্রয়োজন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ভরত এই স্থান জ্ঞাত হয়েছে। হয়তো তার মন পরিবর্তন হলে সে কোনদিন এসে আমাদের অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছা ব্যক্ত করবে। সুতরাং গোদাবোরী পঞ্চবটিতে আমাদিগের যাত্রা করা প্রয়োজন ।” ভগবান রাম অগ্রে, মধ্যে জানকী দেবী অন্তে লক্ষণ চললেন । তত্ত্ব কথাতে শ্রীরাম স্বয়ং পরমব্রহ্ম, সীতাদেবী আদ্যাশক্তির অংশা মহামায়া- মায়া, লক্ষণ জীবাত্মা। মায়া এখানে ব্রহ্মকে আড়াল করে রেখেছেন। তাই মহামায়ার অংশা সীতাদেবী ব্রহ্ম ও জীবাত্মার মধ্যে অধিষ্ঠিত । যাই হোক- ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতাদেবী বনের গভীরে প্রবেশ করলেন। বিবিধ পুস্প বিকশিত হয়েছে। চতুর্দিকে পাখীর কলরব আর মিষ্ট মধুর গন্ধ। ঝর্ণাধারা থেকে অবিরত শীতল জল সশব্দে নদীতে ঝড়ে পড়ছে। শ্রীরামচন্দ্র তথায় বিশ্রাম নিলেন । লক্ষণ ফলমূল সংগ্রহ করতে গেলেন। সীতাদেবী ঝর্ণার জলে নিজ কেশ রাশি সিক্ত করে তা দিয়ে ভগবান রামের চরণ ধৌত করে দিলেন । বিবিধ পুস্প সংগ্রহ করে রামচন্দ্রের চরণে অঞ্জলি দিলেন ।
অতঃ লক্ষণ ফলমূল নিয়ে আসলে তিন জনে সেবা নিলেন। নদীর শীতল জল পান করে পদ্মের মৃনালের সুধা পান করলেন। হরিতকী আমলকী ফল মুখশুদ্ধি রূপে গ্রহণ করে পুনঃ আগে অগ্রসর হলেন । অত্রি মুনির আশ্রম নিকটে। অত্রি মুনির পত্নী অনুসূয়া দেবী ছিলেন মহাসতী । তিনি নিজে সতীত্ব বলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর কে শিশু বানিয়ে পুত্রভাবে লালন পালন করেছিলেন । পড়ে ত্রিদেব একত্রে অনুসুয়া দেবীর পুত্র রূপে ভগবান দত্তাত্রেয় রূপে ( ত্রিনাথ ) আবির্ভূত হয়েছিলেন । মুনির আশ্রমে গিয়ে রাম লক্ষণ ও সীতাদেবী উপস্থিত হলে মুনি পত্নীসহিত তিনজনকে স্বাগত জানালেন। রাম, লক্ষণ অত্রি মুনির সাথে ধর্ম কথা আলোচনা করছিলেন, অপরদিকে মাতা সীতাদেবী, মুনি পত্নী অনুসূয়া দেবীর সাথে আলোচনা করছিলেন । সীতাদেবীর অলৌকিক জন্মের কথা শুনে অনুসূয়া দেবী অবাক আর আশ্চর্য হলেন । সীতা দেবী প্রশ্ন করলেন- “হে দেবী! আদর্শ নারীর কর্তব্য কি?” অনুসূয়া দেবী বললেন- “হে জানকী! শ্রবন করো। পতির সেবা পত্নীর পরম ধর্ম । পতির চরণেই স্ত্রীর তীর্থ। যে নারী কদাপি পতির সেবা না করে সেই নারী নরকে গমন করে। পতি উপার্জনহীন , রোগগ্রস্ত, রুগ্ন হলেও পত্নীর কর্তব্য স্বামীকে পরমেশ্বর জ্ঞানে সেবা করা। যে নারী স্বামীকে ভুলে পরপুরুষের চিন্তা করে সেই মহাপাতকী নারী শত বৎসর রৌরব কুণ্ডে জ্বালা যন্ত্রনা ভোগ করে। অতএব সদা সর্বদা পতি ভিন্ন অপর পুরুষের চিন্তা বিসর্জন দেওয়াই আদর্শ সহধর্মিণীর কর্তব্য। সর্বদা পতির মঙ্গল কামনা করবে, পতি কে ভোজোন করিয়ে অন্তে নিজে ভোজন করবে। পতির সকল দায়িত্ব সমান ভাগে পতি পত্নীর উভয়ে পালন করা কর্তব্য। এই রূপে যে নারী পতির সেবা করেন- তিনি জগতে মহাসতী নামে খ্যাতা হন। তাঁর সতীত্ব তেজে ত্রিলোক থর থর কম্প হয়। তাকে দেবতারা নমস্কার করেন।” এই রূপে অনুসূয়া দেবী সীতাকে আধ্যাত্মিক বার্তা জ্ঞান প্রদান করলেন। অন্তিমে সীতাদেবীকে নানা সোনার অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিতা করলেন। সীতাদেবীর বারণ শুনলেন না। অনুসুয়া দেবী বললেন- “এয়োস্ত্রী নারী সর্বদা সাধ্যানুসারে অলঙ্কারাদি ধারন করে থাকবেন। নচেৎ সংসারের অমঙ্গল হয়।”
রামচন্দ্র, লক্ষণ ও দেবী বৈদেহী সেই রাক্ষসের জঙ্গল প্রবেশ করলেন । হাড় হিম সেই জঙ্গলে কোনো প্রকার প্রাকৃতিক শোভা ছিলো না। গভীর অরণ্যে দিনের বেলাতেই ঘোর অন্ধকার রাত্রি মনে হচ্ছিল্ল। সেই স্থান এত নিস্তব্ধ ছিলো, যে চরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল্ল। সেখানে বৃক্ষ গুলিতে কোন প্রকার পুস্প বা ফল ছিলো না। কোন পাখীর কলরব শোনা যাছিল্ল না। একটা বিভীষিকাময় পরিবেশ গ্রাস করেছিল এই জঙ্গলকে । এখানে বৃক্ষ গুলিকে দেখলে মনে হয় বৃক্ষ গুলিও অজানা ভয়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । তারা যেনো এই বৃক্ষ জন্ম থেকে মুক্তি পেতে চায় । বনের মধ্যে দিয়ে নদীনালা গুলো বয়ে চলছিল- সেই ধারাতে কোনো আনন্দের বয়ে চলার ছন্দ ছিলো না। মনে হল অজ্ঞাতে সকল জল এই স্থান দিয়ে নিঃশব্দে বয়ে চলে যেতে চায় । চারপাশে কেবল গৃধ, বাঁদুর ইত্যাদি প্রানী উড়ে বেড়াছিল্ল । আর দেখা গেলো চারদিকে নর মানব ও পশু পক্ষীর অস্থি । কতকাল থেকে পড়ে আছে, অস্থি গুলিতে মৃত্তিকার আস্তরণ পড়ে ছত্রাক গজিয়েছে । অস্থির স্তূপ দেখে সীতাদেবী ভীত হয়েছিলেন, কিন্তু পর মুহূর্তে ভাবলেন রাক্ষস বিনাশক শ্রীরামচন্দ্র যখন সঙ্গে আছেন তখন ভয় পেলে শ্রীরামচন্দ্রকেই অপমান করা হয় । কিছু সদ্য অস্থি মাংসে মক্ষী কূল ভনভন করে উড়ছে । রামচন্দ্র বললেন- “হে জানকী! দেখো অরণ্যের কি ভয়ানক পরিবেশ। পূর্বে তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম অযোধ্যা ফিরে যেতে। এই সকল বনে অনেক রাক্ষস ও হিংস্র জন্তু ভ্রমণ করে।” সীতাদেবী বললেন- “হে নাথ! আপনি স্বয়ং তাড়কা, সুবাহু বধ করেছেন। আপনি যেস্থানে সেখানে আমি নয়ন মুদ্রিত করেও নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারিব।” হঠাত জঙ্গল থেকে ভয়ানক গর্জন শোনা গেলো। সেই গর্জনে মনে হল একটা ঝড় বয়ে গেলো। বৃক্ষ গুলি আন্দোলিত হল।
মানুষের গন্ধ পেয়ে সেই বিরাধ রাক্ষস এগিয়ে আসতে লাগলো। সে যখন চরণ ফেলে আসছিলো- গোটা অরণ্য কম্পিত হচ্ছিল্ল । বিশাল বৃক্ষ গুলিকে এমন ভাবে দুলিয়ে আসছিলো যেনো এক শিশু অনায়েসে ঘাসবন দুলিয়ে আসে। স্তম্ভাকৃতি অতি উচ্চ বট, অশ্বত্থ বৃক্ষ গুলিকে দুলিয়ে সেই রাক্ষস অগ্রসর হয়ে রামচন্দ্রের, লক্ষণের ও মাতা সীতার সম্মুখে আসলেন । সেই রাক্ষসের নয়ন অগ্নির ন্যায় প্রজ্বলিত ছিলো, অতি উচ্চ শরীর মনে হয় মস্তক যেনো গগনে ঠেকেছে। বিকট চেহারার মুখে তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় দন্ত যুগল প্রকাশিত হয়েছিল। হস্তের নখ গুলি এক একটি বৃহৎ তরবারির ন্যায় সর্পিল আকারে ছিলো । পায়ের তলায় বৃক্ষ গুলি পিষ্ট হয়ে চূর্ণ চূর্ণ হয়েছিলো। অতি বিশালাকৃতি সেই দানবকে দেখে সীতা দেবী ভয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল । রাক্ষসের মুখ থেকে মাংস লোভে লালা ঝড়ছিলো, মনে হচ্ছিল্ল বিশাল জলকুণ্ড পতিত হচ্ছে । সেই রাক্ষস রাম আর লক্ষণ কে দুহাতে তুলে ভক্ষণ করতে উদ্যত হলে সীতাদেবী বললেন – “ওরে রাক্ষস! তুমি আমার স্বামী ও দেবরকে ছেড়ে আমাকে ভক্ষণ কর। এঁনাদের ভক্ষণ করলে আমাকে বনে সুরক্ষা দেবে কে?” বিরাধ তখন রাম লক্ষণ কে মাটিটে নামিয়ে সীতা দেবীকে ধরতে গেলে রাম, লক্ষণ যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। বাণে বাণে ছেয়ে গেলো চারপাশ । রাক্ষসের দিকে তীক্ষ্ণ বানাদি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। রাক্ষসের শরীরে বাণ লাগতেই সব বাণ তৃনের ন্যায় চূর্ণ চূর্ণ হল। রাক্ষস পালটা বিশাল বট, অশ্বত্থ , কদম বৃক্ষ তুলে রামচন্দ্রের পাণে নিক্ষেপ করতে লাগলেন । শ্রীরামচন্দ্র বাণ দ্বারা সেই সকল বৃক্ষ চূর্ণ করলেন । চতুর্দিকে বৃক্ষ গুলি চূর্ণ হয়ে পতিত হয়ে স্তূপাকৃতি নিলো। রাক্ষসের নিঃশ্বাসে সেই স্তূপ গুলি চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হচ্ছিল্ল, যেনো প্রলয় ঝড়ে বালুকা দ্বারা চতুর্দিকে আচ্ছাদিত হয়েছিলো ।
তখন ভগবান রামচন্দ্র অর্ধচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণে রাক্ষসের এক হস্ত কাটা পড়লো। রাক্ষসের কাটা হস্ত এভাবে পড়লো যেনো শত বট বৃক্ষ একত্র হয়ে ধরাতলে পতিত হল। চতুর্দিকে কেঁপে উঠলো। সেই কাটা হস্তের তলায় বৃক্ষ গুলি চূর্ণ হল। রক্তধারা উদ্যম লহরীর ন্যায় প্রবাহিত হল । এরপর রামচন্দ্র অনেক দিব্যবাণ প্রয়োগ করলেন। কিন্তু রাক্ষসের অন্ত আর হয় না । এরপর ভগবান রামচন্দ্র ধনুকে ঐষিক বাণ আনয়ন করলেন। বাণ দিয়ে অগ্নির জুয়ালামুখী সৃষ্টি হল। সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন। ঐষিক বাণের আঘাতে বিরাধের মুণ্ড কেটে পতিত হল। যেনো বিশাল উল্কাপিণ্ড ধরাতলে পতিত হল। এরপর বিশাল দেহটা পতিত হল। চতুর্দিক কেঁপে উঠলো। মনে হল কোন গ্রহ এসে বসুমতীর বুকে আছড়ে পড়েছে। রক্তধারার নদী সৃষ্টি হয়ে সবুজ বনভূমিকে রক্তাভ করে দিলো। সেই রাক্ষসের দেহ থেকে এক গন্ধর্ব প্রকট হল। গন্ধর্ব প্রনাম করে বলল- “হে ভগবান! আপনি আমায় মুক্তিদান করলেন। আপনার জয় হোক । পূর্বে আমি তুম্বুরু নামক এক গন্ধর্ব ছিলাম। অপ্সরা রম্ভার রূপে আমি মত্ত ছিলাম। সেই কারণে একদিন আমি কর্মে অবহেলা করলে কুবেরের শাপে এই রাক্ষস দেহ প্রাপ্তি করেছিলাম । ধনপতি কুবের আমাকে বলেছেন, অযোধ্যার সম্রাট দশরথের গৃহে যখন ভগবান নারায়ণ, রাম রূপে অবতীর্ণ হবেন, তাঁরই হস্তে নিধন হয়ে আমার শাপমোচন হবে। হে প্রভু! আপনি আজ আমাকে কৃপা করে মুক্তি দিলেন। আপনার চরণে কোটি কোটি নমস্কার জানাই।” ভগবান রাম বললেন- “হে গন্ধর্ব! তুমি এখন মুক্তিলাভ করেছো। যাও স্বর্গে ফিরে তোমার প্রভুর সেবা করো। আর কদাপি কর্মে অবহেলা করো না।” সেই গন্ধর্ব এরপর স্বর্গে ফিরে গেলেন । বিরাধ রাক্ষসের দেহ লক্ষণ মাটিটে সমাধি দিয়েছিলেন । চারপাশ থেকে মুনি ঋষিরা ভগবান রামের জয় জয়কার করে দর্শন করতে আসলেন। এই অঞ্চলে আর রাক্ষসের উপদ্রব থাকলো না। যারা চলে গিয়েছিলো তারা ফিরে এলো।
বিরাধ রাক্ষস বধ হতেই সেই ভয়ানক বন আবার সুন্দর হয়ে উঠলো। মুনি, ঋষিদের আশ্রম গুলিতে নিত্য যাগ, যজ্ঞ, তপ আদি ধার্মিক ক্রিয়াকাণ্ড হতে লাগলো। বনবাসীরা আনন্দে বনে বাস করতে লাগলেন। ভগবান রামের বন্দনায় চতুর্দিক ভরে গেলো । রাবণের ভ্রাতা খড় ও দূষণ এই সংবাদ পেয়েছিলো। তারা অবাক হল বিরাধের মতো শক্তিশালী রাক্ষসকে কে বধ করলো।তারা গুপ্তচর প্রেরণ করলো। রাক্ষসেরা মায়া দ্বারা মানব রূপ নিয়ে রামচন্দ্রের অন্বেষণ করতে লাগলো । একদিনের কথা এই তপোবনেই শরভঙ্গ মুনি বাস করেন । মহামুনি একদিন যখন ধার্মিক ক্রিয়ায় মগ্ন তখন দেবরাজ ইন্দ্রদেবতা প্রকট হলেন । মহর্ষি শরভঙ্গ ইন্দ্রদেবতার বন্দনা স্তবস্তুতি করলেন। মহেন্দ্র জানালেন- “হে মুনিবর ! স্বয়ং বিষ্ণুবতার ভগবান রাম সস্ত্রীক ও ভ্রাতা লক্ষণ সহিত আপনার আশ্রমে আসছেন । আপনি বিদিত হয়েছেন ভগবান বিষ্ণু রাক্ষসরাজ দশাননকে বিনাশ করবার জন্যই এই অবতার গ্রহণ করেছেন । প্রজাপতি ব্রহ্মার নির্দেশে আমি আপনাকে ভগবান বিষ্ণুর শার্ঙ্গ ধনুক ও দিব্যাস্ত্র প্রদান করতে এসেছি। আপনি এই সকল ভগবান রামচন্দ্রের হস্তে সমর্পণ করবেন।” এই বলে ইন্দ্রদেবতা শার্ঙ্গ ধনুক ও দিব্যাস্ত্র সকল মুনির হস্তে দিয়ে বিদায় হলেন । বনের প্রাকৃতিক শোভা দর্শন করতে করতে ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতা আসছিলেন । আকাশের মেঘগুলি প্রখড় রোদ্রকিরণ থেকে বাঁচতে তাহাদিগের ওপরে ছত্রের ন্যায় তাঁহাদের সঙ্গেই গমন করছিলো । ভগবানের যাতে কোনরূপ কষ্ট না হয় সেই কারনে প্রকৃতিদেবী বৃক্ষের কোমল পুস্প পথের ওপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন। ফুলের মিষ্ট গন্ধ প্রবাহিত করে পবন দেবতা সেই সুবাস রাম, সীতাদেবী ও লক্ষণের নাসিকায় পৌছে দিচ্ছিল্লেন।
বনের মধ্যে সুরবৃন্দ এইভাবে স্বর্গীয় সুষমা বিস্তার করেছিলেন । এই মধুর পরিবেশ দেখে তিন জনেই প্রীত হলেন। সীতাদেবী ফুলের মাল্য রচনা করে ভগবান রামচন্দ্রের কণ্ঠে পড়িয়ে দিচ্ছিল্লেন। ভগবান রামের সেই পবিত্র তনুর স্পর্শে পুস্পগুলির সৌরভ ও সৌন্দর্য সর্বাত্মক প্রকাশিত হল । পক্ষী কুল নানান রবে সুন্দর মিষ্টি সুর উৎপন্ন করে চারপাশ ভরিয়ে দিয়েছিলেন । কণ্টক বৃক্ষ গুলি তাহাদের সকল কণ্টক সৃষ্টির নিয়ম উলঙ্ঘন করে লুক্কায়িত করেছিলো- যাতে প্রভুর শ্রীঅঙ্গে আঘাত করবার পাপ না গ্রহণ করতে হয়। শরভঙ্গ মুনি পথ চেয়েছিলেন কখন তাঁর আরাধ্যদেবতা এই পথে আসবেন । আশ্রমে আসবার পথ তিনি নিজেই সযত্নে পুস্প মাল্য দ্বারা সজ্জিত করেছিলেন। সেই পুস্পশোভিত কোমোল পথে যখন ভগবানের কমলসম চরণ পতিত হল- যেনো প্রকৃতি আনন্দের লহরী প্রবাহিত করলো। পুস্পগুলি ঝড়ে পড়তে লাগলো ভগবানের যাত্রাপথে। পদ্ম ফুটলে যেমন অলিকুল ধাবমান হয়, ঠিক তেমনি পুস্পগুলি বাতাসে ভগবান রামের দিকে ধাবমান হল। শরভঙ্গ মুনিকে ভগবান রাম, মাতা সীতা ও লক্ষণ প্রণাম জানালেন। মুনির চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রুধারা নির্গত হচ্ছে। আহা! কি রূপ ভগবানের। এঁনারই জন্যই তো এত তপস্যা, এত জপ, এত আরাধনা, এত কৃচ্ছ সাধন, এত যাগ যজ্ঞ। সেই সকল মঙ্গল মঙ্গলের অধিনায়ক ভগবান এসেছেন। মুনির বাক রুদ্ধ হয়ে অবিরত ধারায় অশ্রুজলে সর্বাঙ্গ সিক্ত হল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল- “হে জনার্দন! হে মাধব! আপনি এসেছেন। হে দয়াময় তোমাকে কিভাবে স্তব করবো? তুমি ভক্তের প্রতি এতই প্রীত যে ভক্তের সম্মানের জন্য তুমি প্রণাম জানালে। হে ভগবান! ত্রিলোকে সকলে আপনাকে স্তবস্তুতি করে অবিরত নমস্কার প্রনাম করে। হে রঘুনাথ ! চার বেদ তোমার মহিমা বর্ণনা করেও সমাপন করতে পারে না। পঞ্চমুখে শিব ও চতুর্মুখে পদ্মযোনি ব্রহ্মা, গজারূঢ় দেবেন্দ্র তোমারই মহিমা কীর্তন করেন। আমি কি পুণ্য করেছি জানি না, তবে তোমার অশেষ দয়াতে তোমার দিব্য স্বরূপ দর্শন লাভ করেছি।”
এইভাবে মুনি ভগবান রামের স্তবস্তুতি করে ভগবতী সীতা দেবী ও লক্ষণ ঠাকুরের স্তবস্তুতি করলেন । ভগবান রামের চরণ অভিষেক করলেন । মুনির সেই ভক্তির সেবা, চন্দনের তিলক, বন পুস্প প্রদানে ভগবান রাম অতীব প্রসন্ন হলেন । মুনির বারংবার বাক রুদ্ধ হল। অবিরত অশ্রুধারা নির্গত হল। “রাম” নাম উচ্চারন করে কীর্তন নৃত্য করতে লাগলেন । নিজেকে ধন্য মনে করলেন , কারণ ভগবানের দর্শন অতীব দুর্লভ। সেই ভগবান আজ আশ্রমে। আহা! কত জন্মের তপস্যার ফল। এরপর শরভঙ্গ মুনি ভগবান রামকে দেবেন্দ্র দ্বারা প্রদত্ত শার্ঙ্গ ধনুক ও দিব্যাস্ত্র দিয়ে বললেন- “হে মহাপ্রভু! দেবেন্দ্র আপনাকে এই সকল প্রদান করতে আজ্ঞা দিয়েছেন। আপনি এই সকল গ্রহণ করুন। রাক্ষস বিনাশ সময়ে এইগুলি প্রয়োগ করবেন।” ভগবান রাম প্রসন্ন হয়ে সেই অস্ত্র সকল গ্রহণ করে বললেন- “হে মহামুনি! আপনি আমার ভক্ত। বর প্রার্থনা করুন।” ভগবান রামের মনে এই সময় ভগবৎ সত্তার পূর্ণ বিকাশ হয়েছিলো। মুনি বললেন- “হে ভগবান! আপনার দর্শন লাভ করে যে অপর কিছু প্রার্থনা করে সে নির্বোধ ও মূর্খ। আপনার দর্শনই সর্বাপেক্ষা উত্তম বর। যদি আমাকে দিতে হয় এই আশীর্বাদ করুন যেনো আমার হৃদয়ে আপনি , দেবী সীতা ও লক্ষণ সহিত বিরাজিত থাকেন।” ভগবান রাম তাই বর দিলেন। এরপর মহর্ষি শরভঙ্গ যোগাগ্নি তে আত্মাহুতি দিয়ে ভগবানের শাশ্বত ধাম প্রাপ্তি করলেন। এখানে অনেকে বলবেন যে মুনি এত জ্ঞানী হয়ে আত্মহত্যা কেন করলেন ? প্রথমতঃ যোগবলে যোগীরা যখন প্রাণত্যাগ করেন তখন সেটা আত্মহত্যা বলে না। আত্মহত্যা আর যোগের মাধ্যমে দেহ ত্যাগ এক ব্যাপার না । আত্মহত্যা যে করে সে প্রেতযোনি প্রাপ্ত করে শতবর্ষ ব্যাপী যাতনা ভোগ করে। সেই জন্য আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলা হয়। যে ভগবানের প্রদত্ত জীবন নিজেই নষ্ট করে সে মহাপাপী। আর যোগ একধরনের সাধনা। যোগের দ্বারা কুণ্ডলিনী জাগরিত হয়, তখন যোগীরা এই শক্তির অধিকার হন। যোগীরা কদাপি রেলের তলায়, গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা গায়ে কেরোসিন ঢেলে বা বিষ খেয়ে দেহ রাখেন না। তারা এই যোগশক্তির অবলম্বনে দেহ রাখেন । প্রয়োগ, হরিদ্বার, কাশীতে এখনও এমন যোগীর কথা শোনা যায় যারা এমন যোগের দ্বারা কাল পূর্ণ হলে দেহ রাখেন । আর ভগবান প্রাপ্তির মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য। সুতরাং ইষ্টদেবতার দর্শন পেয়েই মহর্ষি শরভঙ্গ যোগ বলে দেহ রেখেছিলেন।
ভগবান রাম এরপর গোদাবরী তীরে রম্য অরণ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে তিনি অনেক প্রকার সাধু, সন্ন্যাসীর দর্শন পেলেন । জায়গাটিতে অনেক মৃগ, ময়ূর, বিচিত্র রঙ্গবাহারী পক্ষী অবস্থান করে মধুময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো। এমন জায়গাতে রাম, সীতা দেবী, লক্ষণ কোথাও চার পাঁচ মাস, কোথাও আবার দশ মাস কাটালেন । সাধু, সন্ন্যাসীদের কাছে দিব্য আধ্যাত্মিক কথা শুনলেন। ভগবান সবই জানেন, কারণ তাঁকে কেন্দ্র করেই শাস্ত্র, তিনি কেবল মানব দেহে অবতার নেওয়ার সকল কর্তব্য পালন করছিলেন। মুনি, ঋষি গন আধ্যাত্মিক শাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রদান করবার সময় ভেবেছিলেন তাঁরা সকল শাস্ত্রে বর্ণিত সেই বিরাটপুরুষ কেই জ্ঞান দিচ্ছেন, পাছে অপরাধ না হয় এই ভয়ে ভীত ছিলেন । এখানে মুনি ঋষি গণ কেউ বছর ব্যাপী উপবাসী, কেউ কেবল কুম্ভক প্রাণায়ামে বায়ু সেবন, কেউ কেবল ফলমূল সেবন, কেউ কেবল পত্র সেবন করে তপস্যা করছিলেন। কাহারো মস্তকে জটা সমগ্র সর্পিল সর্পের ন্যায় মস্তক থেকে ঝুলছে, কাহারো আবার হস্ত পদের নখ বিশালাকৃতি হয়েছে, কেউ আবার এক পায়ে ভর দিয়ে ঊর্ধ্বমুখে ভগবানকে ডাকছেন, কেউ কেবল বাকল ধারণ করে বৃক্ষের কোটরে অবস্থান করছেন। চতুর্দিকে পাখপাখালীর মধুর কলরবে কেবল বৈদিক মন্ত্রের ছন্দ মানানসই ভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল। কেবল সুখ আর শান্তি। সংসারের কুটিলতা, নগরের কোলাহল , হৈচৈ থেকে অনেক দূরে এই রম্য বণ আপন একটা ছন্দ বানিয়ে নিয়েছিলো। এই ছন্দকে বারংবার বিনষ্ট করছিলো রাবণের আশ্রিত রাক্ষসেরা। মুনি, ঋষিরা ভগবান রামচন্দ্রকে দেখে প্রীত ও প্রসন্ন হলেন। ভাবলেন তাঁহাদের তপস্যার ফল সার্থক হয়েছে। যে ভগবানের দর্শনের জন্য এত কৃচ্ছতা পালন করছিলেন- তা আজ সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি করলো। সকল কিছুই ভগবানের চরণে সমর্পণ করলেন। এরপর রাবণের রাক্ষস কূলের অত্যাচারের বিবরণ করলেন ।
শুনে রামচন্দ্র বললেন- “এখুনি আমি এই রাক্ষস দিগের বিনাশ করবো।” সীতাদেবী বললেন- “প্রভু! এস্থানে অনেক অবলা আর নীরিহ জীব বসবাস করে, আপনি যখন রাক্ষস দিগের সাথে যুদ্ধ করবেন তখন মাঝে থেকে তাদের প্রাণ নাশ হবে। অতএব এইস্থানে আপনি রাক্ষস দিগকে যুদ্ধে আহ্বান জানাবেন না।” ভগবান রামচন্দ্র তখন সীতাদেবীর প্রস্তাব মেনে নিলেন। মুনি গণ বললেন- “হে রামচন্দ্র! এই স্থানেই মহর্ষি অগস্ত্যের শিষ্য সুতীক্ষ্ণ মুনি বসবাস করেন। সে আপনার একান্ত ভক্ত। দয়া পূর্বক আপনি তাঁর আশ্রমে অবশ্যই যাবেন।” ভগবান রামচন্দ্র, সীতাদেবী ও লক্ষণ সেই সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে গেলেন। সুতীক্ষ্ণ মুনি যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একবার ভাবলেন এই সকল স্বপ্ন কিনা! পড়ে ভাবলেন স্বপ্নেও রঘুপতির দর্শন অত্যন্ত উচ্চ ব্যাপার। স্বয়ং রঘুপতি কৃপা না করলে এই রকম সৌভাগ্য হবে না। রামচন্দ্রের দর্শন কি ভাবে পেলেন? তিনি তো এত ভক্তসঙ্গ, শাস্ত্রপাঠ করেন নি। এসকল কিভাবে সম্ভব হল? সাক্ষাৎ হরির দর্শন কিভাবে তিনি পেলেন? পড়ে ভাবলেন এসকল প্রভুর অহৈতুকী কৃপা। যার ফলেই এই দর্শন সম্ভব। ভগবান রাম, সীতাদেবী ও লক্ষণ এসে মুনি সুতীক্ষ্ণ কে প্রণাম জানালেন। সুতীক্ষ্ণ মুনি করজোড়ে ভগবান রামচন্দ্রকে প্রনাম জানালেন। ভক্তিভাবে তার অশ্রু জল নির্গত হল। সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে পনসের মতো হচ্ছিল্ল। ভাবে গদ গদ হয়ে মুখের বোল স্ফুরন হচ্ছিল্ল না। অনবরত ক্রন্দন করেই যাছিল্ল। তখন ভগবান রাম মৃদু হেসে খালি সেই মুনি সুতীক্ষ্ণ কে চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তিতে দর্শন দিয়ে পুনঃ রাম রূপে আসলেন । মুনি ক্রন্দন করতে লাগলেন । বাক্য স্ফুরিত হল। বললেন- “হে রঘুনন্দন ! হে পুরুষোত্তম ! আপনার এই পবিত্র স্বরূপ দর্শনে আমি কৃতার্থ। হে মহাপ্রভু ! আমি কিরূপে আপনার স্তব করবো। আমার বাক্য সকল লুপ্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে আপনার এই দিব্য স্বরূপ দর্শন করতে চাই। হে দয়াময়, আপনার চরণেই সকল তীর্থ। আপনার চরণেই সকল শাস্ত্র। আপনি যেখানে চরণ স্থাপন করেন সেইখানেই অমরাবতী সৃষ্টি হয়। হে করুণাময় ভগবান। আপনার এই ভক্ত সদা সর্বদা হৃদয়ে কেবল আপনাকেই দর্শন করতে চায়।”
অতঃ মুনি সুতীক্ষ্ণ রাম নাম কীর্তন করে ভগবানের সম্মুখে প্রেমে মত্ত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। পুস্পাদি দ্বারা অঞ্জলি প্রদান করলেন। মুনির প্রেমাশ্রুতে ভগবানের চরণ সিক্ত হল। ভগবানের বন আগমনের আর একটি কারণ ভক্তসঙ্গ। ভক্তের সঙ্গ স্বয়ং ভগবান নিজেও গ্রহণ করেন, তাই এমন শুদ্ধ ভক্তকে তিনি আপন ধাম বৈকুণ্ঠে স্থান দেন । মুনি ক্রন্দন করে ভাবাবেগে বলতে লাগলেন- “হে মহাবিষ্ণু । আপনি রামচন্দ্র । আপনি অনাদির আদি গোবিন্দ। হে মধুসূদন ! আপনিই মৎস্য অবতারে বেদ উদ্ধার করেছেন, আপনি কূর্ম অবতারে মন্দার পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারন করেছিলেন, আপনি মোহিনী অবতারে দেবতাদিগকে অমৃত প্রদান করেছেন। আপনি বরাহ রূপে দৈত্য বধ করে ধরিত্রী দেবীকে উদ্ধার করেছেন। আপনিই স্তম্ভ থেকে নৃসিংহ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। হে মাধব আপনিই বামন রূপে বলিকে আপনার শ্রীচরণ প্রদান করে ধন্য করেছেন। আপনিই জমদাগ্নিপুত্র পরশুরাম রূপে আবির্ভূত হয়ে ক্ষত্রিয় দিগের উৎপীড়ন হতে ব্রাহ্মণ দিগকে রক্ষা করেছেন। আপনি এখন রাম রূপে। হে শেষনাগশয্যাশায়ী ভগবান বাসুদেব! আমি অধম মূর্খ! বড় বড় যোগীগণ আপনার বন্দনা করে শেষ করতে পারেন না। আপনি সেই বেদে বর্ণিত ব্রহ্ম । হে ভগবান রাম, আপনি মাতা সীতা সহিত, ভ্রাতা লক্ষণ সহিত আমার হৃদয়ে অবস্থান করুন। হে ভগবান আমার ত্রুটি সকল মার্জনা করুন।” এইভাবে মুনি স্তবস্তুতি করলেন। ভগবান তাঁর ভক্তকে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন। সেই দিন তাঁরা তিন জন , ভক্তের আলয়ে কাটালেন। পরদিন সুতীক্ষ্ণ মুনি ভগবান রাম, দেবী বৈদেহী ও লক্ষণ কে গুরু অগস্ত্যের আশ্রমে নিয়ে গেলেন। পথে যেতে যেতে শোনাতে লাগলেন ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই রাক্ষসের কথা ।
সুতীক্ষ্ণ মুনির সাথে রাম, সীতামাতা ও লক্ষণ গমন করতে করতে সুতীক্ষ্ণ মুনির কথিত গল্প শ্রবন করতে লাগলেন । সুতীক্ষ্ণ মুনি বললেন- “হে ভগবন! যে পিপ্পলি বনে আমার গুরুদেব অগস্ত্য মুনির আশ্রম , সেখানে পূর্বে দুই রাক্ষস বাস করতেন । আপনারা সেই কথা শ্রবন করুন।” বহু পূর্বে ইল্বল ও বাতাপি নামক দুই রাক্ষস বাস করতো। সেই মায়াদয়াহীন ভয়ানক রাক্ষস যুগল নিষ্ঠুর ভাবে ব্রাহ্মণ বধ করতেন । সেও ছিলো এক অদ্ভুত রকমের মায়া। যেনো মিছরির ছুড়ি। কোন আক্রমণ, অস্ত্রাদি ছাড়াই । মায়াবিদ্যায় পারঙ্গদ বাতাপি মেষের রূপ ধারন করে থাকতো । ইল্বল রাক্ষস, ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে আনত । মেষের রূপধারী বাতাপিকে কেটে রান্না করে সেই ব্রাহ্মণকে মাংস ভোজন করাতো। ব্রাহ্মণ অমৃত ভেবে সেই মৃত্যুবিষ গ্রহণ করতো। পড়ে ইল্বল মায়াবিদ্যা দ্বারা বাতাপিকে ডাকলে , বাতাপি সেই ব্রাহ্মণের পেট ফুঁড়ে রাক্ষস দেহে বেরিয়ে আসতো । আর উদর ছিন্ন হয়ে সেই ব্রাহ্মণ ভয়ানক যন্ত্রনা পেয়ে মৃত্যুমুখে ধাবিত হত । এভাবে এখানে ইল্বল ও বাতাপি রাক্ষস রাজত্ব চালাতেন । প্রচুর ব্রাহ্মণ কে সেই দুই রাক্ষস এইভাবে যমদুয়ারে প্রেরণ করেছিলো। যে ব্রাহ্মণ ইল্বলের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতো সে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতো। সে বেঁচে ফিরতো না । একদিবসের কথা । অগস্ত্য মুনি এইস্থানে এসেছেন । অগস্ত্য মুনির দিব্য তেজের কথা ত্রিলোক বিদিত। এক গণ্ডূষে সপ্ত সমুদ্রের জল পান করেছিলেন ।
ইল্বল রাক্ষস তখন বাতাপির সাথে পরামর্শ করে বাতাপিকে মেষ সাজালো। অপরদিকে অগস্ত্য মুনিকে সাদরে বন্দনা জানিয়ে বলল- “হে মহামুনে! আপনার আগমনে আমি ধন্য। কৃপা করে মম গৃহে আপনার শ্রীচরণের ধুলো দিলে আমি কৃতার্থ হবো। হে ব্রাহ্মণ! আপনি কৃপা বশত আজ আমার গৃহে অবস্থান করে, আহার গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করবেন।” অগস্ত্য মুনি সবই জানেন । তিনি রাক্ষসের মায়াতে পা দেবার অভিনয় করে ইল্বলের সাথে গেলেন । অগস্ত্য মুনি বললেন- “বতস্য! আজ আমাকে মেষমাংস আহার করাও ! বহুদিন যাবৎ মেষমাংস আহারের ইচ্ছা ।” ইল্বল খুশীতে ডগমগ । অগস্ত্যের মতো ব্রাহ্মণ তেজস্বী মুনিকে হত্যা করতে পারলে রাক্ষসদের মাঝে সম্মান বৃদ্ধি পাবে। ইল্বল মেষরূপী বাতাপি কে কেটে রন্ধন করলেন। অপরদিকে স্নানান্তে অগস্ত্য মুনি কমণ্ডলু তে গঙ্গা দেবীর আহ্বান করে কদলীপত্র নিয়ে আহারে বসলেন । বললেন- “বতস্য! আমাকে সব টুকু মেষ মাংসই প্রদান করো। লোভ বশে নিজের জন্য সামান্য কিছু রাখলে আমি শাপ দেবো।” ইল্বল কদলী পত্রে অন্নাদি ব্যাঞ্জন ও সবটুকু মেষ মাংস প্রদান করলেন । অগস্ত্য মুনি পরম তৃপ্তি সহকারে ভোজন করতে লাগলেন । একেবারে সব টুকু মেষমাংস আহার করলেন । ইল্বল মনে মনে হাসতে লাগলো। মুনিও “অতি উত্তম রন্ধন” বলে সব ভোজন করলেন । আহারান্তে গঙ্গা জল পান করে মুখশুদ্ধি গ্রহণ করলেন। তখন ইল্বল রাক্ষস এসে “বাতাপি” , “বাতাপি” বলে ডাকতে লাগলো। অগস্ত্য মুনি বললেন- “তোমার সকল ছলছাতুরী আমি জানতাম। তোমাদের বিনাশের জন্যই আমি এখানে এসেছি। বাতাপি আর আসবে না। তাকে আমি খেয়ে হজল করেছি। সে প্রাণ হারিয়েছে। সে আর বেঁচে নেই।” শুনে ইল্বল, অগস্ত্য মুনিকে বধ করতে গেলে মুনি শাপ দিয়ে ইল্বলকে ভস্ম করলেন । সুতীক্ষ্ণ মুনির গল্প শুনতে শুনতে অগ্যস্ত মুনির আশ্রম চলে আসলো। সুতীক্ষ্ণ গিয়ে গুরুদেব অগস্ত্যকে প্রণাম জানিয়ে বললেন- “গুরুদেব! আমার সাথে স্বয়ং দাশরথি রামচন্দ্র ও তাঁহার পত্নী সীতাদেবী ও রামচন্দ্রের ভ্রাতা লক্ষণ এসেছেন।”
অগস্ত্য মুনি রাম, লক্ষণ, সীতাকে স্বাগত জানালেন। ভগবান রাম, জানকী দেবী ও লক্ষণ, মুনি অগস্ত্যকে বন্দনা করে প্রনাম জানালেন । মুনির আশ্রমে যেনো মহা উৎসব আরম্ভ হল। শিষ্য গণ ভগবান রামকে দেখে নিজেদের ধন্য মনে করছিলেন । উত্তম পুস্প দ্বারা ভগবান রামচন্দ্রের পূজাদি করলেন । সুগন্ধি চন্দনের প্রলেপ প্রভুর অঙ্গে প্রদান করলেন। বনের মিষ্টি ফল, গোদুগ্ধ, মধু, কন্দ ইত্যাদি প্রদান করলেন। মুনির আশ্রমে আনন্দ আর আনন্দ । মুনি বললেন- “রঘুবর! আমি জানি আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্যই এই অরণ্যে এসেছেন। আপনাকে আমি অস্ত্রাদি বিদ্যা ও দেবতাপ্রদত্ত অস্ত্র প্রদান করিব। বহু পূর্বে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এই সব অস্ত্র আমাকে দিয়ে আপনাকে প্রদান করতে আদেশ করছেন।” ভগবান রাম বললেন- “মুনিবর! আপনার থেকে আমি বিদ্যা গ্রহণে ইচ্ছুক। আপনি আমার আজ থেকে গুরু হবেন। গুরু হয়ে আমাকে শিষ্য বানিয়ে ধন্য করবেন।” সেই রাত্রি অগস্ত্য মুনির আশ্রমে সকলে কাটালেন । পরদিবস অগস্ত্য মুনি রামকে দীক্ষা দিলেন । তারপর নানান অস্ত্রাদি বিদ্যা প্রদান করলেন । এরপর রামচন্দ্রকে অনুরোধ জানালেন গোদাবোরী তীরে এই পঞ্চবটিতেই অবস্থান করে যেতে। ভগবান রামচন্দ্র স্বীকৃত হলেন। এখানে ভগবান রামের সাথে জটায়ুর সাক্ষাৎ হয়েছিলো ।
অগস্ত্য মুনির আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে রাম লক্ষণ ও সীতাদেবী সেই দণ্ডকারণ্য ঘুরে দেখতে লাগলেন। এখানে গভীর জঙ্গল বহুদূর দুরান্ত অবধি বিস্তৃত হয়েছে । চতুর্দিকে কেবল সবুজে আচ্ছদিত বৃক্ষ । আর পবিত্র গোদাবরী নদী । কুলকুল বেগে স্বচ্ছ মিষ্টি জল প্রবাহিত হচ্ছে । নদী যেনো এখানে কথা বলে এমনই । আর দেখলেন সেখানে বহু মুনি ঋষির আশ্রম । সেই শাস্ত্রীয় বিদ্বান মুনি ঋষি সন্ন্যাসী গন এখানে ভগবান প্রাপ্তির জন্য কঠিন সাধনায় মগ্ন। ভগবান রাম, লক্ষণ ও সীতা সেই মুনিদিগকে প্রণাম পূর্বক নানা আলোচনাতে মগ্ন হলেন । এই ফুল, ফল দিয়ে সজ্জিত অরণ্য দেখলে মনে হয় বিধাতা সকল প্রকার শান্তি, আনন্দ দিয়ে এই অরণ্যের সৌন্দর্যকে গেঁথেছেন । মুনি গন বললেন- “হে রাম! এই স্থান যত সুন্দর তত ভয়ানক। হিংস্র পশুর থেকেও এখানে হিংস্র রাক্ষসেরা বাস করেন। তুমি তাড়কা, সুবাহু বধ করে মারীচকে দূর করেছো, বিরাধ বধ করেছো এই সংবাদ অবশ্যই খড় আর দূষণ পেয়েছে। তুমি এখানে জানলে সে নিশ্চুপ থাকবে না।” ভগবান রাম বললেন- “হে মহাত্মাগণ আমি চাই তারা এই সংবাদ পাক। তাদের নিধন করে এই অরণ্য থেকে চিরতরে রাক্ষসদের বিদায় করবো। আপনাদের তখন আর কোন ভয় থাকবে না।” মুনি ঋষিরা বললেন- “আমরা জানি আপনি সেই রাক্ষসদের বধের জন্যই নরদেহ অবলম্বন করেছো। সেই খড় দূষণের সাথে প্রবল শক্তিশালী মায়াবী চতুর্দশ রাক্ষস থাকে। তাদের যথেচ্ছ আক্রমণে আমরা বড়ই বিপদে। আপনি শীঘ্র সেই রাক্ষসদের অন্ত করবেন- ইহা আমরা জানি।” এইভাবে মুনি ঋষিরা রাম লক্ষণ কে দিব্যজ্ঞান এর সাথে সাথে রাক্ষসদের অত্যাচারের ঘটনা সব বর্ণনা করলো । এরপর রামচন্দ্র লক্ষণ কে আদেশ দিলেন- “ভ্রাতা! এইস্থানেই কুটির নির্মাণ করো। আমরা এই স্থানেই থাকবো। এই পঞ্চবটি গোদাবরী খুবুই রম্য অরণ্য। দেবী জানকীও এই স্থানে এসে অত্যাধিক প্রীতা হয়েছেন।”
লক্ষণ ও বনবাসীরা মিলে কুটির নির্মাণের আয়োজন করতে লাগলো। মাটি দিয়ে বেদী বানালো। চতুর্দিকে বাঁশ ও শালের কাণ্ড দ্বারা খুঁটি নির্মিত করা হল । খঁড়, বাঁশ দিয়ে ছাউনি বানিয়ে দেওয়াল ও উপরের আচ্ছাদন নির্মাণ করা হল। বাঁশ দিয়ে জানলা, দরজার কপাট নির্মিত করা হল। এইভাবে সুন্দর কুটির নির্মাণ হল। কুটিরের প্রবেশের মুখে কদলী বৃক্ষ রোপিত করা হল। তুলসী, আমলকী, বিল্ব, হরিতকী , আম্র, দাড়িম্ব ও অনান্য পুস্পের বৃক্ষ কুটিরের চারিদিকে রোপণ করা হল । ভগবান রাম মুনি ঋষিদের দ্বারা গৃহ প্রবেশের পূজাদি সম্পন্ন করলেন। যজ্ঞ করলেন মৃগনাভি, কস্তূরী দ্বারা । এই প্রকারে কুটির নির্মাণ হল । কুটিরে বাঁশ দ্বারা খাঁট, তাঁর ওপরে শুকনো তৃন বিছিয়ে শয্যা স্থাপিত হল। এইখানেই রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী বাস করতে লাগলেন। প্রত্যহ রাম ও লক্ষণ জঙ্গলে ফলমূলাদি অন্বেষণে যেতেন । মাতা সীতাদেবী বনবালিকাদের সাথে গোদাবরীতে নাইতে যাইতেন। মৃত্তিকার কলসে জল ভরে আনতেন । বনবালিকাদের সাথে সীতাদেবী ক্রীড়া করতেন । বনবালিকারা নতুন সই পেয়ে অতীব প্রীত হয়েছিলো। তারা উত্তম সুগন্ধি পুস্প, মিষ্ট ফল এনে সীতাদেবীকে উপহার দিতেন । সকলের সাথে মিলে সীতাদেবী সেসকল গ্রহণ করতেন । গৃহে ফিরে ফল মূলাদি ভগবান রাম ও লক্ষণকে প্রদান করে নিজে সেবা নিতেন । সাধু সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা চাইতে এলে সীতাদেবী ভিক্ষা দিতেন। সাধু সন্ন্যাসীরা প্রসন্ন চিত্তে ভিক্ষা পেয়ে গমন করতেন । প্রকৃতির সাথে সীতাদেবী একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন । যখন বনে যেতেন দেখতেন বিবিধ রংবেরঙের কারুকার্য শোভিত প্রজাপতি ডানা মেলে প্রকৃতির দেওয়া উপহার পুস্প থেকে পুস্পে উড়ে বেড়াতো। সীতাদেবীকে উজ্জ্বল পুস্প ভেবে ভ্রমে প্রজাপতি কখনো কখনো তাঁর উপর বসতো । মৃগশিশুরা সীতাদেবী যখন ক্রীড়া করতে গিয়ে বনে মাঠে বনবালিকাদের সাথে গল্প করতেন, তখন তাঁর ক্রোড়ে এসে অধিষ্ঠান করতো নিশ্চিন্তে ।
বনবালিকাদের মাঝে মাঝে মনে হতো, নিরাকারা প্রকৃতিদেবীই সাক্ষাৎ সাকারা হয়ে সীতা মূর্তি ধরে এই বনে এসে তাহাদিগের সাথে ক্রীড়া করছেন । ইনি কোন মানবী নয়। স্বর্গের কোন দেবী । নাহলে গাত্রে এত জ্যোতি কেন ? চেহড়ায় এত দ্যুতি কেন ? সমস্ত প্রকার সৌন্দর্য, মধুরিমা একত্রিত হয়ে সীতা রূপে আবির্ভূতা হয়েছে । যখন সীতাদেবী গোদাবরী নদীতে অবস্থান করতেন, মৎস্য রা নির্ভয়ে তার অঙ্গ স্পর্শ করতো নিশ্চিন্ত হয়ে। মনে হতো এই অভয়া দেবী কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারেনই না । এঁনার থেকে ভয় কি! পক্ষী কূল মিষ্টি সুরে ক্রীড়াতে যখন ক্লান্ত হতেন জানকী দেবী তখন ছন্দে ছন্দে তারা কলরব করতেন । মিষ্টি সুর, শীতল বন, বিবিধ সুগন্ধি ফুলের ঘ্রানে আমোদিত হয়ে থাকতো দণ্ডকারণ্য । সেই স্থানে এইভাবে বাস করতে থাকলেন রাম, লক্ষণ, সীতাদেবী। ভগবান রামচন্দ্র ও সীতাদেবী নানা দিব্য কথায় রাত্রি জাগরণ করতেন। কুটিরের বাইরে অগ্নি প্রজ্বলিত করে লক্ষণ ধনুর্বাণ নিয়ে সতর্ক পাহাড়ায় থাকতেন । এই ভাবে তাহাদের মিষ্টি মধুর দিন কাটতে লাগলো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বৎসর কেটে গেলো। নয়, থেকে দশ বৎসর তারা এখানেই কাটালেন । বনের পরিবেশে আনন্দ, হাসির সাথে। কিশোরী সীতাদেবী এখন যুবতী । তাঁর সৌন্দর্যে কোটি চন্দ্র একত্রিত হয়েও লজ্জা পাবে। এমনই ছিলো মাতা লক্ষ্মীর রূপ ।
বনের প্রাকৃতিক পরিবেশে রাম, সীতাদেবী ও লক্ষণের দিন কেটে যাছিল্ল । অনেক মুনি ঋষি সন্ত রোজ ভগবান রাম সীতার দর্শন করতে আসতেন । অনেক আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আলোচনা হতো। বনের পশুগুলি যেনো এই সময়ে ভগবান রাম, সীতাদেবীকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন । নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগলেন । সম্পূর্ণ অন্য এক পরিবেশ । সীতাদেবীকে এত প্রসন্ন দেখে ভগবান রাম খুশী হলেন। তিনি ভেবেছিলেন মিথিলার রাজকুমারী- এত সুখ ঐশ্বর্য বৈভবে লালিতা পালিতা- হয়তো বনে এসে তিনি খুবুই রোদন করবেন। কারন এই স্থানে রাজকীয় সুখ, রাজকীয় ঐশ্বর্য , শত দাস দাসী, গমনের জন্য স্বর্ণরথ , প্রচণ্ড দাবাদাহে পথ চলবার জন্য স্বর্ণছত্র , চরণে কোমল পাদুকা কিছুই নেই । সীতাদেবী একা ঘর সংসারের কাজ চালান । সীতাদেবী এত নিখুত ভাবে ঘর সংসারের দায়িত্ব পালন করেন কে বলবে তিনি এক রাজার দুহিতা, অতি যত্নে লালিতা। ছড়া দিয়ে কুটির লেপা, খড়ের মার্জনী দ্বারা গৃহ আঙিনা পরিষ্কার, কলসিতে গোদাবরীর জল বয়ে আনা, বৃক্ষে জল সিঞ্চন, সকলকে আহার বিতরণ করা। নিস্কালন্ত ভাবে সকল কর্ম নিয়মানুযায়ী করে যাচ্ছেন । মুখে কোন না নেই, আলস্য নেই। মনে হতে লাগলো অরণ্যের এই কুটিরে যেনো এক রত্নের ন্যায় প্রভাবশালী উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় সীতাদেবী অবস্থান করছেন । যিনি রাজার গৃহে পলান্ন , মিষ্টান্ন, হালুয়া- পুরি নিত্য সেবা নিতেন, তিনি সামান্য ফলমূলেই সন্তুষ্ট । যেনো বিধাতা সর্ব উত্তম সুস্বাদু রস ফলমূলে স্থাপিত করে দিয়েছেন । যিনি গজমতী হার, মণি মুক্তা বসানো বালা, স্বর্ণ কুণ্ডল ধারন করতেন তিনি বনের সামান্য পুস্পমালার সাজেই এত খুশী হচ্ছেন । রামচন্দ্র মনে সান্ত্বনা পেলেন । চারিদিকে কি সুন্দর পরিবেশ। হেমন্ত এর আগমন ঘটেছে। গুবাক, নারকেল, খর্জূর, আমলকী , পনস, আম্র , শাল, সেগুন, চন্দন বৃক্ষের রাশি চতুর্দিকে ।
রাক্ষস খড় আর দূষণের প্রেরিত মায়াবী রাক্ষসেরা অবগত হয়ে খড় ও দূষণ কে বলল- “রাক্ষসরাজ ! অযোধ্যার রাজকুমার শ্রীরাম সস্ত্রীক ও ভ্রাতা লক্ষণ সহিত অরণ্যে এসেছেন । এরাই সেই বীর যারা মারীচকে শত যোজন দূরে নিক্ষেপ করেছে। এরাই তাড়কার ন্যায় বীরাঙ্গনা রাক্ষসী ও সুবাহু রাক্ষসকে সংহার করেছে। এরাই বিরাধ বধ করেছে। আপনি লঙ্কায় রক্ষরাজ দশাননের নিকট সংবাদ প্রেরন করুন। ” খড় ও দূষণ অট্টহাস্য করে বলল- “ঐ দুই মানবের জন্য ভ্রাতা দশগ্রীবের আসবার প্রয়োজন নেই। আমার আশ্রিত চতুর্দশ রাক্ষস নরমাংসভোজী । তাহারাই ঐ দুই যুবককে হত্যা করে আহার করুক। আর পরম রূপসী রামচন্দ্রের পত্নীকে আমরা বন্দী করে লঙ্কায় প্রেরণ করবো, সে ভ্রাতা দশাননের পত্নী হবার উপযুক্ত। দশাননের মতো বীরকে অবশ্যই সেই সুন্দরী বিবাহ করবে।” এইভাবে রাক্ষসেরা নানা অলীক কল্পনাতে হাস্য করতে লাগলো। অমরাবতীর দেবতাবৃন্দ চাইছিলো খড় ও দূষণ শ্রীরামের নিকটে যুদ্ধ করতে গমন করুক। সেখান হতে একটি রাক্ষসও বেঁচে আসবে না। সবকটা প্রাণ হারাবে । তখনই দেবশক্তির জয় হবে। রাবণের সাঙ্গপাঙ্গ সকলেই নিধন হলে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে। অনার্য সংস্কৃতি লুপ্ত হবে । অপরদিকে বনের কথা শোনা যাক । বিবিধ সুগন্ধি পুস্প দ্বারা সীতাদেবী মাল্য রচনা করেছেন । প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য সেই পুস্পমালায় একত্রিত হয়েছিলো। তার সুবাস স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষের পুস্পকেও হার মানিয়েছিলো । দিব্য চন্দনের প্রলেপ দ্বারা সীতাদেবী সেই মাল্যগুলিকে সৌরভিত করেছিলেন । সন্ধ্যার পর নির্মল আকাশে চন্দোদয় হল। সমগ্র অরণ্য জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হল। বড় বড় মহীরুহ গুলো যেনো জ্যোৎস্না প্লাবনে স্নানাদি করলো। শাখায় শাখায় উজ্জ্বল শুভ্র কিরণ ছড়িয়ে পড়লো। নিঃশব্দ গোদাবরী তট, কেবল চন্দ্রালোকে বালুকারাশি চকচক করছিলো, কেবল জলপ্রবাহের শব্দ। চতুর্দিকে জোনাকী পোকার মিটিমিটি আলোক পুঞ্জ জলে উঠে নিভে যাছিল্ল। শাখায় শাখায় সুগন্ধি পুস্প শোভিত, তাতে জোনাকীর দল স্বীয় আলো দ্বারা শোভা বর্ধন করছিলো। যেনো আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলী ধরিত্রীর বুকে নেমে আসছিলো ।
শ্রীরাম ও সীতা সেই সুন্দর নিশিতে বন মাঝে ছিলেন। উভয়ে উভয়ের হৃদয় যেনো ধারন করেছিলেন। মনের ভাব মুখ হতে নিঃসৃত হবার পূর্বেই বুঝে নিয়েছিলেন । জ্যোৎস্না আলোকে সীতাদেবীর মুখমণ্ডলে এক অকৃত্রিম সৌন্দর্য শোভা পাছিল্ল। তা দেখে যেনো মাঝে মাঝে রোহিনীপতি নিশানাথ মেঘ মণ্ডলের মাঝে নিজেকে লুক্কায়িত করেছিলেন । কোটি চন্দ্রের রূপকেও লজ্জা দেবে জনকদুহিতার রূপ । একে অপরকে পুস্পমাল্য চন্দনের প্রলেপ দ্বারা সুসজ্জিত করলেন । পুস্পসাজে উভয়ের রূপ শতগুণ বর্ধিত হয়েছিলো। সুগন্ধি চন্দন এক দিব্য সুগন্ধ প্রাপ্ত করলো উভয়ের গাত্রে অবস্থান করে । পুস্প, চন্দনের সুবাসে চতুর্দিকে আমোদিত করলো। উভয়ের মধ্যে দিব্য ঐশ্বরিক ভাব ফুটে ফুটলো । রামচন্দ্রএর মধ্যে বিষ্ণু ভাব, দেবী সীতার মধ্যে লক্ষ্মীর ভাব ফুটে উঠলো । ভগবান রাম বললেন- “হে মধুমুখী সীতা! সময় এসেছে আমার তোমার বিচ্ছেদের। পূর্বে নারদ মুনি আমাকে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তা এখন কার্যকারী হবে। মনে আছে পূর্বে আমাদের বিবাহ লগ্ন চন্দ্রদেব ভঙ্গ করেছিলো। দেবতাদের ইচ্ছা আমার তোমার বিচ্ছেদ হোক, নাহলে লঙ্কার পতন হবে না। রাবণের মৃত্যু হবে না।” দেবী সীতা বললেন- “হে ভগবান! আমি আপনি এক। লৌকিক দৃষ্টিতে এই বিচ্ছেদ। আপনার মধ্যে আমি, আমার মধ্যে আপনি সদা বিদ্যমান। আমিও বিস্মৃত হই নি, বেদবতী রূপে আমি রাবণকে কি অভিশাপ প্রদান করেছিলাম । হে নাথ! এই বিচ্ছেদ কে সৃষ্টির কল্যাণে আমি মস্তকে গ্রহণ করলাম। কারন রাবণের ধ্বংস না হলে অধর্মের রাজত্ব চলতেই থাকবে।” বলা হয় এরপর রামচন্দ্র আসল সীতাদেবীকে অগ্নি দেবতার কাছে রেখে সুরক্ষার দায়িত্ব প্রদান করেন। একজন নকল সীতাদেবীকে আনয়ন করেন। রাবণ একেই হরণ করেছিলো ।
অগ্রজের নিকট গমন করুন।” ভগবান রামচন্দ্রের কাছে সেই রাক্ষসী গিয়ে বলল- “হে কুমার! আপনার ভ্রাতা আমার সাথে বিবাহে ইচ্ছুক নয়। আপনি এখানে সস্ত্রীক আছেন। আমি সতীন নিয়ে সংসার করতে রাজী। আপনি আপনার প্রথমা স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে আমাকে বিবাহ করুন। আপনার ন্যায় সুপুরুষকে আমি হারাতে চাই না।” ভগবান রাম বললেন- “হে দেবী! আমি পিতার বচনে ও মাতার আদেশে চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে সন্ন্যাস পালন করছি। এই অবস্থায় আমার পক্ষে বিবাহ সম্ভব নয়। আপনি আমার ভ্রাতার কাছে যান, তাহাকে ভালো মতো বুঝিয়ে রাজী করুন। হয়তো সে আজই আপনাকে বিবাহ করতে পারে। পিতৃসত্য কেবল আমার জন্যই, আমার ভ্রাতা লক্ষণ এইথেকে মুক্ত।” শূর্পনাখা এরপর লক্ষণের কাছে গিয়ে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। লক্ষণ বলল- “দেবী এখানে আমি দাস। এখানে আমি ভৃত্য। এই অবস্থায় আমি কিভাবে বিবাহ করবো ? আমার অগ্রজই সর্বশক্তিমান । আমি কেবল তাঁর আদেশবাহক । সেবকের কাছে সুখ, ভিখারির পক্ষে সম্মান, দুরাচারীর পক্ষে অর্থ সম্পদ, ব্যভিচারীর পক্ষে শুভগতি, লোভীর পক্ষে যশ আর দাম্ভিকের পক্ষে চতুর্বিধ ফল আশা করা আর আকাশ মন্থন করে দুগ্ধ লাভ করার অলীক কল্পনা একই ব্যাপার। আমার পক্ষে সেইরূপ তোমাকে বিবাহ সম্ভব নয়। তুমি অগ্রজের কাছে যাও।” এভাবে শূর্পনাখা রাক্ষসী বারবার রাম, লক্ষণের কাছে গিয়ে বিফল হলে অতীব ক্রোধী হল ।
চতুর্দশ শক্তিশালী রাক্ষসের নিধনের বার্তা পেয়ে খড় আর দূষণ আশ্চর্য, অবাক ও অতিশয় ক্রুদ্ধ হল।
তারা রাগে গর্জন করতে করতে সমস্ত রাক্ষস সেনাকে হস্তি, অশ্ব, রথ সহ তৈরী হতে আদেশ দিলেন । দূষণ রাক্ষস ছয় হাজার সেনা সমেত যুদ্ধে চললেন, এছাড়া খড় রাক্ষস অযূথ রথ, অশ্বারোহী , হস্তী বাহিনী, পদাতিক রাক্ষস সেনা নিয়ে চললেন। খড়ের সেনাপতি বিকট দর্শন ত্রিমস্তকধারী ত্রিশিরা রাক্ষস প্রকাণ্ড মুগুর নিয়ে রথে উঠলেন । হৈ হৈ করতে করতে ভয়ানক দর্শন রাক্ষসেরা আসতে লাগলো । বন জঙ্গলে ভেঙ্গে, প্রকাণ্ড বৃক্ষ গুলিকে উৎপাটন করে রাক্ষসেরা আসতে লাগলো। অযূথ রাক্ষসের আগমনে মনে হতে লাগলো এক ঝড় যেনো জঙ্গল মধ্য দিয়ে ধেয়ে আসছে। রাম বললেন- “লক্ষণ তুমি জানকী সহিত পর্বতের গুহায় আশ্রয় নাও। এই রাক্ষসদের সাথে আমি এখন যুদ্ধ করবো।” লক্ষণ বলল- “অগ্রজ! আপনি কেন আমাকে এত দুর্বল বিবেচোনা করেন? আমি চোখের পলকে এই রাক্ষসদের ধ্বংস করতে পারবো। আপনি ও বৌঠান দুজনে বিশ্রাম করুন। আমি এদের যমালয়ে প্রেরন করবো।” রামচন্দ্র মৃদু হাস্য করে বললেন- “লক্ষণ, ভ্রাতা ! আমি জানি তুমি এই সকল রাক্ষস তৃণবৎ নষ্ট করতে পারবে। কিন্তু এই রাক্ষসদের বিনাশ করতে আমি ইচ্ছা করি। তাই ইহাদিগকে আমি ধ্বংস করবো।” অগ্রজের আদেশ মেনে লক্ষণ তখন সীতাদেবীকে নিয়ে পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলেন । অপরদিকে খড়, দূষণ তার বিশাল সেনা নিয়ে এসে সমানে চতুর্দশ সেনার দেহ দেখতে পেলেন। শৃগাল, শকুন, কাকেরা সেই মৃতদেহ আনন্দে ভক্ষণ করছে। খড় রামচন্দ্রের সুন্দর কোমল রূপ দর্শন করে বললেন- “ওহে বনবাসী যোদ্ধা। আমি জানি তুমি বীর। তোমার মতো বীরকে দেখে আমার হত্যা করতে মন চাইছে না। তুমি তোমার স্ত্রীকে আমাদের হস্তে সমর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আমরা তোমাকে ক্ষমা করবো।” রামচন্দ্র বললেন- “ওহে দুর্মতি! যুদ্ধক্ষেত্রে বাক্যালাপ না করে যুদ্ধ করো। দেখি তোমার শক্তি কত!”
খড় ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ করতে আদেশ দিলেন । হৈ হৈ করে “রামকে মারো” বলে রাক্ষসেরা উজ্জ্বল শানিত অস্ত্র নিয়ে ধেয়ে গেলো। শ্রীরামচন্দ্র মন্ত্র পড়ে বজ্র বাণ, ইন্দ্রাস্ত্র বাণ নিক্ষেপ করলেন । বাণের প্রভাবে আকাশ থেকে অনেক জোরে শব্দ করে বজ্রপাত হতে লাগলো। সেই বজ্রে রাক্ষসেরা ঝলসে গেলো। ভগবান রাম পর্বত বাণ নিক্ষেপ করলেন। গগন থেকে পর্বতের চূড়ার ন্যায় শিলাখণ্ড পতিত হল । সেই শিলার আঘাতে রথ, হস্তী, অশ্বারোহী সকল পিষ্ট হতে লাগলো। রক্ত নদীর ধারা প্রবাহিত হতে লাগলো বর্ষার জলে পুষ্ট নদীর জলের ন্যায় । পবন বাণ নিক্ষেপ করে রাক্ষসদের বহু উচুতে নিয়ে গেলেন, সেখান থেকে ভূপতিত হয়ে শয়ে শয়ে রাক্ষস চূর্ণবিচূর্ণ হল । গৃধ, কাক আদি মাংসাশী প্রানী ও শৃগালেরা মনের সুখ বিচরণ করতে লাগলো মাংস খণ্ডের আশায় । দেবতারা আকাশে জড় হলেন এই যুদ্ধ দেখবার জন্য । ভগবান রাম এরপর সূচীমুখ, শিলামুখ বাণ নিক্ষেপ করলেন। রাক্ষসদের হাত, পা, মুণ্ড কেটে কেটে বহু দূরে দূরে পতিত হল। উড়ন্ত কাক, গৃধ, শৃগালেরা সেই মাংস পাবার জন্য নিজেদের মধ্যে কোন্দল করতে লাগলো। অবশেষে এত রাক্ষসের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উড়ে এলো যে তারা কোন্দল ভুলে মনের সুখে রক্ত, মাংস, নাড়ি-ভুঁড়ি ভোজন করতে লাগলো । মুণ্ডুহীন রাক্ষসেরা কবন্ধের ন্যায় মায়াবলে উঠে দাঁড়িয়ে নৃত্য করছিলো। ভগবান রাম অগ্নিবাণ ছুড়লেন । আকাশ থেকে অগ্নিপিণ্ড পতিত হতে লাগলো। অগ্নিতে ভস্ম হয়ে রাক্ষসদের ভস্ম চতুর্দিকে আচ্ছন্ন করে দিলো । অগ্নিতে হস্তী, অশ্ব আদি ভস্ম হল। রামচন্দ্রের নিক্ষেপিত দিব্যাস্ত্র থেকে হাজার হাজার শর উৎপন্ন হয়ে রাক্ষসদের বুকে বিদ্ধ হল। রক্তে মেদিনী কর্দমাক্ত হয়েছিলো। এরপর ভগবান রাম পুনঃ শিলাবাণ নিক্ষেপ করে বাকী রথ, হস্তী, অশ্বগুলি রাক্ষস সহিত পিষ্ট করলেন । এভাবে হত হতে দেখে ত্রিশিরা রাক্ষস এসে রামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলো । ত্রিশিরার সব অস্ত্র ভগবান রাম ধ্বংস করে দিলেন । ত্রিশিরা ক্রুদ্ধ হয়ে হস্তের প্রকাণ্ড মুগুর নিক্ষেপ করলে ভগবান রাম সেই মুগুর ধ্বংস করলেন। তারপর তিনটি শর দিয়ে ত্রিশিরার তিন মস্তক কেটে ফেললেন।
সব রাক্ষস অন্ত হয়েছে। এখানে দেহের স্তূপ জমেছে। রক্তনদীর ধারা গিয়ে গোদাবরীতে মিশেছে। চতুর্দিকে মাংসাশী প্রানী সকল মনের আনন্দে নিহত রাক্ষসদের ভক্ষণ করছে। দেহের স্তূপে বড় বড় বৃক্ষ গুলি চাপা পড়ে গেছে । দূষণ রাক্ষস রামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন । নানা দিব্যাস্ত্র রামচন্দ্রের দিকে নিক্ষেপ করলেও সব শর রামচন্দ্রের চালিত বাণে ধ্বংস হয়ে গেলো। এরপর ভগবান রাম তীক্ষ্ণ শর দ্বারা দূষণের রথের অশ্ব, সারথি, ধ্বজ, ছত্র, চক্র সব খণ্ডন করে গোটা রথ টাই খণ্ড খণ্ড করলেন । দূষণ লম্ফ দিয়ে ভূমিতে নেমে শূল নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে , রামচন্দ্র গন্ধর্ব বাণে দূষণের দেহ দ্বিখণ্ড করে দিলেন । ভ্রাতাকে নিহত হতে দেখে খড় শোক পেলো। রথ হতে নেমে ক্রুদ্ধ হয়ে একাকী খড় রামচন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। খড় বাণে বাণে আচ্ছদিত করে রামচন্দ্রকে ঢেকে দিলো। রামচন্দ্র বললেন- “মূর্খ রাক্ষস তুমি এমন বালকদের ভাতি কেন যুদ্ধ করছ? তোমার শর আমার গাত্রে পুষ্পসম ঠেকছে। যাও ভালো মতো যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসো।” খড় ক্রোধে অধীর হয়ে এক বাণে রামচন্দ্রের ধনুক খণ্ড খণ্ড করে দিলো । রামচন্দ্র তখন মহর্ষি শরভঙ্গ প্রদত্ত শার্ঙ্গ ধনুক নিলেন। প্রবল বীক্রমে যুদ্ধ করলেন । রামচন্দ্রের শরে খড়ের সর্বাঙ্গ রক্তে প্লাবিত হল। রক্তে রক্তময় চতুর্দিকে। যেনো এইস্থানে রক্তবৃষ্টি হয়েছে। গাছগুলি নিজস্ব বর্ণ হারিয়ে রক্তবর্ণ ধারন করেছে। মাংসাশি পশু পক্ষী গুলির গাত্রবর্ণ অবধি রক্তবর্ণ হয়েছে । এরপর রামচন্দ্র দিব্যাস্ত্রে খড়ের বধ করলেন। সব রাক্ষস নিহত। দণ্ডকারণ্যে আর রাক্ষসের অস্তিত্ব নেই । মুনি ঋষি, ঊর্ধ্বে দেবতাবৃন্দ ভগবান রামের ওপর পুস্প বর্ষণ করে স্তব স্তুতি করতে লাগলেন । শূর্পনাখা ক্রন্দন করতে করতে লঙ্কায় গমন করলো । রাক্ষসেরা ভগবানের হাতে নিধন হয়ে দিব্যদেহ প্রাপ্ত করে বৈকুণ্ঠধাম প্রাপ্তি করলো । নিহত রাক্ষসদের দেহের স্তূপে যেনো মনে হয় বিধাতা এই স্থানে পর্বতমালা তৈরী করেছেন । চতুর্দিকে কেবল রাক্ষসদের খণ্ড খণ্ড দেহ, খণ্ড অস্ত্র, খণ্ড রথ- অশ্ব- হস্তী , কীরিট , রক্তাক্ত আভূষণ ব্যতীত আর কিছুই দেখা গেলো না ।