শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে বিরাজ করিতেছেন। বৃহস্পতিবার (৯ই ভাদ্র ১২৮৯), শ্রাবণ-শুক্লা দশমী তিথি, ২৪শে অগস্ট ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ।
আজকাল ঠাকুরের কাছে হাজরা মহাশয়, রামলাল, রাখাল প্রভৃতি থাকেন। শ্রীযুক্ত রামলাল ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র, — কালীবাড়িতে পূজা করেন। মাস্টার আসিয়া দেখিলেন উত্তর-পূর্বের লম্বা বারান্দায় ঠাকুর হাজরার নিকট দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছেন। তিনি আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম বন্দনা করিলেন।
ঠাকুর সহাস্যবদন। মাস্টারকে বলিতেছেন, “আর দু-একবার ঈশ্বর বিদ্যাসাগরকে দেখবার প্রয়োজন। চালচিত্র একবার মোটামুটি এঁকে নিয়ে তারপর বসে বসে রঙ ফলায়। প্রতিমা প্রথমে একমেটে, তারপর দোমেটে, তারপর খড়ি, তারপর রঙ — পরে পরে করতে হয়। ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের সব প্রস্তুত কেবল চাপা রয়েছে। কতকগুলি সৎকাজ করছে, কিন্তু অন্তরে কি আছে তা জানে না, অন্তরে সোনা চাপা রয়েছে। অন্তরে ঈশ্বর আছেন, — জানতে পারলে সব কাজ ছেড়ে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে ইচ্ছা হয়।”
ঠাকুর মাস্টারের সঙ্গে দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছেন — আবার কখন কখন বারান্দায় বেড়াইতেছেন।
[সাধনা — কামিনী-কাঞ্চনের ঝড়তুফান কাটাইবার জন্য ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — অন্তরে কি আছে জানবার জন্য একটু সাধন চাই।
মাস্টার — সাধন কি বরাবর করতে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, প্রথমটা একটু উঠে পড়ে লাগতে হয়। তারপর আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। যতক্ষণ ঢেউ, ঝড়, তুফান আর বাঁকের কাছ দিয়ে যেতে হয়, ততক্ষণ মাঝির দাঁড়িয়ে হাল ধরতে হয়, — সেইটুকু পার হয়ে গেলে আর না। যদি বাঁক পার হল আর অনুকুল হাওয়া বইল, তখন মাঝি আরাম করে বসে, হালে হাতটা ঠেকিয়ে রাখে, — তারপর পাল টাঙাবার বন্দোবস্ত করে তামাক সাজতে বসে। কামিনী-কাঞ্চনের ঝড় তুফানগুলো কাটিয়ে গেলে তখন শান্তি।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগতত্ত্ব — যোগভ্রষ্ট — যোগাবস্থা — “নিবাতনিষ্কম্পমিব প্রদীপম্” — যোগের ব্যাঘাত ]
“কারু কারু যোগীর লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু তাদেরও সাবধান হওয়া উচিত। কামিনী—কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। যোগভ্রষ্ট হয়ে সংসারে এসে পড়ে, — হয়তো ভোগের বাসনা কিছু ছিল। সেইগুলো হয়ে গেলে আবার ঈশ্বরের দিকে যাবে, — আবার সেই যোগের অবস্থা। সট্কা কল জানো?”
মাস্টার — আজ্ঞে না — দেখি নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-দেশে আছে। বাঁশ নুইয়ে রাখে, তাতে বঁড়শি লাগানো দড়ি বাঁধা থাকে। বঁড়শিতে টোপ দেওয়া হয়। মাছ যেই টোপ খায় অমনি সড়াৎ করে বাঁশটা উঠে পড়ে। যেমন উপরে উঁচুদিকে বাঁশের মুখ ছিল সেইরূপই হয়ে যায়।
“নিক্তি, একদিকে ভার পড়লে নিচের কাঁটা উপরের কাঁটার সঙ্গে এক হয় না। নিচের কাঁটাটি মন — উপরের কাঁটাটি ঈশ্বর। নিচের কাঁটাটি উপরের কাঁটার সহিত এক হওয়ার নাম যোগ।
“মন স্থির না হলে যোগ হয় না। সংসার-হাওয়া মনরূপ দীপকে সর্বদা চঞ্চল করছে। ওই দীপটা যদি আদপে না নড়ে তাহলে ঠিক যোগের অবস্থা হয়ে যায়।
“কামিনী—কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। বস্তু বিচার করবে। মেয়েমানুষের শরীরে কি আছে — রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়ীভুঁড়ি, কৃমি, মুত, বিষ্ঠা এইসব। সেই শরীরের উপর ভালবাসা কেন?
“আমি রাজসিক ভাবের আরোপ করতাম — ত্যাগ করবার জন্য। সাধ হয়েছিল সাচ্চা জরির পোশাক পরব, আংটি আঙুলে দেব, নল দিয়ে গুড়গুড়িতে তামাক খাব। সাচ্চা জরির পোশাক পরলাম — এরা (মথুরবাবু) আনিয়ে দিলে। খানিকক্ষণ পরে মনকে বললাম, মন এর নাম সাচ্চা জরির পোশাক! তখন সেগুলোকে খুলে ফেলে দিলাম। আর ভাল লাগল না। বললাম, মন, এরই নাম শাল — এরই নাম আঙটি! এরই নাম নল দিয়ে গুড়গুড়িতে তামাক খাওয়া! সেই যে সব ফেলে দিলাম আর মনে উঠে নাই।”
সন্ধ্যা আগত প্রায়। ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায়, ঘরের দ্বারের কাছে ঠাকুর মণির সহিত নিভৃতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — যোগীর মন সর্বদাই ঈশ্বরেতে থাকে, সর্বদাই আত্মস্থ। চক্ষু ফ্যালফ্যালে, দেখলেই বুঝা যায়। যেমন পাখি ডিমে তা দিচ্ছে — সব মনটা সেই ডিমের দিকে, উপরে নামমাত্র চেয়ে রয়েছে! আচ্ছা আমায় সেই ছবি দেখাতে পার?
মণি — যে আজ্ঞা। আমি চেষ্টা করব যদি কোথাও পাই।
গুহ্যকথা
সন্ধ্যা হইল। ফরাশ ৺কালীমন্দিরে ও ৺রাধামন্দিরে ও অন্যান্য ঘরে আলো জ্বালিয়া দিল। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া জগন্মাতার চিন্তা ও তৎপরে ঈশ্বরের নাম করিতেছেন। ঘরে ধুনো দেওয়া হইয়াছে। একপার্শ্বে একটি পিলসুজে প্রদীপ জ্বলিতেছে। কিয়ৎক্ষণ পরে শাঁখঘন্টা বাজিয়া উঠিল। ৺কালীবাড়িতে আরতি হইতেছে। শুক্লা দশমী তিথি, চর্তুদিকে চাঁদের আলো।
আরতির কিয়ৎক্ষণ পরে শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসিয়া মণির সহিত একাকী নানা বিষয়ে কথা কহিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া।
[“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — নিষ্কামকর্ম করবে। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর যে-কর্ম করে সে ভাল কাজ — নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করে।
মণি — আজ্ঞা হাঁ। আচ্ছা, যেখানে কর্ম সেখানে কি ঈশ্বর পাওয়া যায়? রাম আর কাম কি এক সঙ্গে হয়? হিন্দীতে একটা কথা সেদিন পড়লাম।
“যাহাঁ রাম তাহাঁ নাহি কাম, যাহাঁ কাম তাঁহা নাহি রাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — কর্ম সকলেই করে — তাঁর নামগুণ করা এও কর্ম — সোঽহংবাদীদের ‘আমিই সেই’ এই চিন্তাও কর্ম — নিঃশ্বাস ফেলা, এও কর্ম। কর্মত্যাগ করবার জো নাই। তাই কর্ম করবে, কিন্তু ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করবে।
মণি — আজ্ঞা, যাতে অর্থ বেশি হয় এ-চেষ্টা কি করতে পারি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — বিদ্যার সংসারের জন্য পারা যায়। বেশি উপায়ের চেষ্টা করবে। কিন্তু সদুপায়ে। উপার্জন করা উদ্দেশ্য নয়। ঈশ্বরের সেবা করাই উদ্দেশ্য। টাকাতে যদি ঈশ্বরের সেবা হয় তো সে টাকায় দোষ নাই।
মণি — আজ্ঞা, পরিবারদের উপর কর্তব্য কতদিন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাদের খাওয়া পরার কষ্ট না থাকে। কিন্তু সন্তান নিজে সমর্থ হলে তাদের ভার লবার দরকার নাই, পাখির ছানা খুঁটে খেতে শিখলে, আবার মার কাছে খেতে এলে, মা ঠোক্কর মারে।
মণি — কর্ম কতদিন করতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ফললাভ হলে আর ফুল থাকে না। ঈশ্বরলাভ হলে কর্ম আর করতে হয় না। মনও লাগে না।
“মাতাল বেশি মদ খেয়ে হুঁশ রাখতে পারে না। — দু-আনা খেলে কাজকর্ম চলতে পারে! ঈশ্বরের দিকে যতই এগুবে ততই তিনি কর্ম কমিয়ে দেবেন। ভয় নাই। গৃহস্থের বউ অন্তঃসত্ত্বা হলে শাশুড়ি ক্রমে ক্রমে কর্ম কমিয়ে দেয়। দশমাস হলে আদপে কর্ম করতে দেয় না। ছেলেটি হলে ওইটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
“যে-কটা কর্ম আছে, সে-কটা শেষ হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত। গৃহিণী বাড়ির রাঁধাবাড়া আর কাজকর্ম সেরে যখন নাইতে গেল, তখন আর ফেরে না — তখন ডাকাডাকি করলেও আর আসবে না।
[ঈশ্বরলাভ ও ঈশ্বরদর্শন কি? উপায় কি? ]
মণি — আজ্ঞা, ঈশ্বরলাভ-এর মানে কি? আর ঈশ্বরদর্শন কাকে বলে? আর কেমন করে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — বৈষ্ণবরা বলে যে, ঈশ্বরের পথে যারা যাচ্ছে আর যারা তাঁকে লাভ করেছে তাদের থাক থাক আছে — প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ আর সিদ্ধের সিদ্দ। যিনি সবে পথে উঠছেন তাকে প্রবর্তক বলে। যে সাধন-ভজন করছে — পূজা, জপ, ধ্যান, নামগুণকীর্তণ করছে — সে ব্যক্তি সাধক। যে-ব্যক্তি ঈশ্বর আছেন বোধে বোধ করেছে, তাকেই সিদ্ধ বলে। যেমন বেদান্তের উপমা আছে — অন্ধকার ঘর, বাবু শুয়ে আছে। বাবুকে একজন হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে। একটা কৌচে হাত দিয়ে বলছে, এ নয়, জানালায় হাত দিয়ে বলছে, এ নয়, দরজায় হাত দিয়ে বলছে, এ নয়। নেতি, নেতি, নেটি। শেষে বাবুর গায়ে হাত পড়েছে, তখন বলছে, ‘ইহ’ এই বাবু — অর্থাৎ ‘অস্তি’ বোধ হয়েছে। বাবুকে লাভ হয়েছে, কিন্তু বিশেষরূপে জানা হয় নাই।
“আর-এক থাক আছে, তাকে বলে সিদ্ধের সিদ্ধ। বাবুর সঙ্গে যদি বিশেষ আলাপ হয় তাহলে আর একরকম অবস্থা — যদি ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমভক্তির দ্বারা বিশেষ আলাপ হয়। যে সিদ্ধ সে ঈশ্বরকে পেয়েছে বটে, যিনি সিদ্ধের সিদ্ধ তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বিশেষরূপে আলাপ করেছেন।
“কিন্তু তাঁকে লাভ করতে হলে একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য বা মধুর।
“শান্ত — ঋষিদের ছিল। তাদের অন্য কিছু ভোগ করবার বাসনা ছিল না। যেমন স্ত্রীর স্বামীতে নিষ্ঠা, — সে জানে আমার পতি কন্দর্প।
“দাস্য — যেমন হনুমানের। রামের কাজ করবার সময় সিংহতুল্য। স্ত্রীরও দাস্যভাব থাকে, — স্বামীকে প্রাণপণে সেবা করে। মার কিছু কিছু থাকে — যশোদারও ছিল।
“সখ্য — বন্ধুর ভাব; এস, এস কাছে এসে বস। শ্রীদামাদি কৃষ্ণকে কখন এঁটো ফল খাওয়াচ্ছে, কখন ঘাড়ে চড়ছে।
“বাৎসল্য — যেমন যশোদার। স্ত্রীরও কতকটা থাকে, — স্বামীকে প্রাণ চিরে খাওয়ায়। ছেলেটি পেট ভরে খেলে তবেই মা সন্তুষ্ট। যশোদা কৃষ্ণ খাবে বলে ননী হাতে করে বেড়াতেন।
“মধুর — যেমন শ্রীমতীর। স্ত্রীরও মধুরভাব। এ-ভাবের ভিতরে সকল ভাবই আছে — শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য।”
মণি — ঈশ্বরকে দর্শন কি এই চক্ষে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয় — তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, — সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়।
এই কথা শুনিয়া মণি হো-হো করিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। ঠাকুর বিরক্ত না হইয়া আবার বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়।
মণি আবার গম্ভীর হইলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিক ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়।
“তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়। মাতালের নেশা বেশি হলে বলে, ‘আমিই কালী’।
“গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমিই কৃষ্ণ।’
“তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়, যেমন — প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক, তবে খানিকক্ষণ পরে চারিদিক শিখাময় দেখা যায়।”
[ঈশ্বরদর্শন কি মস্তিষ্কের ভুল? “সংশয়াত্মা বিনশ্যতি” ]
মণি ভাবিতেছেন যে, সে শিখা তো সত্যকার শিখা নয়।
ঠাকুর অন্তর্যামী, বলিতেছেন, চৈতন্যকে চিন্তা করলে অচৈতন্য হয় না। শিবনাথ বলেছিল, ঈশ্বরকে একশোবার ভাবলে বেহেড হয়ে যায়। আমি তাকে বললাম, চৈতন্যকে চিন্তা করলে কি অচৈতন্য হয়?
মণি — আজ্ঞা, বুঝেছি। এ-তো অনিত্য কোন বিষয় চিন্তা করা নয়? —যিনি নিত্যচৈতন্যস্বরূপ তাঁতে মন লাগিয়ে দিলে মানুষ কেন অচৈতন্য হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রসন্ন হইয়া) — এইটি তাঁর কৃপা — তাঁর কৃপা না হলে সন্দেহ ভঞ্জন হয় না।
“আত্মার সাক্ষাৎকার না হলে সন্দেহ ভঞ্জন হয় না।
“তাঁর কৃপা হলে আর ভয় নাই। বাপের হাত ধরে গেলেও বরং ছেলে পড়তে পারে? কিন্তু ছেলের হাত যদি বাপ ধরে, আর ভয় নাই। তিনি কৃপা করে যদি সন্দেহ ভঞ্জন করেন, আর দেখা দেন আর কষ্ট নাই। — তবে তাঁকে পাবার জন্য খুব ব্যাকুল হয়ে ডাকতে ডাকতে — সাধনা করতে করতে তবে কৃপা হয়। ছেলে অনেক দৌড়াদৌড়ি কচ্ছে, দেখে মার দয়া হয়। মা লুকিয়া ছিল, এসে দেখা দেয়।”
মণি ভাবিতেছেন, তিনি দৌড়াদৌড়ি কেন করান। — ঠাকুর অমনি বলিতেছেন, “তাঁর ইচ্ছা যে খানি দৌড়াদৌড়ি হয়; তবে আমোদ হয়। তিনি লীলায় এই সংসার রচনা করেছেন। এরি নাম মহামায়া। তাই সেই শক্তিরূপিণী মার শরণাগত হতে হয়। মায়াপাশে বেঁধে ফেলেছে, এই পাশ ছেদন করতে পারলে তবেই ঈশ্বরদর্শন হতে পারে।”
[আদ্যাশক্তি মহামায়া ও শক্তিসাধনা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর কৃপা পেতে গেলে আদ্যাশক্তিরূপিণী তাঁকে প্রসন্ন করতে হয়। তিনি মহামায়া। জগৎকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করছেন। তিনি অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছেন। সেই মহামায়া দ্বার ছেড়ে দিলে তবে অন্দরে যাওয়া যায়। বাহিরে পড়ে থাকলে বাহিরের জিনিস কেবল দেখা যায় — সেই নিত্য সচ্চিদানন্দ পুরুষকে জানতে পারা যায় না। তাই পুরাণে কথা আছে — চন্ডীতে — মধুকৈটভ১ বধের সময় ব্রহ্মাদি দেবতারা মহামায়ার স্তব করছেন।
“শক্তিই জগতের মূলাধার। সেই আদ্যাশক্তির ভিতরে বিদ্যা ও অবিদ্যা দুই আছে, — অবিদ্যা — মুগ্ধ করে। অবিদ্যা — যা থেকে কামিনী-কাঞ্চন — মুগ্ধ করে। বিদ্যা — যা থেকে ভক্তি, দয়া, জ্ঞান, প্রেম — ঈশ্বরের পথে লয়ে যায়।
“সেই অবিদ্যাকে প্রসন্ন করতে হবে। তাই শক্তির পূজা পদ্ধতি।
“তাঁকে প্রসন্ন করবার জন্য নানাভাবে পূজা — দাসীভাব, বীরভাব, সন্তানভাব। বীরভাব — অর্থাৎ রমণ দ্বারা তাঁকে প্রসন্ন করা।
“শক্তিসাধনা — সব ভারী উৎকট সাধনা ছিল, চালাকি নয়।
“আমি মার দাসীভাবে, সখীভাবে দুই বৎসর ছিলাম। আমার কিন্তু সন্তানভাব, স্ত্রীলোকের স্তন মাতৃস্তন মনে করি।
“মেয়েরা এক-একটি শক্তির রূপ। পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে, বাংলা দেশে জাঁতি থাকে; — অর্থাৎ ওই শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। এটি বীরভাব। আমি বীরভাবে পূজা করি নাই। আমার সন্তানভাব।
“কন্যা শক্তিরূপা। বিবাহের সময় দেখ নাই — বর-বোকাটি পিছনে বসে থাকে? কন্যা কিন্তু নিঃশঙ্ক।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরলাভ করলে তাঁর বাহিরের ঐশ্বর্য, তাঁর জগতের ঐশ্বর্য ভুল হয়ে যায়; তাঁকে দেখলে তাঁর ঐশ্বর্য মনে থাকে না। ঈশ্বরের আনন্দে মগ্ন হলে ভক্তের আর হিসাব থাকে না। নরেন্দ্রকে দেখলে “তোর নাম কি; তোর বাড়ি কোথা” — এ-সব জিজ্ঞাসা করার দরকার হয় না। জিজ্ঞাসা করবার অবসর কই? হনুমানকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি? হনুমান বললে, “ভাই, আমি বার তিথি নক্ষত্র — এ-সব কিছুই জানি না, আমি এক ‘রাম’ চিন্তা করি।”
১ ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা ৷
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্য ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা ॥ [চন্ডী — মধুকৈটভবধ]
আজ (৩১ শে) আশ্বিন, শুক্লা চতুর্থী তিথি; ১৬ই অক্টোবর ১৮৮২, সোমবার। আগামী বৃহস্পতিবার সপ্তমী তিথিতে শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে রাখাল, রামলাল ও হাজরা আছেন। নরেন্দ্রের সঙ্গে আর দু-একটি ব্রহ্মজ্ঞানী ছোকরা আসিয়াছেন। আজ মাস্টারও আসিয়াছেন।
নরেন্দ্র ঠাকুরের কাছেই আহার করিলেন। আহারান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ঘরের মেঝেতে বিছানা করিয়া দিতে বলিলেন, নরেন্দ্র আদি ভক্তেরা বিশেষতঃ নরেন্দ্র বিশ্রাম করিবেন। মাদুরের উপর লেপ ও বালিশ পাতা হইয়াছে। ঠাকুরও বালকের ন্যায় নরেন্দ্রের কাছে বিছানায় বসিলেন। ভক্তদের সহিত, বিশেষতঃ নরেন্দ্রের দিকে মুখ করিয়া হাসিমুখে মহা আনন্দে কথা কহিতেছেন। নিজের অবস্থা, নিজের চরিত্র, গল্পচ্ছলে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) — আমার এই অবস্থার পর কেবল ঈশ্বরের কথা শুনিবার জন্য ব্যাকুলতা হত। কোথায় ভাগবত, কোথায় অধ্যাত্ম, কোথায় মহাভারত খুঁজে বেড়াতাম। এঁড়েদার কৃষ্ণকিশোরের কাছে অধ্যাত্ম শুনতে যেতাম।
“কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বৃন্দাবনে গিছিল, সেখানে একদিন জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। কুয়ার কাছে গিয়ে দেখে, একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করাতে সে বললে, ‘আমি নীচ জাতি, আপনি ব্রাহ্মণ; কেমন করে আপনার জল তুলে দেব?’ কৃষ্ণকিশোর বললে, ‘তুই বল শিব। শিব শিব বললেই তুই শুদ্ধ হয়ে যাবি।’ সে ‘শিব’ ‘শিব’ বলে জল তুলে দিলে। অমন আচারী ব্রাহ্মণ সেই জল খেলে! কি বিশ্বাস!
“এঁড়েদার ঘাটে একটি সাধু এসেছিল। আমরা একদিন দেখতে যাব ভাবলুম। আমি কালীবাড়িতে হলধারীকে বললাম, কৃষ্ণকিশোর আর আমি সাধু দেখতে যাব। তুমি যাবে? হলধারী বললে, ‘একটা মাটির খাঁচা দেখতে গিয়ে কি হবে?’ হলধারী গীতা-বেদান্ত পড়ে কি না! তাই সাধুকে বললে ‘মাটির খাঁচা। কৃষ্ণকিশোরকে গিয়ে আমি ওই-কথা বললাম। সে মহা রেগে গেল। আর বললে, ‘কি! হলধারী এমন কথা বলেছে? যে ঈশ্বর চিন্তা করে, যে রাম চিন্তা করে, আর সেইজন্য সর্বত্যাগ করেছে, তার দেহ মাটির খাঁচা। সে জানে না যে, ভক্তের দেহ চিন্ময়।’ এত রাগ — কালীবাড়িতে ফুল তুলতে আসত, হলধারীর সঙ্গে দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিত! কথা কইবে না!
“আমায় বলেছিল, ‘পৈতেটা ফেললে কেন?’ যখন আমার এই অবস্থা হল, তখন আশ্বিনের ঝড়ের মতো একটা কি এসে কোথায় কি উড়িয়ে লয়ে গেল! আগেকার চিহ্ন কিছুই রইল না। হুঁশ নাই! কাপড় পড়ে যাচ্ছে, তা পৈতে থাকবে কেমন করে! আমি বললাম, ‘তোমার একবার উন্মাদ হয়, তাহলে তুমি বোঝ!’
তাই হল! তার নিজেরই উন্মাদ হল। তখন সে কেবল ‘ওঁ ওঁ’ বলত আর একঘরে চুপ করে বসে থাকত। সকলে মাথা গরম হয়েছে বলে কবিরাজ ডাকলে। নাটাগড়ের রাম কবিরাজ এল। কৃষ্ণকিশোর তাকে বললে, ‘ওগো, আমার রোগ আরাম কর, কিন্তু দেখো, যেন আমার ওঁকারটি আরাম করো না।’ (সকলের হাস্য)
“একদিন গিয়ে দেখি, বসে ভাবছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হয়েছে?’ বললে ‘টেক্সোয়ালা এসেছিল — তাই ভাবছি। বলেছে টাকা না দিলে ঘটি-বাটি বেচে লবে।’ আমি বললাম, কি হবে ভেবে? না হয় ঘটি-বাটি লয়ে যাবে। যদি বেঁধে লয়ে যায় তোমাকে তো লয়ে যেতে পারবে না। তুমি তো ‘খ’ গো! (নরেন্দ্রাদির হাস্য) কৃষ্ণকিশোর বলত, আমি আকাশবৎ। অধ্যাত্ম পড়ত কিনা। মাঝে মাঝে ‘তুমি খ’ বলে, ঠাট্টা করতাম। হেসে বললাম, ‘তুমি খ’; টেক্স তোমাকে তো টানতে পারবে না।
“উন্মাদ অবস্থায় লোককে ঠিক ঠিক কথা, হক কথা, বলতুম! কারুকে মানতাম না। বড়লোক দেখলে ভয় হত না।
“যদু মল্লিকের বাগানে যতীন্দ্র এসেছিল। আমিও সেখানে ছিলাম। অমি তাকে বললাম, কর্তব্য কি? ইশ্বরচিন্তা করাই আমাদের কর্তব্য কি না? যতীন্দ্র বললে, ‘আমরা সংসারী লোক। আমাদের কি আর মুক্তি আছে! রাজা যুধিষ্ঠিরই নরক দর্শন করেছিলেন!’ তখন আমার বড় রাগ হল। বললাম, ‘তুমি কিরকম লোক গা! যুধিষ্ঠিরের কেবল নরকদর্শনই মনে করে রেখেছ? যুধিষ্ঠিরের সত্যকথা, ক্ষমা, ধৈর্য, বিবেক, বৈরাগ্য, ঈশ্বরের ভক্তি — এ-সব কিছু মনে হয় না। আরও কত কি বলতে যাচ্ছিলাম। হৃদে আমার মুখ চেপে ধরলে। যতীন্দ্র একটু পরেই ‘আমার একটু কাজ আছে’ বলে চলে গেল।
“অনেকদিন পরে কাপ্তেনের সঙ্গে সৌরীন্দ্র ঠাকুরের বাড়ি গিছলাম। তাকে দেখে বললাম, ‘তোমাকে রাজা-টাজা বলতে পারব না, কেননা, সেটা মিথ্যাকথা হবে।’ আমার সঙ্গে খানিকটা কথা কইলে। তারপর দেখলাম, সাহেব-টাহেব আনাগোনা করতে লাগল। রজোগুণী লোক, নানা কাজ লয়ে আছে। যতীন্দ্রকে খবর পাঠানো হল। সে বলে পাঠালে, ‘আমার গলায় বেদনা হয়েছে।
“সেই উন্মাদ অবস্থায় একদিন বরানগরের ঘাটে দেখলাম, জয় মুখুজ্জে জপ করছে, কিন্তু অন্যমনস্ক! তখন কাছে গিয়ে দুই চাপড় দিলাম!
“একদিন রাসমণি ঠাকুরবাড়িতে এসেছে। কালীঘরে এল। পূজার সময় আসত আর দুই-একটা গান গাইতে বলত। গান গাচ্ছি, দেখি যে অন্যমনস্ক হয়ে ফুল বাচ্ছে। অমনি দুই চাপড়। তখন ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাতজোড় করে রইল।
“হলধারীকে বললাম, দাদা এ কি স্বভাব হল! কি উপায় করি, তখন মাকে ডাকতে ডাকতে ও-স্বভাব গেল।”
[মথুরের সঙ্গে তীর্থ ১৮৬৮ — কাশীতে বিষয় কথা শ্রবণে ঠাকুরের রোদন ]
“ওই অবস্থায় ঈশ্বরকথা বই আর কিছু ভাল লাগে না। বিষয়ের কথা হচ্ছে শুনলে বসে বসে কাঁদতাম। মথুরবাবু যখন সঙ্গে করে তীর্থ লয়ে গেল, তখন কাশীতে রাজাবাবুর বাড়িতে কয়দিন আমরা ছিলাম। মথুরবাবুর সঙ্গে বৈঠকখানায় বসে আছি, রাজাবাবুরাও বসে আছে। দেখি তারা বিষয়ের কথা কইছে। এত টাকা লোকসান হয়েছে — এই সব কথা। আমি কাঁদতে লাগলাম, বললাম, ‘মা, কোথায় আনলে! আমি যে রাসমণির মন্দিরে খুব ভাল ছিলাম, তীর্থ করতে এসেও সেই কামিনী-কাঞ্চনের কথা। কিন্তু সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) তো বিষয়ের কথা শুনতে হয় নাই।”
ঠাকুর ভক্তদের, বিশেষতঃ নরেন্দ্রকে, একটু বিশ্রাম করিতে বলিলেন। নিজেও ছোট খাটটিতে একটু বিশ্রাম করিতে গেলেন।
ঠাকুর মণির সহিত আবার কথা কহিতেছেন।
[সাকার না নিরাকার — চিন্ময়ী মূর্তি ধ্যান — মাতৃধ্যান ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার আজকাল ঈশ্বরচিন্তা কিরূপ হচ্ছে? তোমার সাকার ভাল লাগে — না নিরাকার?
মণি — আজ্ঞা, সাকারে এখন মন যায়ে না। আবার নিরাকারে কিন্তু মন স্থির করতে পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখলে? নিরাকারে একেবারে মন স্থির হয় না। প্রথম প্রথম সাকার তো বেশ।
মণি — মাটির এই সব মূর্তি চিন্তা করা?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? চিন্ময়ী মূর্তি।
মণি — আজ্ঞা, তাহলেও তো হাত-পা ভাবতে হবে? কিন্তু এও ভাবছি যে, প্রথমাবস্থায় রূপ চিন্তা না করলে মন স্থির হবে না — আপনি বলে দিয়েছেন। আচ্ছা, তিনি তো নানারূপ ধরতে পারেন। নিজের মার রূপ কি ধ্যান করতে পারা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ তিনি (মা) গুরু — আর ব্রহ্মময়ী স্বরূপা।
মণি চুপ করিয়া আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে আবার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন —
মণি — আজ্ঞা, নিরাকারে কিরকম দেখা যায়? — ও কি বর্ণনা করা যায় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটু চিন্তা করিয়া) — ও কিরূপ জানো? —
এই কথা বলিয়া ঠাকুর একটু চুপ করিলেন। তৎপরে সাকার-নিরাকার দর্শন কিরূপ অনুভূতি হয়, একটি কথা বলিয়া দিলেন। আবার ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, এটি ঠিক বুঝতে সাধন চাই। ঘরের ভিতরের রত্ন যদি দেখতে চাও, আর নিতে চাও, তাহলে পরিশ্রম করে চাবি এনে দরজার তালা খুলতে হয়। তারপর রত্ন বার করে আনতে হয়। তা না হলে তালা দেওয়া ঘর — দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছি, “ওই আমি দরজা খুললুম, সিন্দুকের তালা ভাঙলুম — ওই রত্ন বার করলুম।” শুধু দাঁড়িয়ে ভাবলে তো হয় না। সাধন করা চাই।
আজ বিজয়া, রবিবার, ২২শে অক্টোবর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, আশ্বিন শুক্লা দশমী তিথি (৬ই কার্তিক, ১২৮৯)। আজকাল রাখাল ঠাকুরের কাছে আছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ মাঝে মাঝে যাতায়াত করেন। ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত রামলাল ও হাজরা মহাশয় বাস করিতেছেন। রাম, মনোমহন, সুরেশ, মাস্টার, বলরাম ইঁহারাও প্রায় প্রতি সপ্তাহে — ঠাকুরকে দর্শন করিয়া যান। বাবুরাম সবে দু-একবার দর্শন করিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার পূজার ছুটি হয়েছে?
মণি — আজ্ঞা হাঁ। আমি সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজার দিনে কেশব সেনের বাড়িতে প্রত্যহ গিছলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বল কি গো!
মণি — দুর্গাপূজার বেশ ব্যাখ্যা শুনেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল দেখি।
মণি — কেশব সেনের বাড়িতে রোজ সকালে উপাসনা হয়, — দশটা-এগারটা পর্যন্ত। সেই উপাসনার সময় তিনি দুর্গাপূজার ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বললেন, যদি মাকে পাওয়া যায় — যদি মা-দুর্গাকে কেউ হৃদয়মন্দিরে আনতে পারে — তাহলে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, আপনি আসেন। লক্ষ্মী অর্থাৎ ঐশ্বর্য, সরস্বতী অর্থাৎ জ্ঞান, কার্তিক অর্থাৎ বিক্রম, গণেশ অর্থাৎ সিদ্ধি — এ-সব আপনি হয়ে যায় — মা যদি আসেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নরেনদ্রাদি অন্তরঙ্গ ]
শ্রীযুক্ত ঠাকুর সকল বিবরণ শুনিলেন ও মাঝে মাঝে কেশবের উপাসনা সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। অবশেষে বলিতেছেন, তুমি এখানে ওখানে যেও না — এইখানেই আসবে।
“যারা অন্তরঙ্গ তারা কেবল এখানেই আসবে। নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল — এরা আমার অন্তরঙ্গ। এরা সামান্য নয়। তুমি এদের একদিন খাইও! নরেন্দ্রকে তোমার কিরূপ বোধ হয়?”
মণি — আজ্ঞা, খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, নরেন্দ্রের কত গুণ — গাইতে, বাজাতে, বিদ্যায়, আবার জিতেন্দ্রিয়, বলেছে বিয়ে করবে না — ছেলেবেলা থেকে ঈশ্বরেতে মন।
ঠাকুর মণির সহিত আবার কথা কহিতেছেন।
[সাকার না নিরাকার — চিন্ময়ী মূর্তি ধ্যান — মাতৃধ্যান ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার আজকাল ঈশ্বরচিন্তা কিরূপ হচ্ছে? তোমার সাকার ভাল লাগে — না নিরাকার?
মণি — আজ্ঞা, সাকারে এখন মন যায়ে না। আবার নিরাকারে কিন্তু মন স্থির করতে পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখলে? নিরাকারে একেবারে মন স্থির হয় না। প্রথম প্রথম সাকার তো বেশ।
মণি — মাটির এই সব মূর্তি চিন্তা করা?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? চিন্ময়ী মূর্তি।
মণি — আজ্ঞা, তাহলেও তো হাত-পা ভাবতে হবে? কিন্তু এও ভাবছি যে, প্রথমাবস্থায় রূপ চিন্তা না করলে মন স্থির হবে না — আপনি বলে দিয়েছেন। আচ্ছা, তিনি তো নানারূপ ধরতে পারেন। নিজের মার রূপ কি ধ্যান করতে পারা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ তিনি (মা) গুরু — আর ব্রহ্মময়ী স্বরূপা।
মণি চুপ করিয়া আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে আবার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন —
মণি — আজ্ঞা, নিরাকারে কিরকম দেখা যায়? — ও কি বর্ণনা করা যায় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটু চিন্তা করিয়া) — ও কিরূপ জানো? —
এই কথা বলিয়া ঠাকুর একটু চুপ করিলেন। তৎপরে সাকার-নিরাকার দর্শন কিরূপ অনুভূতি হয়, একটি কথা বলিয়া দিলেন। আবার ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, এটি ঠিক বুঝতে সাধন চাই। ঘরের ভিতরের রত্ন যদি দেখতে চাও, আর নিতে চাও, তাহলে পরিশ্রম করে চাবি এনে দরজার তালা খুলতে হয়। তারপর রত্ন বার করে আনতে হয়। তা না হলে তালা দেওয়া ঘর — দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছি, “ওই আমি দরজা খুললুম, সিন্দুকের তালা ভাঙলুম — ওই রত্ন বার করলুম।” শুধু দাঁড়িয়ে ভাবলে তো হয় না। সাধন করা চাই।
আজ বিজয়া, রবিবার, ২২শে অক্টোবর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, আশ্বিন শুক্লা দশমী তিথি (৬ই কার্তিক, ১২৮৯)। আজকাল রাখাল ঠাকুরের কাছে আছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ মাঝে মাঝে যাতায়াত করেন। ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত রামলাল ও হাজরা মহাশয় বাস করিতেছেন। রাম, মনোমহন, সুরেশ, মাস্টার, বলরাম ইঁহারাও প্রায় প্রতি সপ্তাহে — ঠাকুরকে দর্শন করিয়া যান। বাবুরাম সবে দু-একবার দর্শন করিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার পূজার ছুটি হয়েছে?
মণি — আজ্ঞা হাঁ। আমি সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজার দিনে কেশব সেনের বাড়িতে প্রত্যহ গিছলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বল কি গো!
মণি — দুর্গাপূজার বেশ ব্যাখ্যা শুনেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল দেখি।
মণি — কেশব সেনের বাড়িতে রোজ সকালে উপাসনা হয়, — দশটা-এগারটা পর্যন্ত। সেই উপাসনার সময় তিনি দুর্গাপূজার ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বললেন, যদি মাকে পাওয়া যায় — যদি মা-দুর্গাকে কেউ হৃদয়মন্দিরে আনতে পারে — তাহলে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, আপনি আসেন। লক্ষ্মী অর্থাৎ ঐশ্বর্য, সরস্বতী অর্থাৎ জ্ঞান, কার্তিক অর্থাৎ বিক্রম, গণেশ অর্থাৎ সিদ্ধি — এ-সব আপনি হয়ে যায় — মা যদি আসেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নরেনদ্রাদি অন্তরঙ্গ ]
শ্রীযুক্ত ঠাকুর সকল বিবরণ শুনিলেন ও মাঝে মাঝে কেশবের উপাসনা সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। অবশেষে বলিতেছেন, তুমি এখানে ওখানে যেও না — এইখানেই আসবে।
“যারা অন্তরঙ্গ তারা কেবল এখানেই আসবে। নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল — এরা আমার অন্তরঙ্গ। এরা সামান্য নয়। তুমি এদের একদিন খাইও! নরেন্দ্রকে তোমার কিরূপ বোধ হয়?”
মণি — আজ্ঞা, খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ, নরেন্দ্রের কত গুণ — গাইতে, বাজাতে, বিদ্যায়, আবার জিতেন্দ্রিয়, বলেছে বিয়ে করবে না — ছেলেবেলা থেকে ঈশ্বরেতে মন।
ঠাকুর মণির সহিত আবার কথা কহিতেছেন।
[সাকার না নিরাকার — চিন্ময়ী মূর্তি ধ্যান — মাতৃধ্যান ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার আজকাল ঈশ্বরচিন্তা কিরূপ হচ্ছে? তোমার সাকার ভাল লাগে — না নিরাকার?
মণি — আজ্ঞা, সাকারে এখন মন যায়ে না। আবার নিরাকারে কিন্তু মন স্থির করতে পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখলে? নিরাকারে একেবারে মন স্থির হয় না। প্রথম প্রথম সাকার তো বেশ।
মণি — মাটির এই সব মূর্তি চিন্তা করা?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? চিন্ময়ী মূর্তি।
মণি — আজ্ঞা, তাহলেও তো হাত-পা ভাবতে হবে? কিন্তু এও ভাবছি যে, প্রথমাবস্থায় রূপ চিন্তা না করলে মন স্থির হবে না — আপনি বলে দিয়েছেন। আচ্ছা, তিনি তো নানারূপ ধরতে পারেন। নিজের মার রূপ কি ধ্যান করতে পারা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ তিনি (মা) গুরু — আর ব্রহ্মময়ী স্বরূপা।
মণি চুপ করিয়া আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে আবার ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন —
মণি — আজ্ঞা, নিরাকারে কিরকম দেখা যায়? — ও কি বর্ণনা করা যায় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটু চিন্তা করিয়া) — ও কিরূপ জানো? —
এই কথা বলিয়া ঠাকুর একটু চুপ করিলেন। তৎপরে সাকার-নিরাকার দর্শন কিরূপ অনুভূতি হয়, একটি কথা বলিয়া দিলেন। আবার ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি জানো, এটি ঠিক বুঝতে সাধন চাই। ঘরের ভিতরের রত্ন যদি দেখতে চাও, আর নিতে চাও, তাহলে পরিশ্রম করে চাবি এনে দরজার তালা খুলতে হয়। তারপর রত্ন বার করে আনতে হয়। তা না হলে তালা দেওয়া ঘর — দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছি, “ওই আমি দরজা খুললুম, সিন্দুকের তালা ভাঙলুম — ওই রত্ন বার করলুম।” শুধু দাঁড়িয়ে ভাবলে তো হয় না। সাধন করা চাই।