অবতারের অবতরণ

 


পুত্রদের নামকরণ অনুষ্ঠান বা ছয়ষষ্ঠীর আয়োজন করলেন রাজা দশরথ । সেই উৎসব কে কেন্দ্র করে আবার এক মহা আয়োজন চলল। রাজা দশরথ কুলগুরু বশিষ্ঠ মুনিকে আমন্ত্রণ করে স্বাগত জানিয়ে করজোড়ে বললেন- “হে মুনিবর ! বলুন কি নাম রাখা যায় ?” মুনি বললেন- “ হে রাজন ! এঁদের অনেক সুন্দর অনুপম নাম আছে । তবুও আমি বিচার অনুসারে বলছি । আপনার পুত্রেরা সুখ রাশি সম্পন্ন ও আনন্দসাগর । এই সাগরের একবিন্দু সংসারকে সুখ দান করতে সক্ষম । সুখধাম ও বিশ্ব চরাচরের শান্তিদাতা আপনার জেষ্ঠপুত্র কৌশল্যা নন্দনের নাম হবে ‘রাম’। জগতের ভরন পোষণ কারী আপনার দ্বিতীয় পুত্র তথা কৈকয়ীর সন্তানের নাম ভরত । আর সর্ব সুলক্ষণ যুক্ত রামের প্রিয় যিনি , যিনি মস্তকে পৃথিবীর ভার বহন করে আছেন সুমিত্রার সেই পুত্রের নাম হবে লক্ষণ । আর যাঁকে স্মরণ করলে সর্ব শত্রু নাশ হয়, সুমিত্রার অপর পুত্রের নাম হবে শত্রুঘ্ন । ( রামচরিতমানস )


বাল্যকাল থেকেই সুমিত্রা নন্দন লক্ষণ , ভগবান রামের যেনো ছায়া ছিলেন। সর্বদা অগ্রজের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন । অপরদিকে ভরতের ছায়া ছিলেন সুমিত্রার অপর পুত্র শত্রুঘ্ন । অবশ্য চার ভ্রাতার মধ্যে ভাতৃত্ব বন্ধন ছিলো সুনিবিড় । রাজা দশরথের গৃহে বড় হতে লাগলেন চার ভাই । শ্রীরাম কে দেখে সকলেই মোহিত হতেন । তিনি হামাগুড়ি দিয়ে চলতেন , কোমোরে বন্ধনী , চরণের নূপুর ঝুমঝুম করে বাজতো । মাতা কৌশল্যা পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য প্রদান করতেন । কৈকয়ী নিজেও রামকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন । মন্থরা এসকল দেখে কৈকয়ীকে সর্বদা গাল মন্দ করে কুবুদ্ধি প্রদান করতো। কৈকয়ী এসকল এড়িয়ে চলতেন । কৌশল্যা দেবী সহ রাজবাড়ীতে দাস দাসীরা অদ্ভুদ দর্শন পেতেন । কখনো দেখতেন বালক রাম যেখানে যেখানে হাত পা ফেলছেন সেখানেই পদ্ম ফুটে উঠছে। কিংবা দেখতেন বালক রাম চন্দ্রের চরণ ছাপে ধ্বজা, পতাকা, চক্র, শঙ্খ আদি চিহ্ন । তাঁরা ভয় পেতেন । সন্ত তুলসী দাস গোস্বামী লিখেছেন- “তাঁর নীলকমল ( সদৃশ ) নবনীরদ ঘনশ্যাম তনুতে ছিল কোটি কামদেবের সৌন্দর্য । অরুনাভ শ্রীপাদপদ্মের নখের জ্যোতি দেখে মনে হচ্ছিল্ল রক্তকমল পত্র দলের উপর মুক্তা বিরাজিত । চরণ বজ্র, ধ্বজ, অঙ্কুশ চিহ্ন শোভিত ছিলো ।


তাঁর নূপুরের রুনুঝুনু মুনি মনকে মোহিত করেছিলো। তাঁর কটিতে ছিল কিঙ্কিনি আর উদরে ছিলো ত্রিবলী রেখা । সুবিশাল বাহু যুগল ছিল অতিশয় সুন্দর ; তাতে বিভিন্ন কর ভূষণ থাকাতে তা আরো সুন্দর লাগছিল । বুকে ব্যঘ্র নখের দ্যুতি ছিল । কণ্ঠে ছিল রত্নখচিত মণি হার । বক্ষে ভৃগু পদচিহ্ন দর্শন করলেই মন মুগ্ধ হয়ে যায় । তিনি ত্রিরেখাযুক্ত কম্বু কণ্ঠ সুশোভন চিবুকবিশিষ্ট । বদনে অসংখ্য অধরের মধ্যে দুটি অনুপম শোভা, নাসিকা গঠন সুচারু । মাতা কৌশল্যা শিশু রামকে নানা সাজে সজ্জিত করতেন ।”


ভগবান রাম ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল্লেন দশরথ রাজার গৃহে । হামাগুড়ি ছেড়ে ভগবান রাম ধীরে ধীরে হাঁটা শিখলেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেমন তাঁর মুখে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন মাতা যশোদাকে, তেমনি তুলসীদাস গোস্বামী মহারাজ একটি তেমন কাণ্ডের উল্লেখ করেছেন । একদা কৌশল্যা দেবী শ্রী সূর্য নারায়ণকে ভোগ নিবেদন করে এসে দেখেন তাঁর আদরের রাম দোলনাতে শয়ন করে মৃদু মৃদু হাসছে । ভগবান রামের সেই অনুপম হাসিতে ত্রিভুবন মোহিত হয়ে যায় । পুনঃ কৌশল্যা দেবী ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন শিশু রাম সেই নারায়ণকে প্রদত্ত নৈবদ্য সেবা নিচ্ছেন । এই দৃশ্য দেখে রানী ভয় পেয়ে এসে দেখেন শিশু রাম আগের মতোই দোলনাতে শয়ন করে হাস্য করছেন, পুনঃ ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন শিশু রাম সেই নৈবদ্য খাচ্ছেন । বার কয়েক এই দৃশ্য দেখে রাণী ভয় পান। তখন শ্রীরাম , রাণীকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করান । পুনঃ যোগমায়া শক্তি অবলম্বনে কৌশল্যার সেই স্মৃতি বিলুপ্ত করেন । মাতা কৌশল্যা শিশু রামকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য, স্তন্য দুগ্ধ প্রদান করেন । শিশুরা যেমন মায়ের ক্রোড়ে অবস্থান করেন, মা তাহাদের চন্দ্র দর্শন করে ঘুমপাড়ানি সঙ্গীত গুনগুন করে গেয়ে চলেন, তেমনি মাতা কৌশল্যা শিশু রামকে নিয়ে সেই চন্দ্র দর্শন করাতেন । শিশু রামকে দেখে রোহিনীপতি নিশানাথ প্রনাম জানিয়ে চন্দ্রালোকের মাধ্যমে ভগবানের চরণ স্পর্শ করতেন । একটু একটু করে চার ভ্রাতা হাঁটা শিখছিলেন । রাজা দশরথের হাত ধরে শিশু রামচন্দ্র হাঁটছেন, আবার পড়ে যাচ্ছেন। রাজা এসে রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে তাঁর ক্রন্দন সামলাচ্ছেন । পদ্ম পুস্পের ন্যায় রামচন্দ্রের নয়ন থেকে মুক্তাধারার মতো পতিত অশ্রুবিন্দু রাজা দশরথ মুছিয়ে পুত্রকে স্নেহে চুম্বন করছেন । সন্ত তুলসী দাস গোস্বামী সুন্দর একটি ভজন গেয়েছেন-


ঠুমকি চলত রামচন্দ্র বাজত পৈঁজানিয়াঁ ।

কিলকিলাই উঠত ধায়, গিরত ভূমি লটপটায় ;

ধায়ী মাতু গোদ লেত দশরথকী রানিয়াঁ ।

তুলসীদাস অতি আনন্দ হেরত মুখারবিন্দ ;

রঘুবরকী ছবি সমান রঘুবর ছবি বাণিয়াঁ ।।

অঙ্গ রজঃ অঙ্গলাই, বিবিধ ভাঁতি সোঁ দুলার ।

তন মন ধন বার বার কহত মৃদু বাণিয়াঁ ।।


শ্রীরামচন্দ্র অল্প অল্প হাঁটা শিখছেন । তাঁর চরণের মল, কোমোরের বন্ধনী বেজে উঠতো। হাঁটা শিখতে শিখতে বাচ্চা পড়ে যায়। সেই মতো রামচন্দ্র পড়ে গেলে , দশরথের তিন রাণী ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসতেন । কে আগে ক্রোড়ে নেবে , তাঁর জন্যই এই ছুটে আসা, ব্যাকুলতা । প্রথম স্নেহ কৈকয়ী দিতেন ।


চার ভ্রাতার দন্ত দেখা দিলো। শিশু রামের হালকা রক্তাভ অধর দ্বয়ের মধ্যে মুক্তা বিন্দুর মতো দন্ত দেখা দিলো । অতএব অন্নপ্রাশন প্রয়োজন । অযোধ্যা রাজ্যে চার ভ্রাতার অন্নপ্রাশন হল । কুলগুরু বশিষ্ঠ ও অনেক মুনি ঋষি শিষ্য সমেত পদার্পণ করলেন । যজ্ঞাদি, পূজা, দান , বিতরণ, বিশাল ভোজের ব্যবস্থা করা হল। কুলগুরু সূর্যনারায়নের পূজা করে চার ভ্রাতার মুখে অন্ন দিলেন । রাজার হস্ত থেকে অন্ন নিলেন রামচন্দ্র । এভাবে অন্নপ্রাশন সমাপ্ত হল । শিশু রামকে দেখতে ভীর উপচে পড়লো । মাতা কৌশল্যা বিবিধ খাদ্য- ক্ষীর, নবনী, মাখন, সর, দুগ্ধ , দধি , লাড্ডু, মোদক বিবিধ মিষ্টান্ন শ্রীরামের মুখে দিতেন । রাণী কৈকয়ী মাঝে মাঝে ভরত কে বিস্মৃত হয়ে রামচন্দ্রকে অনেক আদর বাৎসল্য প্রদান করতেন । কৈকয়ীর দাসী মন্থরা এসব দেখে হিংসায় জ্বলতে লাগলো ।

ভগবান তো এসেছেন। কিন্তু তাঁর শক্তি আসবেন এই অবতারে। ভগবান যখন অবতীর্ণ হন, শক্তিও আসেন। শক্তি বিনা পুরুষ জড়, শব । বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখিত হয়েছে – 


এবং যথা জগৎস্বামী দেবদেবো জনার্দনঃ ।

অবতারং করোতোষা তথা শ্রীস্তৎসহায়িনী ।।

... ... ... ...

রাঘবত্বেহভবৎ সীতা রুক্মিণী কৃষ্ণজন্মনি ।

অন্যেষু চাবতারেষু বিষ্ণোরেষা সহায়িনী ।।

দেবত্বে দেবদেহেয়ং মনুষ্যত্বে চ মানুষী ।

বিষ্ণোর্দেহানুরূপাং বৈ করোত্যেষাত্মনস্তনুম্ ।।


( বিষ্ণুপুরাণ- ১/৯/১৪০, ১৪২-৪৩ )


অর্থাৎ জগৎস্বামী দেবদেব জনার্দন যেমন অবতীর্ণ হন , তাঁর সহায়িনী লক্ষ্মীদেবীও সেইরূপই অবতীর্ণা হন। ... রামাবতারে ইনি সীতা এবং কৃষ্ণাবতারে রুক্মিণী হয়েছিলেন ; অনান্য অবতারেও ইনি বিষ্ণুর সহায়কারিণী । বিষ্ণু যখন দেবরূপে অবতীর্ণ হন তখন ইনি দেবী হন, বিষ্ণু মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হলে ইনি মানবী হন- প্রতি অবতারে বিষ্ণুর দেহের অনুরূপ দেহই পরিগ্রহ করেন । 


একবার মিথিলা রাজ্যে অকাল মহামারী দেখা দিয়েছিলো। ফসল নষ্ট হল। নদী নালা শুকিয়ে কাঠ। চারপাশে খালি দুর্ভিক্ষ আর পশু পক্ষী মানুষের মৃতদেহ- এমন অবস্থা । গাছপালা শুকিয়ে মিথিলা রাজ্য মরুভূমি হল। মিথিলা রাজ্য বর্তমান বিহার আর নেপালের কিছু অংশ নিয়ে ছিল । মিথিলার রাজা জনক মহাচিন্তায় পড়ে কুলগুরু মহর্ষি শতানন্দের শরণাপন্ন হলেন । মহর্ষি বললেন- “রাজন ! দেবী লক্ষ্মী সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্যের দেবী। তিনি তুষ্টা হলে রাজ্যে অনাচার দূর হয়ে শ্রীবৃদ্ধি পাবে। অতএব তুমি মাতা লক্ষ্মীর উপাসনা কর।” রাজা জনক তাই করলেন । মা লক্ষ্মীর শরণ নিয়ে তপ করতে লাগলেন । দেবী হরিপ্রিয়া সেই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে রাজা জনক কে দর্শন দিলেন । রাজা জনক দেবী লক্ষ্মীর অপূর্ব মূর্তি দর্শন করলেন। দেবী কমলা চতুর্ভুজা , হস্তে মঙ্গল কলস, উপরের দুহস্তে পদ্মপুস্প, নীচের এক হস্তে তিনি ঐশ্বর্য প্রদান করছেন, আর এক হস্তে কলস । মস্তকে চারটি হিমালয়ের চূড়া সদৃশ শ্বেত গজ মঙ্গল কলস এর সলিল দ্বারা দেবী ক্ষীরোদার অভিষেক করছেন । সকল প্রকার শ্রীযুক্ত পদ্মাসীনা সেই দেবী অভয় দিয়ে বললেন- “পিতা ! আমি আপনারই কন্যা রূপে আবির্ভূতা হব । আমার আগমনে এই রাজ্য সুজলা সুফলা ধনধান্যে ভরে উঠবে । আপনি শীঘ্রই ভূমি কর্ষণ উৎসবের আয়োজন করুন। সেই উৎসবে আপনি আমাকে প্রাপ্ত করবেন।” 


রাজা জনক তাই করলেন ভূমি কর্ষণ উৎসব আরম্ভ করলেন । বৈশাখের শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে মঙ্গলবার পুষ্যা নক্ষত্রে কন্যা রাশিতে ( মতান্তর আছে ) জনক রাজা প্রাপ্তি করলেন সীতা দেবীকে । সেই দিনটি “সীতানবমী” নামে পালিত হয় । মাতা সীতা বসুমতী কণ্যা রূপে অযোনিজা হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। মা লক্ষ্মীর আগমন হতেই মিথিলা রাজ্য সুখ সমৃদ্ধি ফসলে ভরে উঠলো, দুর্ভিক্ষ মহামারী দূর হল। উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ, মৃদঙ্গ পবিত্র বাদ্য বাজিয়ে রাজা জনক শিশু সীতাদেবীকে ঘরে নিয়ে গেলেন । হরিপ্রিয়া কমলা দেবীর আশীর্বাদ যার উপর থাকে সে রোগ, শোক, ব্যাধি, দারিদ্র মুক্ত হয় । তাই গানে বলা হয় –


এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী

থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে ঘরে

গাছে ভরা ফুল আর মাঠে ভরা ধান

দুধে ভাতে বেঁচে থাক মা তোমার সন্তান ।

দীপ জ্বলে শাখ বাঁজে মা তোমার আহ্বানে।

যে বা নারী পূজে তোমায় যেবা স্মরে 

তুমি মা তার দাও মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে । 


যাঁরা অর্থ, ধন, সম্পত্তি পেতে চান তাঁরা মা লক্ষ্মীর অর্চনা করতে পারেন। অর্থ, ধন বলতে কেবল টাকা পয়সা কে বোঝায় না। চারিত্রিক সম্পদ, পারমার্থিক সম্পদ দেবী লক্ষ্মী প্রদান করেন। তবুও যারা অর্থ সম্পদ পেতে চান- তারা সকালে উঠে ভূমিতে চরণ রাখার পূর্বে এই মন্ত্র উচ্চারন করুন – 


লক্ষ্মীঃ শ্রীঃ কমলা বিদ্যা মাতা বিষ্ণুপ্রিয়া সতী ।

পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী ।।

ভূতানামীশ্বরী নিত্যা মতা সত্যাগতা শুভা ।।

বিষ্ণুপত্নী মহাদেবী ক্ষীরোদতনয়া ক্ষমা ।।

অনন্তলোকলাভা চ ভূলীলা চ সুখপ্রদা ।

রুক্মিনী চ তথা সীতা মা বৈ বেদবতী শুভা ।

এতানি পুণ্যনামানি প্রাতরুত্থায় যঃ পঠেৎ ।

মহাশ্রিয়মবাপ্নোতি ধনধান্যমকল্মষম্ ।।


বঙ্গানুবাদ- শ্রী, কমলা বিদ্যা, মাতা, বিষ্ণুপ্রিয়া , সতী, পদ্মালয়া, পদ্মহস্তা, পদ্মাক্ষী , পদ্মসুন্দরী, ভূতগণের ঈশ্বরী, নিত্যা, সত্যাগতা , শুভা, বিষ্ণুপত্নী, ক্ষীরোদতনয়া, ক্ষমাস্বরূপা, অনন্তলোকলাভা , ভূলীলা, সুখপ্রদা, রুক্মিনী, সীতা, বেদবতী- দেবী লক্ষ্মীর এসকল নাম। প্রাতে উত্থান কালে যিনি দেবীর এই পুন্য নামাবলী পাঠ করেন, তিনি বিপুল ঐশ্বর্য ও নিস্পাপ ধনধান্য প্রাপ্ত হন ।


বালি আর সুগ্রীব এর ভাতৃপ্রেম সকলেই বিদিত ছিলেন । বালির স্ত্রীর নাম তারা, সুগ্রীবের স্ত্রীর নাম রুমা । বালি ইন্দ্র দেবতার বর পুত্র ছিলেন, সুগ্রীব সূর্য দেবতার বর পুত্র ছিলেন। দুন্দুভি রাক্ষস বধ বধ করার সময় তাঁর সহযোগী রাক্ষস মায়াবী পলায়ন করেছিলো । পুনঃ একদিন মায়াবী রাক্ষস কিস্কিন্ধ্যায় এসে মহা উপদ্রব সৃষ্টি করলো। বানর দের বধ করতে লাগলো । খবর পেয়ে বালি গদা হস্তে ভীষণ মূর্তি ধরে ছুটলো। পেছন পেছন সুগ্রীব ও কিছু বানর ছুটলো । মায়াবী রাক্ষস মায়াবিদ্যায় পটু ছিলো । কিন্তু বালির সাথে যুদ্ধে পেরে উঠছিলো না। বালির গদায় আহত হয়ে মায়াবী রক্তবমন করতে লাগল । মায়াবী যুদ্ধে হেরে আরবল্লী পর্বতের একটি গুহায় ঢুকল । বালি গদা হাতে সেই গুহায় ঢুকতে গেলে সুগ্রীব বাধা দিয়ে বলল- “অগ্রজ, পলায়মান শত্রুর ওপর আঘাত যুদ্ধ নিয়মের বিরোধী। আপনি ফিরে চলুন।” বালি সে কথায় কান না দিয়ে গুহার ভেতরে একা প্রবেশ করল । দুজনে এমন যুদ্ধ হল গুহার ভেতরে যে মনে হল গোটা পর্বত টাই ভেঙে পড়বে । দুজনের যুদ্ধে পর্বতে কম্পন সৃষ্টি হয়ে ধস নামল । গুহার মধ্যে থেকে রক্ত নদীর ধারা বের হল। মায়াবী গুহার ভেতরে বালির গলার নকল করে আর্তনাদ করতে লাগল। সুগ্রীব ভাবল বালি বুঝি সেই রাক্ষসের হাতে মারা পরেছে। এবার যদি সেই রাক্ষস বের হয়ে আসে তবে গোটা কিস্কিন্ধ্যা ধ্বংস করবে। এই ভেবে সুগ্রীব একটা বড় পাথর চাপা দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ করে রাজ্যে ফিরে এলো । 


রাজ্যে ফিরে সব বলতেই বালির পত্নী তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে শাখা পলা সিঁদুর বিসর্জন দিয়ে বিধবার বেশ ধরল । বালির দেহ আনাও সম্ভব না। দেহ আনতে হলে পাথর সড়িয়ে আনতে হবে, আর তাহলে সেই রাক্ষস পুনঃ এসে উৎপাত আরম্ভ করবে । বালির কুশপুতুল পুড়িয়ে অঙ্গদ সকল প্রকার ভাবে পিতৃ শ্রাদ্ধ পালন করল । ফাঁকা রাজ আসনে কে বসবে ? অঙ্গদ এখনও শিশু । সুগ্রীব রাজা হয়ে অঙ্গদকে যুবরাজ ঘোষিত করে রাজ্য চালাতে লাগল । বছর ভরে যুদ্ধ করার পর বালি সেই গুহার ভেতরে মায়াবীকে বধ করলো । বালির শরীরে এত বল ছিলো যে সে হাত দিয়ে পাথর সড়িয়ে গুহা থেকে বের হল। রাজ্যে ফিরে সুগ্রীবকে রাজার আসনে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল- “তুই ভাই নামে কলঙ্ক । আমি সেখানে যুদ্ধ করছিলাম, আর তুই রাজ্য পাবার লোভে আমাকে পাথর চাপা দিয়ে গুহা মুখ বন্ধ করে এসে রাজা হয়েছিস। কি ভেবেছিলি যে আমি ঐ বদ্ধ গুহায় মারা যাবো?” জীবিত দাদাকে দেখে সুগ্রীব এসে ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে বলল- “অগ্রজ । আপনাকে জীবিত দেখে আমি আনন্দিত হয়েছি। আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি ঐ রাক্ষসের হস্তে মারা গেছেন। যাতে ঐ রাক্ষস বের হতে না পারে সেই জন্য গুহা মুখ রুদ্ধ করেছিলাম।” বালি ত ঐ সকল কথা বিশ্বাস করলো না। উলটে বলল- “সুগ্রীব । যদি এতই তোর রাজা হবার ইচ্ছা তো আমাকে বলতিস তোকে এই রাজ্য দান করতাম । আমি স্বয়ং দশানন কে সাতবার জলে ডুবানোর ক্ষমতা রাখি । আর ঐ সামান্য রাক্ষস আমাকে বধ করবে? বেরিয়ে যা আমার রাজ্য হতে ।” বালি সুগ্রীবকে তাড়িয়ে দিল। সুগ্রীব গিয়ে ঋষমূক পর্বতে আশ্রয় নিলো । বালি সুগ্রীবের স্ত্রী রুমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো । রুমা রাজী হল না, বালি তখন রুমাকে কারাবন্দী করল । 


একদিনের কথা । ভগবান শিব একজন মাদারী ( বাদর খেলা যে দেখায় তাকে মাদারী বলে ) সেজে আর হনুমান কে এক বাঁদর সাজিয়ে অযোধ্যা তে গেলো । রামের ইষ্ট শিব আবার শিবের ইষ্ট রাম । অযোধ্যা নগরীতে নেমে ডুগডুগি বাজিয়ে শিব বাদর খেলা দেখাতে লাগলো । রাজবাটিটে বাঁদর নাচানো দেখাতে গেলেন স্বয়ং পশুপতি । চার ভ্রাতা সেই খেলা দেখে আনন্দিত হলেন । শিশু রাম , দশরথকে অনুরোধ জানালেন তাঁকে ঐ বাঁদর টি দিতে । দশরথ রাজা মাদারীকে বললেন- “কত মূল্যে তুমি বাঁদর টি দেবে ?” মাদারী রূপধারী হর জানালেন- “মহারাজ। এর কোনো মূল্য লাগবে না। খালি একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যেনো সারা জীবন আপনার পুত্র এই বাঁদর টিকে তাঁর সেবক রূপে রাখেন।” রামচন্দ্র বচন দিলেন। মাদারী রূপী শিব সেইখানে বাঁদর টি দিয়ে চলে গেলেন । চার ভ্রাতা যখন খেলা খেলতো তখন বাণর রূপী হনুমান তাঁদের সাথে খেলা করতেন । ভগবান রাম খুবুই স্নেহ করতেন হনুমানকে । আর হনুমান মহারাজ সর্বদা রামচন্দ্রের আগেপিছে ঘুরতেন। প্রভুর খেলা সামগ্রী যেমন কন্দু, ঘুড়ির লাটাই, তির ইত্যাদি এনে এনে দিতেন । গাছে উঠে সুগন্ধি পুস্প বা মিষ্ট ফল পেরে পেরে দিতেন । সুগ্রীবের অবস্থার কথা রামচন্দ্র যোগবলে জেনেছিলেন। তিনি হনুমানকে সুগ্রীবের কাছে ঋষমূক পর্বতে গিয়ে অবস্থান করতে বলেছিলেন। আর বলেছিলেন- যথা সময়ে আবার দেখা হবে ।

এভাবে অযোধ্যায় শ্রীরাম বয়োঃবৃদ্ধি পাচ্ছিলেন । তিনি নিত্য বাগানে খেলা করতেন । সখা দের সাথে ভ্রাতার সাথে মিলে কুল ধর্ম মেনে বনে গিয়ে মৃগয়া করতেন । সন্ত তুলসীদাস গোস্বামী লিখেছেন-


বন্ধু সখা সঁগ লেহিঁ বোলাঈ ।

বন মৃগয়া নিত খেলহিঁ জাঈ ।।

পাবন মৃগ মারহিঁ জিয়ঁ জানী ।

দিন প্রতি নৃপহি দেখাবহিঁ আনী ।।


অর্থাৎ- ভ্রাতা সখা পরিবৃত হয়ে শ্রীরামচন্দ্র নিত্য মৃগয়ায় যেতেন ( ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে ) । পূত মৃগ শিকার করতেন এবং তা এনে দশরথকে দেখাতেন । 


প্রাচীন কালে ক্ষত্রিয় গণ বনে গিয়ে মৃগয়া করতেন । এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে । এক আহার্য হিসাবে মৃগ মাংস সেই যুগে প্রসিদ্ধ ছিল এবং ক্ষত্রিয় গণ তা খেতেন । দ্বিতীয়ত মৃগ চর্ম পবিত্র আসন । এছাড়া শিকাড় করাকে বীরত্ব মানা হত । অবশ্য রামচন্দ্রের হাতে নিহত মৃগ অবশ্যই মুক্তি পেয়েছিলেন । অপরদিকে রাজা জনকের গৃহে সীতা দেবী বৃদ্ধি পেতে লাগলেন । রাজা জনকের রাজ্যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটলো । উপযুক্ত পরিমাণে বর্ষণ হল । মাঠগুলি সিক্ত হলে প্রজারা চাষাবাদ করে ধনধান্যে ফুলে উঠলেন । এসবই হয়েছে মাতা লক্ষ্মীর কৃপায়। তিনি নিজেই সীতা রূপে জনক রাজা ও সুনয়নার কোল আলো করে বড় হতে লাগলেন । সীতা দেবী ভগবতী উমামাতার ভক্ত ছিলেন । অপরদিকে রামচন্দ্র ছিলেন শিবভক্ত । রামচন্দ্রের মনোহর রূপ দেখে অযোধ্যার আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই মোহিত হয়ে রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতেন । এমনই ছিলো রামচন্দ্রের রূপ । পাঁচ বছর বয়স হতে রামচন্দ্রকে ভ্রাতাদের সহিত গুরু বশিষ্ঠের আশ্রমে বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠানো হল । বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে রামচন্দ্র ও তাঁহার ভ্রাতারা চতুর্বেদ , উপনিষদ, কাব্য, অলংকার, ব্যাকারন, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন বিদ্যা আদি সব শাস্ত্র শিখলেন । 


এরপর অস্ত্র বিদ্যা শুরু হল । প্রথমে মল্ল বিদ্যা শিখলেন। তারপর গদা, তরবারি, বর্শা, লাঠি, ছোড়া ইত্যাদি অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করলেন । এরপর মহর্ষি বশিষ্ঠ ধনুর্বিদ্যা দিলেন চার রাজকুমারকে । চার ভ্রাতাকে অনেক দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান দিলেন। এই অস্ত্র গুলি জগত ধ্বংস করবার শক্তি রাখে । রামচন্দ্রের তীব্র বেগে বাণ নিক্ষেপ, অব্যর্থ নিশানা দেখে দেবতাবৃন্দ আনন্দ প্রাপ্তি করেন । কারন এবার রাবণ অনায়েসে মরবে । একদিন মারীচ রাক্ষস মায়া দ্বারা হরিণ সেজে খোঁজ করতে আসেন । হরিণ রূপী মারীচ বনে ঘুরছিলো। সেসময় রাম লক্ষণ ধনুক হাতে বনে ঘুরছিলেন । মৃগ দেখে রামচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করেন । কৃত্তিবাস পণ্ডিত লেখেছেন- 


মৃগ দেখি রামের কৌতুক হৈল মন ।

ধনুকে অব্যর্থ বাণ যুড়িল তখন ।।

ছুটিল রামের বাণ তারা যেন খসে ।

মহাভীত মারীচ পলায় মহাত্রাসে ।।

শ্রীরামের বাণশব্দে ছাড়িল সে বন ।

জনকের দেশে গেল মিথিলা ভুবন ।। 


রামচন্দ্রের বাণে ভীত হয়ে মারীচ রাক্ষস অযোধ্যার সীমা ছেড়ে সোজা মিথিলায় পলায়ন করলো ।

বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে এভাবে বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করছিলেন শ্রীরাম । মুনি নানা অস্ত্র বিদ্যার জ্ঞান দিলেন শ্রীরামচন্দ্রকে । দেবতারা অতীব প্রীত হলেন রামচন্দ্রের বিদ্যাশিক্ষা দেখে । গুরুগৃহে থাকাকালীন শিক্ষা লাভের পাশাপাশি আশ্রমের কাজ কর্ম করতে হত । সেখানে রাজকুমার আর সাধারণ শিক্ষার্থীকে এক ভাবেই রাখা হত । রাজার তনয় বলে বিশেষ কোন ছাড় বা সুবিধা দেওয়া হত না । এই আশ্রম গুলিকে “গুরুকুল” বলে । এখানে গার্হস্থ আশ্রম, সংসার ধর্ম পালনের শিক্ষা দেওয়া হত । বর্তমানে স্কুল কলেজগুলিতে এর কানাকড়িও দেওয়া হয় না । তাই সমাজ অমানুষে ছেয়ে গেছে । তেমনি মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে থাকাকালীন রাম , ভরত, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন চার ভ্রাতাই অনান্য শিক্ষার্থীর মত আশ্রমের নিয়মাবলী পালন করতেন । ব্রাহ্ম মুহূর্তে উত্থান, যোগাসন প্রানায়াম, পূজা, বনে গিয়ে কাষ্ঠ পুস্প ফলমূলাদি সংগ্রহ, নদী থেকে জল ভরে আনা, গো পালন, গোসেবার জন্য তৃন সংগ্রহ , আশ্রম পরিষ্কার ইত্যাদি এমন কর্ম করতে হত । 


একদিন রাম লক্ষণ বনে গেছেন । অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা সমগ্র বনে ছেয়ে গিয়েছিল । হরিণ শিশুর ইতিউতি ভ্রমণ, বিবিধ পক্ষীর মধুর কলরব , সুগন্ধি পুস্পের ঘ্রান, তরুলতা গুলি সূর্যের আলো মেখে সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা বর্ধন করেছিল । রাম লক্ষণ এই মধুর দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গেলেন । দানার লোভে পক্ষী গুলি শ্রীরামচন্দ্রের আশেপাশে এসে বিচরণ করতে লাগলেন । নবদূর্বাদল কান্তিময় রামচন্দ্রের মধুর মনোহর রূপ দেখে ময়ূর গুলি কেকা রবে ডাকতে লাগলো , বৃক্ষ গুলি যেনো পুস্পের ডালি দিয়ে ভগবানের চলার পথ কোমল করে দিয়েছিলো । রাম ও লক্ষণ এইগুলি দেখে অতীব প্রীত হলেন । কিন্তু উভয়ের ক্ষুধা তৃষ্ণা পেলো । দেবলোকে ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মা সহিত ভগবানের বাল্যলীলা দেখে আনন্দ প্রাপ্তি করতে লাগলেন । উভয়ে যখন ক্লান্ত তখন রামচন্দ্র একটি আমলকী বৃক্ষ দেখতে পেলেন । ভগবান সেই বৃক্ষে আরোহণ করে আমলকী ফল পেরে এনে ভ্রাতা লক্ষণকে দিয়ে কিছু নিজে সেবা নিলেন । সম্মুখে তাঁরা এক দীঘি দেখতে পেলেন । টলটলে দীঘির জলে পদ্ম ফুটে আছে । ব্রহ্মার আদেশে ইন্দ্রদেবতা পদ্মের মৃণালে ‘সুধা’ সৃষ্টি করলেন । রাম লক্ষণ সেই জলে নেমে পদ্ম পুস্প আরোহণ করে মৃণালের সেই সুধা গ্রহণ করলেন । অতঃ দীঘির শীতল মিষ্টি জল পান করে বনে ফিরলেন । বৃক্ষের ছায়ায় কোমোল পাতার ওপর শয্যা রচনা করে উভয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন । পক্ষী গুলি মধুর কলরব করে যেনো তাহাদিগকে ঘুমপাড়ানি সঙ্গীত শ্রবন করাতে লাগলেন । ভ্রমরেরা গুনগুন করে সেই সঙ্গীতে সুরতাল দিল । 


এই অতীব সুন্দর লীলা দেখে স্বর্গের সুরেরা মর্তলোকে নেমে আসলেন । ইন্দ্রদেবতা দেখলেন গাছপালার মধ্যে মধ্যে সূর্য কিরণ এসে প্রভুর চোখে মুখে পড়ছে এবং তিনি তাতে বিরক্ত হচ্ছিল্লেন ঘুমের মধ্যে । এই দেখে ইন্দ্রদেবতা মেঘ দিয়ে আকাশে আচ্ছাদন করলেন। সমস্ত জায়গাতে সূর্যের কিরণ পৌছালেও প্রভুর উপরে কেবল মেঘের আচ্ছাদন থাকলো । অগ্নি দেবতা তাপ হরণ করে সেই স্থানকে শীতল মনোরম করলেন , পবন দেবতা মৃদু মৃদু বায়ু উৎপন্ন করে প্রভুকে বাতাস দিতে লাগলেন । বিবিধ কোমল, সুগন্ধি পুস্প কত জন্মের পুণ্যফলে তাঁরা এখানে পুস্প হয়ে ফুটেছিলো, তাঁরা শ্রীপ্রভুর অঙ্গে পতিত হতে লাগলো । বরুণ দেব সেই পুস্প গুলিতে শিশির বিন্দু সৃষ্টি করলেন যাতে গরমে প্রভুর নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটে । শিশিরসিক্ত পুস্প গুলি শ্রীরামের অঙ্গে পতিত হয়ে প্রভুকে গরমে শীতলতা প্রদান করছিল । এইভাবে দেবতাকূল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে সেবা করে নিজেদের ধন্য করলেন । অতঃ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হতে উভয়ে আশ্রমে ফিরে গেলেন । গিয়ে দেখলেন তাঁহাদের বিদ্যা সমাপনে রাজবাড়ী থেকে দশরথ , রাজা কৈকয়ী এসেছেন। রাণী কৈকয়ী তাহাদের না দেখে অতীব চিন্তায় ছিলেন । পুত্র রামচন্দ্রকে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য প্রদান করতে লাগলেন ।


বিদ্যা শিক্ষা সমাপন করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেন । রানীরা সাদর সমারোহে চার রাজকুমারকে বরণ করে নিলেন । শ্রীরামচন্দ্রের ধনুর্বিদ্যা দেখে সকলের তাক লেগে গেল । চোখের নিমিষে রামচন্দ্রের ধনুক থেকে বাণ ছুটে নিশানায় বিদ্ধ করে । রাজা দশরথ নিশ্চিন্ত হলেন । ভাবলেন অযোধ্যার যোগ্য উত্তরসূরি এসে গেছে । এবার আর চিন্তার কারণ নেই । ওদিকে তপোবনের কথা । তপবনে বিশ্বামিত্রর আশ্রমে রাক্ষসেরা রোজ হামলা চালাতো । তাড়কার ভয়ে অরন্য একেবারে জীবশূন্য হয়েছিলো। গাছগুলিও যেনো জড়বৎ হয়ে গিয়েছিলো। গাছে ফুল, ফল আসতো না। অরন্যের শোভা নষ্ট হয়ে জায়গায় জায়গায় কেবল অস্থি, খুলি ইত্যাদি দেখা যেতো। ভুলবশত এই বনে কেউ প্রবেশ করলে সে আর জীবিত ফিরতো না। সোজা রাক্ষসদের আহারের তালিকায় স্থান পেতো। সেই হাড় হিম অরণ্য ছিলো প্রাকৃতিক শোভা বর্জিত । কেবল রাক্ষসদের অট্টহাস্য শোনা যেতো । শিষ্যেরা বললেন- “হে গুরুদেব ! এই রাক্ষসের অত্যাচার কোনোকালেই কি স্তব্ধ হবে না ? আমরা কি চিরকাল যাগ যজ্ঞ করে দেবতাবৃন্দকে আহুতি প্রদানে ব্যর্থ হব? দেবর্ষি নারদ বলেছিলেন এই রাক্ষসদের বিনাশ করতে ভগবান হরি আসবেন!” বিশ্বামিত্র বললেন- “বোধ হয় এই রাক্ষসদের অন্তিম কাল উপস্থিত । ভগবান , দশরথ রাজার গৃহে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁহার শিক্ষা সমাপ্তি হয়েছে। আমি তাহাদিগকে আনিতে অযোধ্যায় যাবো।”


মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি অযোধ্যায় আসলেন । রাজা দশরথ এই সংবাদে ভীত হয়েছিলেন । তিনি জানতেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র পূর্বে তাঁর পূর্বপুরুষ হরিশ্চন্দ্র রাজার কাছে দানে সমগ্র রাজ্য নিয়েছিলেন। আবার কি তিনি এমন করবেন ? রাজা মুনিকে স্বাগত জানালেন । করজোড়ে রানী সহিত মুনিকে আপ্যায়ন করলেন । আসনে বসিয়ে মুনির পদযুগল সুগন্ধি বারি দ্বারা ধৌত করতো, স্বর্ণ উত্তরীয় দ্বারা মুনির পদযুগল মুছিয়ে দিলেন। অতঃ চামর, পাখা ব্যাঞ্জনাদি করে চন্দন অগুরু কর্পূর পুস্প দ্বারা, বিবিধ নৈবদ্য দ্বারা মুনির পূজা করে বলিলেন- “হে মহর্ষি আদেশ করুন, আমি আপনার কিরূপে সেবা করিতে পারি?” বিশ্বামিত্র রাক্ষসদের অত্যাচার কাহানী বলে বললেন- “হে রাজা দশরথ ! রাক্ষস বাহিনীর বধ প্রয়োজন । অন্যথায় তারা তপোবন ধ্বংস করে দেবে। আপনি রাম লক্ষণ কে প্রদান করুন। তাহারা রাক্ষস বধ করবেন।” শুনে দশরথ রাজা , রাণীদের প্রান শুকিয়ে গেল। দশরথ রাজার বুকে মহাভয় উপস্থিত হল। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন । মহর্ষির চরণ ধরে বললেন- “ মহর্ষি ! আপনি অন্য কিছু প্রার্থনা করুন। কিন্তু রাম লক্ষণকে কিভাবে দেবো ? তাহারা সদ্য কৈশোরে এসেছে । তাহারা কিভাবে সেই ভয়ানক মায়াবী রাক্ষসদের বধ করবে? আপনি চাইলে সমগ্র অযোধ্যা নগরী আপনার চরণে সমর্পণ করব, সমগ্র অযোধ্যার সেনা আপনার সহিত প্রেরন করবো, তাহারা গিয়ে সেই রাক্ষসের বধ করবে। আমি নিজে তাহাদিগকে বধ করবো- আপনি আদেশ করুন। কিন্তু প্রভু, রাম লক্ষণ এখনো বালক, তারা ঐ রাক্ষসদের বধ করা তো দূর, তাহাদের দেখেই হয়তো প্রাণত্যাগ করবে।” বিশ্বামিত্র বললেন- “রাজন। সেই রাক্ষস গণ আপনি বা অন্য কেউ কিংবা আমার হাতে বধ্য নয়। এমন হলে আমি নিজেই তাদের বধ করতাম। পূর্বে আমি ক্ষত্রিয় গাঁধিপুত্র ছিলাম। বহু অস্ত্রের জ্ঞাতা আমি। আপনার বা মিথিলা নরেশ জনকের সাহায্য চাইতে পারতাম। কিন্তু ওরা কেবল রাম- লক্ষণের হাতে বধ্য হবে।” 


রাজা তো নারাজ । কিন্তু শেষে রাম লক্ষণ এগিয়ে এলেন । পিতাকে সান্তনা দিলেন । বললেন- “পিতা। আপনার আশীর্বাদে আমরা সেই রাক্ষস বধ করতে পারবো। গুরুদেব বশিষ্ঠ মুনি আমাদের যে যুদ্ধবিদ্যা , অস্ত্রদান করেছেন- এখন সেইগুলির প্রয়োগের সময় এসেছে। তবেই তো জানবো যে আমাদের বিদ্যা শিক্ষা সফল হয়েছে । আপনি অমত করবেন না। সেই রাক্ষস কূল বিনষ্ট করে আমি আপনার নাম উজ্জ্বল করবো। প্রজা পালন ও দুষ্টের বিনাশ করা ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। আপনি অনুমতি প্রদান করুন।” রাজা ভয়ে দিশেহারা । মনে মনে অন্ধ মুনির প্রদত্ত শাপ মনে পড়লো। হয়তো রাম লক্ষণ আর বেঁচে ফিরবে না। রাক্ষসেরা তাদের বধ করে খাবে। আর সেই শোকে তাঁর মৃত্যু ঘটবে । অনেক মানা আপত্তি করতে লাগলেন রাজা দশরথ । মুনি বিশ্বামিত্র ক্রোধে বললেন- “দশরথ । তুমি আমার শক্তি সম্বন্ধে অবগত আছো । পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষ রাজা হরিশ্চন্দ্রকে যেরূপ সর্বস্বান্ত করেছিলাম, সেইরূপ শাপ দিয়ে তোমার নগরী ভস্ম করবো। অবশ্য রাক্ষসেরা বধ না হলে তারা এরপর তোমার রাজ্যে হানা দিয়ে তোমার রাজ্য ছারখার করবে। যদি তুমি এমন না চাও তাহলে রাম লক্ষণ কে প্রদান কর ।” রাজা দশরথ আর কি করেন ? দিয়ে দিলেন শ্রীরাম ও লক্ষণ কে। রাজা শোকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লেন । বিশ্বামিত্র মুনি তখন রাম লক্ষণ কে নিয়ে চললেন ।


বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে সাথে নিয়ে গেলেন বনে । তাড়কা সম্বন্ধে বলে মুনি বললেন- “রাম! তাড়কার দেহে ব্রহ্মার বরে সহস্র হস্তীর শক্তি আছে।” রামচন্দ্র জানালেন- “ হে ব্রহ্মর্ষি ! তাঁড়কা নারী। নারীর ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ কি প্রকারে করি ?” মহর্ষি বললেন- “নারী হোক বা পুরুষ, পাপ কর্মের ফল সকলকেই ভুগতে হয়। তাড়কা তার কৃতকর্মের ফল পাবেই।” মুনি রামচন্দ্র ও লক্ষণ কে নিয়ে তাড়কার বনে প্রবেশ করলো । হাড় হিম জঙ্গল সকল সৌন্দর্য হারিয়ে ভয়ঙ্কর চেহারা প্রাপ্তি করেছিল । বিকট দর্শন চামচিকা, এদিক ওদিক কেবল উড়ে বেড়াছিল্ল । চারপাশে অস্থি, কঙ্কালের খুলি গড়াগড়ি খাচ্ছে । এই জঙ্গলে তাড়কা যাকে পেতো তাকেই ভক্ষণ করত । মুনি বিশ্বামিত্র জানালেন “তোমরা সাবধানে চল। এই বনেই তাড়কা থাকে। সেই রাক্ষসী মহাবল ধরে।এছারা মায়াবিদ্যা জানে।” মানুষের গন্ধ পেয়ে তাড়কার নিদ্রাভঙ্গ হল। উদরের ক্ষুধা তীব্র হল। মনের আনন্দে সে আসতে লাগল। বড় বড় তাল, নারকেল, খেঁজুর , বাঁশবন দুলিয়ে এমন ভাবে আসতে লাগলো, যে দূর থেকেই দেখা গেল। মনে হচ্ছিল্ল যেনো এক বিশাল আলোরন জঙ্গল গুলোকে দোলা দিয়ে আসছে । অট্টহাস্য শোনা গেল তাড়কার । সামনে এসে সে রাম, লক্ষণ, মুনিকে দেখতে পেল। কচি বালক দেখে তাড়কার জিহ্বা দিয়ে জল ঝড়ে মাটিতে পড়ে পুকুর সৃষ্টি হল । বিশাল লম্বা চেহারা, স্থূল শরীর, মুখের দন্ত গুলি গজ হস্তীর নয়, হাতের নখ তীক্ষ্ণ তরবারির ন্যয় ছিলো রাক্ষসীর । চোখ দুটিতে আগুনের ভাটা জ্বলছিল । পা দুটি দেখে মনে হচ্ছিলো বিশাল আকৃতির স্থূল স্তম্ভের ন্যায়, স্তন্য মণ্ডল পর্বতের চূড়ার ন্যায়। রাক্ষসী কঙ্কাল, অস্থির মালা ধারন করেছিলো । 


রাক্ষসী অট্টহাস্য করে বলল- “প্রত্যহ কেবল মুনি ঋষিদের কৃশকায় শরীর ভক্ষণ করি। আজ বিধাতা আমার জন্য দুটি কোমল বালক প্রেরন করেছে। এদের খেয়ে মুখের স্বাদ পরিবর্তন করবো ।” শুনে রামচন্দ্র হাসতে লাগলেন । ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র বললেন- “রাম। সন্ধ্যা প্রায় সমাগত । তুমি শীঘ্র এর বধ কর। রাত্রে নিশাচর রাক্ষস রাক্ষসী দের শক্তি বৃদ্ধি পায়।” রামচন্দ্র তখন তাড়কাকে লক্ষ করে বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাড়কা মায়াবিদ্যা দ্বারা অদৃশ্য হয়ে শিলাবৃষ্টি সৃষ্টি করলো। রামচন্দ্র পবন বাণ নিক্ষেপ করে মেঘ সড়িয়ে দিলেন । তাড়কা তখন সামনে এসে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে লাগলো। তাড়কার নিঃশ্বাসে বনে প্রলয় ঝড় বইছিল । কখনো আগুনের হুল্কা নিক্ষেপ হচ্ছিল্ল। রামচন্দ্র বাণ দ্বারা তা প্রতিরোধ করলেন । এইভাবে যুদ্ধ চলতে লাগল। তাড়কা বড় বড় শাল, শিশু গাছ রাম লক্ষণের দিকে ছুড়তে লাগলো । রামচন্দ্র বাণ দ্বারা সেই সব গাছ খন্ড খণ্ড করতে লাগলেন । তাড়কা তখন পর্বতের চূড়ার ন্যায় বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড বর্ষণ করতে থাকলো। ভগবান রাম তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করে সেই প্রস্তর গুলি ধ্বংস করলেন । এরপর ভগবান রাম ধনুকে বজ্রবাণ আনয়ন করলেন। মন্ত্র পড়ে সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন । কানে তালা লাগানো বাজের শব্দ ও ঝলসে যাওয়া বজ্রপাত সৃষ্টি করে সেই বাণ তাড়কার বুকে বিদ্ধ হল । 


সেই বাণ তাড়কার প্রান হরণ করল । তাড়কা মহা আর্তনাদ করে ভূপতিত হল । রক্তধারা নদীর ন্যায় প্রবাহিত হল। তাড়কা যখন ভূপতিত হল – তখন বসুমতী প্রবল কেঁপে উঠলো । গাছপালা গুলো ভেঙ্গে চুড়ে তাড়কার পৃষ্ঠদেশের তলায় চূর্ণ হল । বিশালাকৃতি বট, অশ্বত্থ , আম্র, কৃষ্ণচূড়া ইত্যাদি মহীরুহ গুলো চূর্ণ হল। বিকট রাক্ষসীর দেহ বিশাল পর্বতের ন্যায় জঙ্গলে পড়লো । দূর থেকে তাঁকে দেখলে এক পর্বত রূপে ভ্রম হবে । দেবতারা প্রীত হলেন । তাড়কার সদ্গতি হল। তাঁর শাপমুক্তি হল । বিশ্বামিত্র মুনি আশীর্বাদ করতে লাগলেন। অতঃ তিনি সন্ধ্যা হতে রাম লক্ষণ কে নিয়ে আশ্রমে গেলেন । আশ্রমের শিষ্যরা রাম লক্ষণ কে আদর যত্ন আপ্যায়ন করল। বনের মিষ্ট ফল, কন্দ, মধু রাম লক্ষণ কে খেতে দিলেন । বিশ্বামিত্র মুনি বললেন- “বতস্য রাম। কাল আমি তোমাকে বলি ও অতিবলি বিদ্যা দান করবো। তোমাকে আরোও কিছু দিব্যাস্ত্র প্রদান করবো।” রামচন্দ্র বললেন- “মহর্ষি । আপনাকে আমি গুরু রূপে প্রাপ্তি করে ধন্য হব। আপনি তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মণ্যত্ব প্রাপ্তি করে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রহ্মর্ষি হয়েছেন । জগতের কাছে আদর্শ তৈরী করেছেন।” তাড়কার আতঙ্ক মিটলেও তাড়কার তিন কোটি ( কৃত্তিবাসী রামায়নে লেখা তাড়কার সাথে ৩ কোটি রাক্ষস থাকতো ) রাক্ষস মারীচ , সুবাহু জীবিত ছিলো ।


কর্মের বাপ্তি

হিন্দুশাস্ত্রমতে মানব-সাধারণের ধর্ম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিশেষ বিশেষ কর্তব্য আছে। হিন্দুকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছাত্ররূপে জীবন ...