(HARMONY OF ALL RELIGIONS)
নরেন্দ্র ও অন্যান্য কৃতবিদ্য যুবকগণ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সকল ধর্মের উপর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলেন। সকল ধর্মে সত্য আছে, এ-কথা পরমহংসদেব মুক্তকণ্ঠে বলিতেন। কিন্তু তিনি আরও বলিতেন, সকল ধর্মই সত্য — অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্ম দিয়া ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যাইতে পারে। একদিন, ২৭শে অক্টোবর (১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে) কেশবচন্দ্র সেন কোজাগর লক্ষ্মীপূজার দিন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে স্টীমারে করিয়া দেখিতে গিয়াছিলেন ও তাঁহাকে তুলিয়া লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। পথে জাহাজের উপরে অনেক বিষয়ে কথা হয়। ঠিক এই সকল কথা ১৩ই অগস্ট অর্থাৎ কয়েক মাস পূর্বে হইয়াছিল। এই সর্বধর্ম-সমন্বয় কথা আমাদের diary হইতে উদ্ধৃত করিলাম।
“কেদারনাথ চাটুজ্যে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে মহোৎসব করিয়াছিলেন। উৎসবান্তে দক্ষিণের বারান্দায় বসিয়া বেলা ৩।৪ টার সময় কথাবার্তা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — মত পথ। সকল ধর্মই সত্য। যেমন কালীঘাটে নানা পথ দিয়া যাওয়া যায়। ধর্ম কিছু ঈশ্বর নয়। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম আশ্রয় করে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়।
“নদী সব নানাদিক দিয়ে আসে কিন্তু সব নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেখানে সব এক।
“ছাদে নানা উপায়ে উঠা যায়। পাকা সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা সিঁড়ি আর শুধু একটা দড়ি দিয়াও উঠা যায়! তবে উঠবার সময় একটা ধরে উঠতে হয় — দু-তিনরকম সিঁড়িতে পা দিলে উঠা যায় না। তবে ছাদে উঠবার পর সবরকম সিঁড়ি দিয়ে নামা যায়, উঠা যায়।
“তাই প্রথমে একটা ধর্ম আশ্রয় করতে হয়। ঈশ্বরলাভ হলে সেই ব্যক্তি সব ধর্মপথ দিয়ে আনাগোনা করতে পারে; যখন হিন্দুদের ভিতর থাকে, তখন সকলে মনে করে হিন্দু; যখন মুসলমানদের সঙ্গে মেশে, তখন সকলে মনে করে মুসলমান; আবার যখন খ্রীষ্টানদের সঙ্গে মেশে, তখন সকলে ভাবে ইনি বুঝি খ্রীষ্টান।
“সব ধর্মের লোকেরা একজনকেই ডাকছে। কেউ বলছে ঈশ্বর, কেউ রাম, কেউ হরি, কেউ আল্লা, কেউ ব্রহ্ম। নাম আলাদা, কিন্তু একই বস্তু।
“একটা পুকুরে চার ঘাট আছে। একঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, তারা বলছে ‘জল’। আর-একঘাটে মুসলমান, তারা বলছে ‘পানি’। আর-একঘাটে খ্রীষ্টান, তারা বলছে ‘ওয়াটার’। আবার একঘাটে কতকগুলো লোক বলছে ‘aqua’ (সকলের হাস্য)। বস্তু এক — জল, নাম আলাদা। তবে ঝগড়া করবার কি দরকার? সকলেই এক ঈশ্বরকে ডাকছে ও সকলেই তাঁর কাছে যাবে।”
একজন ভক্ত (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — যদি অন্য ধর্মে ভ্রম থাকে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা ভ্রম কোন ধর্মে নাই? সকলেই বলে, আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে। কিন্তু কোন ঘড়িই একেবারে ঠিক যায় না। সব ঘড়িকেই মাঝে মাঝে সূর্যের সঙ্গে মিলাতে হয়। “ভুল কোন্ ধর্মে নাই? আর যদি ভুল থাকে, যদি আন্তরিক হয়, যদি ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকে, তাহলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।
“মনে কর, এক বাপের অনেকগুলি ছেলে — ছোট বড়। সকলেই ‘বাবা’ বলতে পারে না। কেউ বলে ‘বাবা’, কেউ বলে ‘বা’, কেউ বা কেবল ‘পা’। যারা ‘বাবা’ বলতে পারলে না, তাদের উপর বাপ রাগ করবে নাকি? (সকলের হাস্য) না, বাপ সকলকেই সমান ভালবাসবে।১
“লোক মনে করে, আমার ধর্ম ঠিক; আমি ঈশ্বর কি বস্তু বুঝেছি, ওরা বুঝতে পারে নাই। আমি ঠিক তাঁকে ডাকছি, ওরা ঠিক ডাকতে পারে না; অতএব ঈশ্বর আমাকেই কৃপা করেন, ওদের করেন না। এ-সব লোক জানে না যে, ঈশ্বর সকলের বাপ-মা, আন্তরিক হলে তিনি সকলকেই দয়া করেন।”
কি প্রেমের ধর্ম! এ-কথা তিনি তো বারবার বলিলেন, কিন্তু কয়জন ধারণা করিতে পারিল? শ্রীযুক্ত কেশব সেন কতকটা পারিয়াছিলেন। আর স্বামী বিবেকানন্দ জগতের সম্মুখে এই প্রেমের ধর্ম অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া প্রচার করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) করিতে বারবার নিষেধ করিয়াছিলেন। “আমার ধর্ম সত্য ও তোমার মিথ্যা” এটির নাম ‘মতুয়ার বুদ্ধি’ — এইটি যত অনর্থের মূল। স্বামী এই অনর্থের কথা চিকাগো ধর্মসমিতিসমক্ষে বলিলেন। বলিলেন, খ্রীষ্টান, মুসলমান ইত্যাদি অনেকেই ধর্মের নামে রক্তারক্তি, কাটাকাটি, মারামারি করিয়াছেন।
"Sectarianism, bigotry and its horrible descendant fanaticism have long possessed this beautiful earth. They have filled the earth with violence, drenched it often and often with human blood, destroyed civilization and sent whole nations to despair." — Lecture on Hinduism, (Chicago Parliament of Religions.)
স্বামী অপর এক বক্তৃতায় ‘সকল ধর্ম সত্য’, এ-কথা বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রমাণ দিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, —
"If any one here hopes that this unity will come by the triumph of any one of these religions and the destruction of the others, to him I say, Brother, yours is an impossible hope. Do I wish that the Christian would become Hindu? God forbid. Do I wish that the Hindu or Buddhist would become Christian? God forbid.
"The seed is put in the ground, and earth and air and water are placed around it. Does the seed become the earth or the air or the water? No, it becomes a plant, it assimilates the air, the earth and the water, converts them into plant substance and grows a plant.
"Similar is the case with religion. The Christian is not to become a Hindu or a Buddhist nor the Hindu or the Buddhist to become a Christian. But each must assimilate the others and yet preserve its own law of growth."
আমেরিকায় স্বামী Brooklyn Ethical Society নামক সভায় হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন। অধ্যাপক Dr. Lewis James সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেখানেও প্রথম কথা, সর্বধর্ম-সমন্বয়। স্বামী বলিলেন, একজনের ধর্ম সত্য বলা একটি ব্যাধিবিশেষ বলিতে হইবে। সকলের পাঁচটি আঙুল, আর-একজনের যদি ছয়টি হয়, বলিতে হইবে যে ইহা তাহার একটি রোগবিশেষ।
"Truth has always been universal. If I alone were to have six fingers on my hand while all of you have only five, you would not think that my hand was the true intent of nature, but rather that it was abnormal and diseased. Just so with religion. If one creed alone were to be true and all the others untrue, you would have again to say that, that religion is diseased. If one religion is true all the others must be true. Thus the Hindu religion is your property as well as mine." Lecture at Brooklyn.
স্বামী চিকাগো ধর্ম-মহাসভা সম্মুখে যে দিন প্রথম বক্তৃতা করিতে দণ্ডায়মান হয়েন, যে বক্তৃতা শুনিয়া প্রায় ছয় সহস্র লোক মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে মুক্তকণ্ঠে আসন ত্যাগ করিয়া অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন২ সেই বক্তৃতামধ্যে এই সমন্বয়বার্তা ছিল। স্বামী বলিয়াছিলেন, —
"I am proud to belong to a religion which taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all Religions as true. I belong to a religion into whose sacred language, the Sanskrit, the word 'exclusion' is untranslatable."
১ ঠিক এই কথা একখানি ইংরেজী গ্রন্থে আছে – Maxmuller’s Hibbert Lectures. মোক্ষ মূলরও এই উপমা দিয়া বুঝাইয়াছেন যে, যাঁহারা দেবদেবী পূজা করেন, তাঁহাদের ঘৃণা করা উচিত নহে।
২ "When Vivekananda addressed the audience as sisters and brothers of America, there arose a peal of applause that lasted for several minutes." (Dr. Barrow's Report) "But eloquent as were many of the brief speeches, no one expressed so well the spirit of the Parliament of Religions and its limitations as the Hindu monk. * * He is an Orator by divine right." — New York Critique, 1893.
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদা বলিতেন, “আমি ও আমার” এইটি অজ্ঞান, “তুমি ও তোমার” এইটি জ্ঞান। একদিন শ্রীসুরেশ মিত্রের বাগানে মহোৎসব হইতেছিল, রবিবার, ১৫ই জুন ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তেরা অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের কয়েকজন ভক্তও আসিয়াছিলেন। ঠাকুর প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও অন্যান্য ভক্তদের বলিলেন, “দেখ, ‘আমি ও আমার’ এইটির নাম অজ্ঞান। কালীবাড়ি রাসমনী করেছেন, এই কথাই লোকে বলে। কেউ বলে না যে ঈশ্বর করেছেন। ব্রাহ্মসমাজ অমুক করে গেছেন, এই কথাই লোকে বলে। এ-কথা আর কেউ বলে না, ঈশ্বর ইচ্ছায় এটি হয়েছে। ‘আমি করেছি’ এটির নাম অজ্ঞান। হে ঈশ্বর আমার কিছুই নয়, এ মন্দির আমার নয়, এ কালীবাড়ি আমার নয়, এ সমাজ আমার নয়, এ-সব তোমার জিনিস, এ স্ত্রী-পুত্র-পরিবার এ-সব কিছুই আমার নয়, সব তোমারই জিনিস, জ্ঞানীর এসব কথা।
“আমার জিনিস, আমার জিনিস বলে সেই সকল জিনিসকে ভালবাসার নাম মায়া। সবাইকে ভালবাসার নাম দয়া। শুধু ব্রাহ্মসমাজের লোকগুলিকে ভালবাসি, এর নাম মায়া। শুধু দেশের লোকগুলিকে ভালবাসি, এর নাম মায়া। সব দেশের লোককে ভালবাসা, সব ধর্মের লোককে ভালবাসা এট দয়া থেকে হয়, ভক্তি থেকে হয়। মায়াতে মানুষ বদ্ধ হয়ে যায়, ভগবান থেকে বিমুখ হয়। দয়া থেকে ঈশ্বরলাভ হয়। শুকদেব, নারদ এঁরা দয়া রেখেছিলেন।”
ঠাকুরের কথা — শুধু দেশের লোকগুলিকে ভালবাসা, এর নাম মায়া। সব দেশের লোককে ভালবাসা, সব ধর্মের লোকদের ভালবাসা, এট দয়া থেকে হয় — ভক্তি থেকে হয়। তবে স্বামী বিবেকানন্দ অত স্বদেশের জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন?
স্বামী চিকাগো ধর্মমহাসভায় একদিন বলিয়াছিলেন, আমার গরিব স্বদেশবাসীদের জন্য এখানে অর্থ ভিক্ষা করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু দেখিলাম ভারী কঠিন, — খ্রীষ্টটধর্মাবলম্বীদের নিকট যাহারা খ্রীষ্টান নয় তাহাদের জন্য টাকা যোগাড় করা কঠিন।
"The crying evil in the East is not religion — they have religion enough, but it is the bread that the suffering millions of burning India cry out for with parched throats;" ...
"I came here to ask aid for my impoverished people and fully realised how difficult it was to get help for heathens from Christians in a Christian land." — Speech before the Parliament of Religions. (Chicago Tribune)
স্বামীর একজন প্রধান শিষ্যা সিষ্টার নিবেদিতা (Miss Margaret Noble) বলেন যে, স্বামী যখন চিকাগো নগরে বাস করেন, তখন ভারতবাসীদের কাহারও সহিত দেখা হইলে তিনি অতিশয় যত্ন করিতেন, তা তিনি যে জাতিই হউন — হিন্দু হউন বা মুসলমান বা পার্শী বা যাহাই হউন। তিনি নিজে কোন ভাগ্যবানের বাটীতে অতিথিরূপে থাকিতেন। সেইখানেই নিজের দেশের লোককে লইয়া যাইতেন। গৃহস্বামীরাও তাঁহাদের খুব যত্ন করিতেন, আর তাঁহারা বেশ জানিতেন যে, তাঁহাদের যত্ন যদি না করেন, তাহা হইলে স্বামীজী নিশ্চয়ই তাঁহাদের গৃহত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে যাইবেন; —
"At Chicago any Indian man attending the great world Bazar, rich or poor, high or low, Hindu, Mahomedan, Parsi, what not, might at any moment be brought by him to his hosts for hospitality and entertainment and they well knew that any failure of kindness on their part to the least of these would immediately have lost them his presence."
দেশের লোকের কিরূপে দারিদ্র-দুঃখ বিমোচন হয়, তাহাদের কিসে সৎশিক্ষা হয়, কিসে তাহাদের ধর্মসঞ্চয় হয়, এই জন্য স্বামী সর্বদা ভাবিতেন। কিন্তু তিনি দেশের লোকের জন্য যেরূপ দুঃখিত ছিলেন, আফ্রিকাবাসী নিগ্রোর জন্যও সেইরূপ দঃখিত থাকিতেন। শ্রীমতী নিবেদিতা বলেন, স্বামী যখন দক্ষিণ United States মধ্যে ভ্রমণ করিতেছিলেন, কেহ কেহ তাঁহাকে আফ্রিকাবাসী (coloured man) মনে করিয়া গৃহ হইতে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। কিন্তু যখন তাঁহারা শুনিলেন, ইনি তাহা নহেন, ইনি হিন্দু সন্ন্যাসী ও বিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দ তখন তাঁহারাই অতি সমাদরে তাঁহাকে লইয়া গিয়া সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহারা বলিলেন, “স্বামী, যখন আমরা তোমাকে বলিলাম, ‘তুমি কি আফ্রিকাবাসী?’ তখন তুমি কিছু না বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলে কেন?”
স্বামী বলিলেন, “কেন, আফ্রিকাবাসী নিগ্রো কি আমার ভাই নয়?” অর্থাৎ স্বদেশবাসী কি জগৎছাড়া? নিগ্রোকেও যেমন ভালবাসা, স্বদেশবাসীকেও সেইরূপ ভালবাসা, তবে তাহাদের সঙ্গে সর্বদাই থাকা, তাই তাহাদের সেবা আগে। ইহারই নাম অনাসক্ত হইয়া সেবা। ইহারই নাম কর্মযোগ। সকলেই কর্ম করে, কিন্তু কর্মযোগ বড় কঠিন। সব ত্যাগ করে অনেকদিন ধরিয়া নির্জনে ভগবানের ধ্যান-চিন্তা না করিলে এরূপ স্বদেশের উপকার করা যায় না। ‘আমার দেশ’ বলিয়া নয়, তাহা হইলে তো মায়া হইল; ‘তোমার (ঈশ্বরের) এরা’ তাই এদের সেবা করিব। তোমার আদেশ, তাই দেশের সেবা করিব; ‘তোমারই এ কাজ’ আমি তোমার দাস, তাই এই ব্রত পালন করিতেছি, সিদ্ধি হউক, অসিদ্ধি হউক; সে তুমি জান, আমার নামের জন্য নয়, এতে তোমার মহিমা প্রকাশ হইবে।
যথার্থ স্বদেশহিতৈষিতা (Ideal Patriotism) কাহাকে বলে, লোকশিক্ষার জন্য স্বামী তাই এই দুরূহ ব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন। যাহাদের গৃহপরিজন আছে, কখনও ভগবানের জন্য যাহারা ব্যাকুল হয় নাই, যাহারা ‘ত্যাগ’ এই কথা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করে, যাহাদের মন সর্বদা কামিনী-কাঞ্চন ও এই পৃথিবীর মানসম্ভ্রমের দিকে, যাহারা ঈশ্বরদর্শন জীবনের উদ্দেশ্য শুনিয়া অবাক্ হয়, তাহারা স্বদেশহিতৈষিতার এই মহান উচ্চ আদর্শ কিরূপে গ্রহণ করিবে? স্বামী স্বদেশের জন্য কাঁদিতেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা এটিও মনে রাখিতেন যে, এই অনিত্য সংসারে ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। স্বামী বিলাত হইতে ফিরিবার পর হিমাচল দর্শন করিতে আলমোড়ায় গিয়াছিলেন। আলমোড়াবাসীরা তাঁহাকে সাক্ষাৎ নারায়ণবোধে পূজা করিতে লাগিলেন। স্বামী নগাধিরাজ দেবতাত্মা হিমগিরির অত্যুচ্চ শৃঙ্গাবলী সন্দর্শন করিয়া ভাবে বিভোর হইয়া রহিলেন। বলিলেন, আজ এই পবিত্র উত্তরাখণ্ডে সেই পবিত্র তপোভূমি দেখিতেছি, যেখানে ঋষিগণ সর্বত্যাগ করিয়া এই সংসারের কোলাহল হইতে প্রস্থান করিয়া নিশিদিন ঈশ্বরচিন্তা করিতেন। তাহাদেরই শ্রীমুখ হইতে বেদমন্ত্র বিনির্গত হইয়াচিল। হায়! কবে আমার সে দিন হইবে? আমার কতকগুলি কাজ করিবার ইচ্ছা আছে বটে, কিন্তু এই পবিত্র ভূমিতে অনেকদিন পরে আবার আসিবার পর সকল বাসনা এককালে অন্তর্হিত হইতেছে। ইচ্ছা হয়, বিরলে বসিয়া শেষ কয়দিন হরিপাদপদ্ম চিন্তায় গভীর সমাধিমধ্যে নিমগ্ন হইয়া কাটাইয়া যাই।
"It is the hope of my life to end my days somewhere within this Father of Mountains, where Rishis lived — where Philosophy was born. — Speech at Almora.
হিমালয় দেখিলে আর কর্ম করিতে ইচ্ছা হয় না — মনে একচিন্তায় উদয় হয় — কর্মসন্ন্যাস।
"As peak after peak of this Father of Mountains began to appear before my sight, all those propensities to work, that ferment that had been going on in my brain for years seemed to quiet down and mind reverted to that one eternal theme which the Himalayas always teach us, the one theme which is reverberating in the very atmosphere of the place, the one theme that I hear in the rushing whirlpools of its rivers — Renunciation."
এই কর্মসন্ন্যাস, এই ত্যাগ, করিতে পারিলে মানুষ অভয় হয় — আর সকল বস্তুই ভয়াবহ।
‘সর্বং বস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবাভয়ম্।’
"Everything in this life is fraught with fear.
It is renunciation that makes one fearless."
“এখানে আসিলে আর সাম্প্রদায়িক ভাব থাকে না, ধর্ম লইয়া ঝগড়াবিবাদ কোথায় পলাইয়া যায়। কেবল একটি মহান সত্যের ধারণা হয় — ঈশ্বরদর্শনই সত্য, আর যাহা কিছু জলের ফেনার ন্যায় — ভগবানের পূজাই একমাত্র জীবনে প্রয়োজন, আর সকলই মিথ্যা।
“ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। অথবা মধুকর পদ্মের উপর বসিতে পাইলে আর ভনভন করে না!”
"Strong souls will be attracted to this Father of Mountains in time to come, when all this fight between sects and all those differences in dogmas will not be remembered any more, and quarrel between your religion and my religion will have vanished altogether, when mankind will understand that there is but one Eternal Religion and that is the perception of the Divine within an the rest is mere forth. Such ardent souls will come here, knowing that the world is but Vanity, knowing that everything is useless except the worship of the Lord and the Lord alone." — — Speech at Almora.
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বাঁধিয়া যেখানে ইচ্ছা যাও”, স্বামী বিবেকানন্দ অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বাঁধিয়া কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করিয়াছিলেন। সন্ন্যাসীর গৃহ, ধন, পরিজন, আত্মীয়, কুটুম্ব, স্বদেশ, বিদেশ আবার কি? যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বলিলেন, ঈশ্বরকে না জানলে এ-সব ধন, বিদ্যা কি হবে? হে মৈত্রেয়ী, আগে তাঁকে জান, তারপর অন্য কথা। স্বামী এইটি জগৎকে দেখাইলেন। তিনি যেন বলিলেন, হে জগদ্বাসিগণ, আগে বিষয়ত্যাগ করিয়া নির্জনে ভগবানের আরাধনা কর, তাহার পর যাহা ইচ্ছা কর, কিছুতেই দোষ নাই; স্বদেশের সেবা কর; ইচ্ছা হয় কুটুম্ব পালন কর, কিছুতেই দোষ নাই; কেননা, তুমি এখন বুঝিতেছ যে সর্বভূতে তিনি আছেন — তিনি ছাড়া কিছুই নাই — সংসার, স্বদেশ তিনি ছাড়া নহে। ভগবানের সাক্ষাৎকারের পর দেখিবে তিনিই পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছেন। বশিষ্ঠদেব রামচন্দ্রকে বলিয়াছেন, রাম, তুমি যে সংসারত্যাগ করিবে বলিতেছ, আমার সঙ্গে বিচার কর; যদি ঈশ্বর এ-সংসার ছাড়া হন তবে ত্যাগ করিও।১ রামচন্দ্র আত্মার সাক্ষাৎকার করিয়াছিলেন তাই চুপ করিয়া রহিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “ছুরির ব্যবহার জানিয়া ছুরি হাতে কর!” স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থ কর্মযোগী কাহাকে বলে, দেখাইলেন। দেশের কি উপকার করিবে? স্বামী জানিতেন যে, দেশের দরিদ্রের ধন দিয়া সাহায্য করা অপেক্ষা অনেক মহৎ কার্য আছে। ঈশ্বরকে জানাইয়া দেওয়া প্রধান কার্য। তৎপরে বিদ্যাদান; তাহার পর জীবনদান; তাহারপরে অন্নবস্ত্রদান। সংসার দুঃখময়। এই দুঃখ তমি কয়দিনের ঘুচাইবে? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কৃষ্ণদাস পালকে২ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, জীবনের উদ্দেশ্য কি?” কৃষ্ণদাস বলিলেন, “আমার মতে জগতের উপকার করা, জগতের দুঃখ দূর করা।” ঠাকুর বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তোমার ওরূপ রাঁড়ীপুতী বুদ্ধি৩ কেন? জগতের দুঃখনাশ তুমি করবে? জগৎ কি এতটুকু? বর্ষাকালে গঙ্গায় কাঁকড়া হয় জান? এইরূপ অসংখ্য জগৎ আছে। এই জগতের পতি যিনি তিনি সকলের খবর নিচ্ছেন। তাঁকে আগে জানা — এই জীবনের উদ্দেশ্য। তারপর যা “হয় করো।” স্বামীও একস্থানে বলিয়া গিয়াছেন —
"Spiritual knowledge is the only thing that can remove our miseries for ever, any other knowledge satisfies wants only for a time * * * He who gives spiritual knowledge is the greatest benefactor of mankind, * * * Next to spiritual help (ব্রহ্মজ্ঞান) comes intellectual help (বিদ্যাদান) — the gift of secular knowledge. This is far higher than the giving of food and clothes; the next gift is the gift of life and the fourth, the gift of food." — Karmayoga (New York); My plan of Campaign (Madras)
ঈশ্বরদর্শনই জীবনের উদ্দেশ্য। আর এ দেশের ওই এককথা। আগে ওই কথা তাহার পর অন্য কথা। ‘রাজনীতি’ (Politics) প্রথম হইতে বলিলে চলিবে না। আগে অনন্যমন হইয়া ভগবানের ধ্যানচিন্তা কর, হৃদয়মধ্যে তাঁহার অপরূপ রূপ দর্শন কর। তাঁহাকে লাভ করিয়া তখন ‘স্বদেশে’র মঙ্গলসাধন করিতে পারিবে; কেননা, তখন মন অনাসক্ত; ‘আমার দেশ’ বলিয়া সেবা নহে — সর্বভূতে ভগবান আছেন বলিয়া তাঁহার সেবা। তখন স্বদেশ-বিদেশ ভেদবুদ্ধি থাকিবে না। তখন কিসে জীবের মঙ্গলসাধন হয়, ঠিক বুঝিতে পারা যাইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “দাবাবোড়ে যারা খেলে, তারা ঠিক চাল বুঝতে তত পারে না; যারা উদাসীন, কেবল বসে খেলা দেখে, তারা উপর চাল বেশ বলে দিতে পারে।” কেননা, উদাসীনের নিজের কোন দরকার নাই, রাগদ্বেষবিমুক্ত উদাসীন অনাসক্ত জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ নির্জনে অনেকদিন সাধন করিয়া যাহা লাভ করিয়া বসিয়া আছেন, তাহার কাছে আর কিছুই ভাল লাগে না:-
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥
হিন্দুর রাজনীতি, সমাজনীতি, তাই সমস্তই ধর্মশাস্ত্র। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ইত্যাদি মহাপুরুষ এই সকল ধর্মশাস্ত্রের প্রণেতা। তাঁহাদের কিছুরই প্রয়োজন নাই। তথাপি ভগবান কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট হইয়া গৃহস্থের জন্য তাঁহারা শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন। তাঁহারা উদাসীন হইয়া দাবাবোড়ের চাল বলিয়া দিতেছেন, তাই দেশকালপাত্রবিশেষে তাঁহাদের কথায় একটি ভুল হবার সম্ভাবনা নাই।
স্বামী বিবেকানন্দও কর্মযোগী। অনাসক্ত হইয়া পরোপকার-ব্রতরূপ, জীবসেবারূপ কর্ম করিয়াছেন। তাই কর্মীদের সম্বন্ধে তাঁহার এত মূল্য। তিনি অনাসক্ত হইয়া এই দেশের মঙ্গলসাধন করিয়াছেন, যেমন পূর্বতন মহাপুরুষগণ জীবের মঙ্গলার্থে বরাবর করিয়া গিয়াছেন। এই নিষ্কাম ধর্ম পালনার্থ যেন আমরাও তাঁহার পদানুসরণ করিতে পারি। কিন্তু এটি কি কঠিন ব্যাপার! প্রথমে হরিপাদপদ্মলাভ করিতে হইবে। তজ্জন্য বিবেকানন্দের ন্যায় ত্যাগ ও তপস্যা করিতে হইবে। তবে এই অধিকার হইতে পারে।
ধন্য ত্যাগী মহাপুরুষ! তুমি যথার্থই গুরুদেবের পদানুসরণ করিয়াছ। গুরুদেবের মহামন্ত্র — আগে ঈশ্বরলাভ, তাহার পর অন্য কথা, তুমিই সাধন করিয়াছ! তুমিই বুঝিয়াছিলে, ভগবানকে ছাড়িয়া দিলে ‘অতিবাদী’ হইলে, এ-সংসার যথার্থই স্বপ্নবৎ, ভেলকিবাজি; তাই সর্বত্যাগ করিয়া তাঁহার সাধন আগে করিয়াছিলে। যখন দেখিলে সর্ববস্তুর প্রাণ তিনি, যখন দেখিলে, তিনি ছাড়া কিছুই নাই, তখন আবার এই সংসারে মনোনিবেশ করিলে, তখন হে মহাযোগিন! সর্বভূতস্থ সেই হরির সেবার জন্য আবার কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করিলে; তখন তোমার গভীর অপার প্রেমের অধিকারী সকলেই হইল — হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বিদেশী, স্বদেশবাসী, ধনী, দরিদ্র, নর-নারী সকলকেই তুমি প্রেমালিঙ্গন দান করিয়াছ! তখন তীব্র বৈরাগ্যবশতঃ যে গর্ভধারিণী মাতৃদেবীকেও ত্যাগ করিয়া, চক্ষুর জলে ভাসাইয়া, গৈরিকবস্ত্র ধারণ করিয়া চলিয়া গিয়াছিলে, তখন সেই মাকে আবার দর্শন দিলে ও বাৎসল্য স্বীকার করিয়া তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলে! তুমি নারদাদি জনকাদির ন্যায় লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করিয়াছিলে!
১ যোগবাশিষ্ঠ।
২ শ্রীকৃষ্ণদাস পাল দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছিলেন।
৩ রাঁড়ীপুতী বুদ্ধি — বিধবার ছেলের বুদ্ধি; হীন বুদ্ধি; কেননা, সে ছেলে অনেক নীচ উপায়ে মানুষ হয়; পরের তোষামোদ করিয়া, ইত্যাদি।