ভক্তের কল্যাণ

 


রাক্ষস বধ করবার পর মুনি ঋষি গণ প্রসন্ন চিত্তে রাম লক্ষণের জয়ধ্বনি দিলেন । বিশ্বামিত্র মুনি তখন রাম লক্ষণকে নিয়ে মিথিলায় যেতে উদ্যোগ নিলেন । মিথিলার রাজা জনক , তাঁর পুত্রী সীতাদেবীর জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছিলেন । “স্বয়ম্বর” একটি মহাকাব্যের বিবাহ প্রথা, এখানে কোন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কন্যার জন্য পাত্র , অথবা পাত্রী স্বেচ্ছায় নিজ পছন্দের পাত্র নির্বাচন করতেন । বলা হয় প্রজাপতি ব্রহ্মা নারী স্বাধীনতা ও তাহাদিগের পছন্দের মর্যাদা দিতে এই “স্বয়ম্বর” নামক বিবাহবিধি প্রচলন করেছিলেন । জনকের কন্যা সীতাদেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে অনেক রাজা মিথিলা আক্রমণ করে বসতো, সে সবের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজা জনক শিব উপাসনা করে “হর ধনুক” প্রাপ্তি করে আক্রমণকারীদের পরাস্ত করেছিলেন । সেই ধনুক তুলবার শক্তি জনক ভিন্ন অপর কারোর ছিলো না। একদিন মহর্ষি পরশুরাম ও রাজা জনক গল্প করছিলেন। সেই সময় খেলাচ্ছলে বালিকা সীতা দেবী সেই ধনুক এক হাতে তুলে নিলেন। এই দেখে পরশুরাম ও জনক রাজা আশ্চর্য হলেন। পরশুরাম বললেন- “জনক! তুমি তোমার দুহিতার স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা করো। শর্ত রাখবে যে পাত্র এই ধনুক তুলে গুণ পড়িয়ে ভঙ্গ করতে পারবে, তাঁরই সাথে সীতার বিবাহ দেবে।” জনক রাজা সেই মতো সীতাদেবীর স্বয়ম্বর ঘোষোনা করে দিলেন । অপরদিকে রাম লক্ষণ মুনি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে কিছুকাল থেকে ব্রাহ্মণ দিগের কাছে শাস্ত্র কথা শ্রবন করলেন । এরপর বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণকে নিয়ে মিথিলায় চললেন। 


পথে গৌতম মুনির পরিত্যক্ত আশ্রম পড়ে । আগাছা, জঙ্গলে সেই আশ্রম ছেয়ে গেছে। যজ্ঞবেদী, তুলসী মঞ্চ, পূজা ঘর, কুটির গুলো আগাছা জঙ্গল আর বিষাক্ত সাপের আস্তানা হয়েছে । জৌলুষ হারিয়ে সেই আশ্রম এখন জরাজীর্ণ । বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে অহল্যার ঘটনা, ইন্দ্রের ছলাকলা, গৌতম মুনির অভিশাপের কাহানী ব্যক্ত করলেন । সেই আশ্রমে বাতাসে ভেসে আসে এক নারীকণ্ঠের ‘রাম’, ‘রাম’ বোল । কোন এক যুগ থেকে চলে আসা সেই ‘রাম’ নাম এখানে গুঞ্জরিত হচ্ছে কোন অদৃশ্য উৎস থেকে । অহল্যা দেবীর পাষাণ মূর্তির কাছে রাম লক্ষণ কে নিয়ে বললেন- “রঘুবীর! এই হচ্ছেন মাতা অহল্যা দেবীর শাপিত পাষাণ মূর্তি। তুমি তোমার শ্রী চরণ দিয়ে এই মূর্তি স্পর্শ করো, তবেই অহল্যা দেবীর মুক্তি ঘটবে।” রামচন্দ্র মানা করলেন। বললেন- “ক্ষমা করবেন গুরুদেব। ইনি ব্রাহ্মণী, ইনি আমার মাতৃতুল্যা । আমি এঁনার ওপর চরণ রেখে মহাপাপ গ্রহণ করতে ইচ্ছা করি না।” মুনি বিশ্বামিত্র বললেন- “রাম। এছাড়া আর উপায় নেই। মহর্ষি গৌতম অভিশাপ দেবার সময় ঘোষোনা করেছিলেন তোমার চরণের পবিত্র স্পর্শেই মুক্তি ঘটবে। সেইজন্য তোমাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি। তুমি এঁর মুক্তি না দিলে, চিরকাল অহল্যা দেবী পাষাণ হয়ে কষ্ট ভোগ করবেন । তুমি এঁনার মুক্তির ব্যবস্থা কর।” ভগবান রাম তখন পাদুকা খুলে ডান চরণ মূর্তির ওপর রাখলেন । সাথে সাথে মূর্তি জীবিত হয়ে উঠলো। অহল্যা দেবী চোখ খুলে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু সামনে ভগবান রামচন্দ্রকে দেখে প্রনাম করলেন ।


ভক্তিভাবে অহল্যার নয়ন দিয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছিল্ল। তিনি করজোড়ে বললেন- “হে দীনানাথ। হে ভক্তবৎসল ভগবান রাম ! আপনার জয় হোক । আমি অতি ক্ষুদ্রা সামান্যা নারী। আজ আপনার চরণ স্পর্শে আমার মুক্তি ঘটলো । হে ভবভয়নাশন, আমি আপনার শরণাগত হলাম । মুনির অভিশাপে পরম কল্যাণ নিহিত ছিলো। যাঁহাকে দর্শন করার জন্য যোগীরা কঠোর তপ সাধনা যোগ অবলম্বন করেন সেই শ্রীহরি আমার সম্মুখে । আমি অল্পবুদ্ধি । হে রঘুনাথ আমাকে কৃপা করে এই বর দিন যেনো সততঃ আপনার শ্রীপাদপদ্মে ভক্তি থাকে।” এভাবে স্তব করে গৌতমের পত্নী অহল্যা দেবী বারংবার ভগবান রামচন্দ্রের চরণে প্রনাম জানাতে লাগলেন । এরপর তিনি পতি গৌতম মুনির কাছে চলে গেলেন । এইবার বিশ্বামিত্র মুনির সাথে রাম লক্ষণ গঙ্গার ধারে পৌছালেন । বিশ্বামিত্র মুনি গঙ্গা অবতরণের কথা শোনালেন । রাম লক্ষণ এখানে মুনি ঋষিদের সাথে গঙ্গায় স্নান সেড়ে দানাদি পুন্য কর্ম করলেন। এরপর বিশ্বামিত্র মুনি রাম লক্ষণ কে নিয়ে নৌকা দিয়ে গঙ্গা পার করে মিথিলায় আসলেন । মিথিলা নগরী সুন্দর ছিলো। সমস্ত নগরী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শ্রীযুক্ত ছিলো। গৃহগুলি সুন্দর করে সাজানো, বিবিধ কারুকার্যময় আল্পনা দ্বারা সুজ্জিত ছিলো। বৃক্ষ গুলি ফল ফুল সুন্দর বৃহঙ্গ দ্বারা সজ্জিত হয়েছিলো। উত্তম বস্তু এখানে কেনাবেচা হচ্ছিল্ল, ব্যবসায়ীরা ধনী ছিলো । ধর্মাত্মা , জ্ঞানী গণ, পণ্ডিত দের দেখতে পেলেন । রাজা জনকের বৃহৎ রাজবাটী অতি সুন্দর আর রম্য ছিলো। তাতে কোষ্ঠ গুলি হীরা মাণিকে সজ্জিত ছিলো। বিশাল সিংহদ্বারে অবস্থিত রাজ কর্মচারীরা সুবাসিত বারি, চন্দন, কুঙ্কুম, সুবাসিত পুস্প, পান সুপারী দিয়ে রাম লক্ষণ ও মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে স্বাগত জানালেন । রাজা জনকের উদ্যান বাটি খুবুই সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে বিশ্বামিত্র মোহিত হলেন। সেখানেই রাম লক্ষণ কে নিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন ।


মহর্ষি জনক রাজার সুন্দর বাগানে বিশ্রাম করছেন । মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি এসেছেন শুনে একটু পর রাজা জনক সেখানে আসলেন । মুনি বিশ্বামিত্র ও অনান্য উপস্থিত ব্রাহ্মণকে প্রনাম করলেন । এরপর শ্রীরাম ও লক্ষণ , রাজা জনককে প্রনাম করলেন । রামচন্দ্রকে দেখে জনক রাজা মোহিত হলেন । মনে মনে ভাবলেন , এমন সুন্দর পাত্র আগে দেখলে স্বয়ম্বরের আয়োজন করতামই না। এই পাত্রের সাথেই সীতার বিবাহ দিতাম । নিশ্চয়ই সীতা মানা করতো না। লক্ষণ কে দেখে তিনি ভাবলেন এর সাথেই কন্যা ঊর্মিলার বিবাহ দিতাম । আহা কি অপূর্ব রাজপুত্র । জনক রাজা দুই রাজপুত্রের পরিচয় জানতে চাইলেন। তিনি বহুদিন অযোধ্যায় আসেননি তাই রাম লক্ষণকে চিনতেন না । বিশ্বামিত্র মুনি দুই বালকের রাক্ষস নিধনের খবর দিয়ে বললেন- “রাজন! এরা আপনার প্রতিবেশী রাজ্য তথা আপনার মিত্র দশরথের পুত্র রাম লক্ষণ। আপনার স্বয়ম্বর সভায় অংশ নিতে আমি শ্রীরামকে এখানে আনিয়াছি।” শুনে জনক রাজা খুব প্রীত হলেন । রাম, লক্ষণকে অনেক আদর যত্ন করলেন । খানিকবাদে রাজা জনকের সাথে মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজবাটির অন্দরে চলে গেলেন । রাম লক্ষণ ভাবলেন তারা মিথিলা ঘুরে দেখবেন । তারা ঘুরতে বের হলেন । অপূর্ব শোভা চারপাশে বিস্তৃত । একদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা , চারপাশে পুস্প শোভিত বৃক্ষ, শীতল বারিধারা বহন করে বয়ে যাচ্ছে একাধিক নদী, পদ্ম- শালুক প্রস্ফুটিট দীঘিতে হংস হংসী কেলি করছে । মাছরাঙা, বক, সারস ইত্যাদি শ্বেত ধবল পক্ষী সেই দীঘির শোভা বর্ধিত করেছে। চারপাশে পাখীর মধুর কুজনে পরিবেশ মিষ্টি হয়েছে ।


যেখানে লক্ষ্মী দেবী বিরাজ করেন সেখানে এমন মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয় । রাম লক্ষণ কে দেখতে মুনি ঋষিরা যেমন আসলেন, তেমনি মিথিলার লোকজন আসলেন । মুনি ঋষি, ব্রাহ্মণেরা তাড়কা, মারীচ, সুবাহুর ও রাক্ষসদের নিধনের বার্তা শুনে অতীব প্রীত হয়ে রাম লক্ষণের ভূয়ষী প্রশংসা করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগলেন। দিব্যাত্মা মুনি ঋষিরা অন্তরে অন্তরে রামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রনাম নিবেদন করলেন । মিথিলার লোক জন, যুবতী নারী সকলেই রামচন্দ্রকে দেখে পরম প্রীতি , সন্তোষ লাভ করলেন । তারা রামচন্দ্রকে চরণে , মস্তকে স্পর্শ করে নিজেদের ধন্য মনে করছিলেন । সোনাদানা, অর্থ দান করা আরম্ভ করলে যেমন লোকে গৃহ, বাটি, কাজ কর্ম রেখে ধাবমান হয়, তেমনি রাম লক্ষণ কে দেখতে মিথিলার লোকজন ধাবমান হলেন । যেখানে যেখানে রাম লক্ষণ গেলেন সেখানেই ভীর উপচে পড়লো । রাতে তারা জনক পুরীতে বিশ্রাম করলেন । রাজা জনক উৎকৃষ্ট ভোজন করালেন- পলান্ন, পিষ্টক, পায়সান্ন, পুরি, ক্ষীর, লাড্ডু, মোদক, মাখন ইত্যাদি সুস্বাদু ব্যাঞ্জন ভোজন করালেন । অন্তে স্বর্ণ খড়িকা, তাম্বুল, কর্পূর, সুপারী প্রদান করলেন । পর দিন স্বয়ম্বর সভা । মিথিলায় দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ উমাদেবী শক্তিপীঠ আছে । স্বয়ম্বর সভার দিন সীতাদেবী প্রাতেঃ উঠে স্নানাদি করতে গেলেন সখী সহিত। স্নানাদি করে সীতাদেবী পুস্প চয়ন করতে লাগলেন । এক সখী গিয়ে রাম লক্ষণ কে দেখে সীতাদেবীর কাছে এসে বললেন- “হে সখী জানকী! পুস্পদ্যাণে বিশ্বামিত্র মুনির সাথে আগত দুই রাজকুমারকে দেখলাম। কি তাহাদিগের অপূর্ব রূপ। কি তুলনা দিব? সকল মিথিলার নাগরিকেরা তাঁহাদিগের প্রশংসা করছেন । তাহাদের একজন শ্যাম অপরজন গৌর বর্ণ । এই নয়ন দিয়ে যেরূপ দেখলাম সেরূপ বর্ণনা করার শক্তি নেই।” সকলে বলিলেন- “তাহলে একবার সেই রাজকুমার দ্বয়কে দেখে আসি। দেখি আমাদের সখী জানকীর উপযুক্ত কিনা?” 


সখী গণ মিলে সীতাকে নিয়ে সেই স্থানে গেলেন । প্রথম দর্শন হল সীতাদেবী ও রামচন্দ্রের । দুজন দুজনার দিকে চেয়ে রইলেন । এই অবস্থায় উভয়ের প্রেম জন্মালো। মিষ্টি পাখীর কলরব আর সুগন্ধি ফুলের গন্ধে সমগ্র বাগান শীতল পবনে মৃদু মৃদু আলোরিত হচ্ছে- এমন সময়ে উভয়ে উভয়ের যেনো মন সমর্পণ করলেন । আর সীতাদেবীর ভগিনী ঊর্মিলা চেয়ে রইলেন লক্ষণের প্রতি । নয়নে নয়ন, মনে মন যেন একত্র হল । কিছুক্ষণ এইভাবে অবস্থান করার পর সখীদের ডাকে সীতাদেবীর চেতনা ফিরে এলো। এতক্ষণ রামচন্দ্র সীতাময় আর সীতাদেবী রামময় হয়ে গেছিলেন । সখীদের সাথে সীতাদেবী, ঊর্মিলা তখন উমাদেবীর মন্দিরে গেলেন । সীতাদেবীর মনে তখন রামচন্দ্রের মুখচ্ছবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যেমন শিল্পী তার অপূর্ব কলা দ্বারা মনের ভাবনাকে চিত্রিত করেন । কথা, বার্তা সবই বলছেন , কিন্তু মনে পড়ে আছে ঐ রামচন্দ্রের পাণে। পূজা করবার সময় মন্ত্র পাঠ করতে করতে বারংবার উমাদেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন- “হে মাতঃ! তুমি যেমন কঠোর উপাসনা দ্বারা শঙ্করকে পতিরূপে প্রাপ্তি করেছিলেন, তেমনি আমি যেনো তাঁকেই পতি রূপে পাই। তিনি ভিন্ন এই মনে আর কেহ নাই, আর থাকবেও না। হে মাতা গিরিজা। তুমি কৃপা কর।” কৈলাস থেকে হরগৌরী সব দেখে আনন্দে আশীর্বাদ করতে লাগলেন ।


জনক রাজার সভায় রাজারা উপস্থিত । তুলসীদাসী রামায়ণে লিখিত আছে এই সভায় ১০ সহস্র রাজা এসেছিলো। বাণাসুরও এসেছিলো । রাজা জনক সভামাঝে সকল রাজণ্য বর্গকে সম্মান জানিয়ে স্বাগত জানালেন । রেশমি স্বর্ণ খচিত বস্ত্রে ও বিবিধ অলঙ্কারে সুসজ্জিতা হয়ে জনক দুহিতা সীতাদেবী সভায় উপস্থিত হয়ে পর্দার আড়ালে বরমাল্য নিয়ে কেবল লজ্জিত দৃষ্টিতে শ্রীরামকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন । দেবীর অলঙ্কার গুলি থেকে এমন দ্যুতি নির্গত হচ্ছিল্ল, মনে হচ্ছিল্ল আকাশের নক্ষত্র মণ্ডল দিয়ে জানকী দেবীর অলঙ্কার গুলি নির্মিত হয়েছে । অলঙ্কারের দ্যুতিতে সীতাদেবীর মধুময় মুখমণ্ডল অতীব সুন্দর দেখাচ্ছিল্ল । মনে হচ্ছিল্ল পরমপিতা ব্রহ্মা ত্রিলোকের সকল সৌন্দর্য একত্রিত করে সীতাদেবীকে গঠন করেছেন । সীতাদেবীর মা সুনয়না দেবী রামকে দেখা মাত্রই মনে বাৎসল্য ভাবের উদয় হল। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন- “এই কিশোর যেন অবশ্যই আজ ধনুক তুলে তা ভঙ্গ করতে পারে। এই পাত্রই সীতার জন্য উপযুক্ত।” এই ভেবে সুনয়না দেবী মনে মনে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন । উপস্থিত মিথিলার নাগরিকেরা নিজ নিজ ইষ্টের কাছে প্রার্থনা জানালো- ঐ সুদর্শন অযোধ্যার রাজকুমার রামের সাথেই যেন সীতার বিবাহ হয় । সভামাঝে বিশাল হরধনু এনে স্থাপিত করলেন রাজা জনক । কুলগুরু মহর্ষি শতানন্দ ও উপস্থিত সাধু সন্ন্যাসী , ব্রাহ্মণ দিগের প্রনাম করে রাজা জনক প্রতিযোগিতার সূত্রপাত করলেন ।

কত রাজা এলো- কিন্তু ধনুক ভঙ্গ করা তো দূর, একচুল নড়াতে অবধি পারলো না । সকল রাজা, রাজকুমার আস্ফালন করে এলেন, আবার লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন । কেউ একচুল নড়াতে পারলো না সেই দিব্য ধনুক । হঠাত সভামাঝে বাণাসুর এলো। ভয়ে সীতাদেবী মনে মনে মাতা উমার কাছে জানালেন- যেনো এই অসুর ব্যর্থ হয় । প্রবল পরাক্রম অসুর ব্যর্থ হয়ে লজ্জিত হয়ে চলে গেলো । এরপর আরোও রাজা, রাজকুমার এলেন – কিন্তু সকলেই অসফল হয়ে লজ্জিত হয়ে হেট বদনে চলে গেলেন । হঠাত সভামাঝে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হল । যেনো বিশাল ঝড় সভাতে প্রবেশ করেছে এমন অবস্থা। ভয়ানক অট্টহাস্য করে দশানন রাবণ সভায় উপস্থিত হল। রাজা জনক বললেন- “হে দশানন আপনাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, আপনি কেন এসেছেন?” রাবণ দশমুখ দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল- “এর ফল তুমি ভোগ করবে রাজা জনক। আজ আমি এই ধনুক ভঙ্গ করে তোমার কণ্যাকে বিবাহ করে লঙ্কায় নিয়ে যাবো। আমি এই হস্তে কৈলাস পর্বত উত্তোলন করেছি- ঐ ধনুক তো কোন ছাড়!” রাবণ যখন ধনুক তুলতে অগ্রসর হল , তখন ভয়ে সীতা দেবীর মুখ শুকিয়ে গেলো। তিনি মনে মনে মাতা উমাকে স্মরণ করে বললেন- “মাতঃ ! এই পাপী যেনো কোনমতে সমর্থ না হয়। নচেৎ এই মুহূর্তে আমি এই দেহ ত্যাগ করবো। হে শঙ্করী, ভবানী! তুমিই ভরসা । আমাকে এইহেন বিপদ থেকে রক্ষা কর।” জনক রাজা , রানী সুনয়না, উপস্থিত মুনি ঋষি ও লোকেরা প্রার্থনা করতে লাগলেন ভগবানের কাছে। এই পাপীর হস্তে সীতাদেবীকে তুলে দেওয়া মানে অগ্নিতে কন্যা সমর্পণ করা। সকলে ইষ্টদেবতার কাছে রাবণের অসফলতা কামনা করতে লাগলো। রাবণ বহু চেষ্টা করে সেই ধনুক তুলতে পারলো না। পরাজিত হয়ে রাবনের ঘাম নির্গত হল । সকলে হাসতে লাগলো। রাবণ বলল- “এর শোধ আমি নেবোই। একদিন সীতাকে আমি আমার রাজ্যে নিয়ে যাবোই।” বলে রাবন গর্জন করতে করতে মিথিলা থেকে চলে গেল।

কোনো রাজা, রাজকুমার সফল হল না দেখে জনক রাজা আক্ষেপ করে বলল- “এই ধরণী তে কি বীরের অভাব হয়েছে ? এমন কি কোন বীর নেই যে এই ধনুক ভঙ্গ করে আমার কন্যাকে বিবাহ করে? তবে আমার কণ্যা কুমারী থাক।” শুনে লক্ষণ রেগে গিয়ে বলল- “ক্ষমা করবেন মহারাজ! আপনি এখনও রঘুকুলের বীরত্ব দেখেন নি, তাই এমন বলছেন। রঘুকুলের বীরত্ব দেখলে এমন কদাপি উচ্চারন করতেন না।” তখন বিশ্বামিত্র মুনির আদেশে রামচন্দ্র উঠলেন । তিনি সভামাঝে উপস্থিত বিশ্বামিত্র গুরু , মুনি, ঋষি , ব্রাহ্মণ, জনক- সুনয়না দেবী ও উপস্থিত সকলকে প্রনাম জানিয়ে হর ধনুর সম্মুখে গেলেন। সেই পবিত্র শিব প্রদত্ত ধনুককে পূজা, প্রণাম, প্রদক্ষিণ করে এক হস্তে ধনুক তুলে নিলেন । সকলে দেখে তাজ্জব হল। রাজা জনক, সুণয়না, মিথিলা বাসী ও সীতাদেবীর মুখে হাসি ফুটলো । তারপর রামচন্দ্র ধনুকে জ্যা পড়ালেন। তারপর জ্যা আকর্ষণ করতেই ধনুক দ্বিখণ্ডিত হল। ধনুক যখন দ্বিখণ্ডিত হল তখন ভয়ানক বজ্রপাত হল । সকলের মুখে হাসি ফুটলো। বিশ্বামিত্র, মুনি , ঋষিরা উঠে দাঁড়িয়ে ‘সাধু’, ‘সাধু’ বলে প্রশংসা করতে লাগলেন । রামচন্দ্র সকলকে প্রনাম জানালেন। আনন্দিতা হয়ে সীতাদেবী মনে মনে গিরিজা দেবীকে প্রনাম ধন্যবাদ জানিয়ে বরমাল্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সেই বরমাল্য রামচন্দ্রের কন্ঠে পড়িয়ে চরণে প্রনাম করলেন । রাজা জনক বললেন- “পুত্র রাম! তুমিই আমার কন্যা সীতার স্বামী হবে। আমি তোমার সাথেই সীতার বিবাহ দেবো।” ভগবান রাম বললেন- “রাজণ! আমার একটি অনুরোধ আছে। আমরা চার ভ্রাতা একত্রে তিন মায়ের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছি। মাঝে মাঝে আমরা বিস্মৃত হই যে আমাদের আসল গর্ভধারিণী জননী কে? তিন মাতাই আমাদিগকে সমান আদর বাৎসল্য দিয়ে লালন পালন করেছেন। আমরা চার ভাই একত্রে বিদ্যা শিক্ষা নিয়েছি। আপনি আরোও তিনটি কন্যার ব্যবস্থা করুন। আমরা চার ভ্রাতা একই দিনে বিবাহ করবো।” মহর্ষি শতানন্দ বললেন – “তাই হবে। রামচন্দ্রের সাথে সীতার আর জনকের অপর কন্যা ঊর্মিলার সাথে লক্ষণের বিবাহ হবে। আর জনকের ভ্রাতা কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবীর সাথে ভরতের আর শ্রুতকীর্তির সাথে শত্রুঘ্নের বিবাহ হবে।” রাজা জনক ও কুশধ্বজ উভয়ে খুশী হলেন। বিশ্বামিত্র মুনিকে রাজা অনুরোধ জানালেন অযোধ্যায় গিয়ে রাজা দশরথ, ভরত, শত্রুঘ্নকে ও আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে আসুন।


বিশ্বামিত্র মুনি একাকী অযোধ্যায় গেলেন । শয্যাগত রাজা দশরথ একাকী বিশ্বামিত্রকে আসতে দেখে মহা আতঙ্কগ্রস্ত হল। ভাবল রাম লক্ষণের প্রাণ চলে গেছে। রাণীরা ভয় পেলো। বিশ্বামিত্র মুনি খুশীর সংবাদ প্রদান করলেন । বললেন- “রাজন! আপনি ভরত, শত্রুঘ্ন ও আপনার আত্মীয় স্বজন নিয়ে সত্বর মিথিলায় চলুন। রাম, লক্ষণ সেখানেই আছেন।” শুনে যেনো উৎসবের রোল পড়ে গেলো সমগ্র অযোধ্যায় । রাণীরা খুশীতে দাস দাসীদের অলঙ্কারাদি অর্থ উপহার দিলেন । দুন্দুভি, শিঙা, ন্যাকড়া, করতাল , ঢোল বাজতে লাগলো । অযোধ্যা নগরীতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেলো । রাজা দশরথ অবিলম্বে আত্মীয় স্বজন, কুটুম্ব, বান্ধব, পাত্র, মিত্র নিয়ে চললেন মিথিলার উদ্দেশ্যে । হাজার হস্তী, লক্ষ ঘোড়াসোয়ার , লক্ষ রথ, লক্ষ সেনা নিলেন বরযাত্রী রূপে । ভরত, শত্রুঘ্নকে বর বেশে সাজানো হল। সোনার উঞ্জীস, হীরক মালা, স্বর্ণ খচিত ধুতি, হীরক- মণি- মুক্তা খচিত পাদুকা পড়ে ভরত, শত্রুঘ্ন রথে উঠলেন। তিন রাণী ধান দূর্বা দিয়ে বরযাত্রী প্রেরণ করলেন। উলুধ্বনি, শঙ্খের ধ্বনিতে ও বিবিধ বাজনায় আকাশ- বাতাস ভরে উঠলো। অযোধ্যার লক্ষ কোটি মানব সাথে বরযাত্রী রূপে মিথিলায় রওনা দিলো । আতস বাজি, হাউই, ফুলঝুরি আদি শব্দবাজি দিয়ে যেনো চতুর্দিকে আলোকময় হয়ে উঠলো । নর্তক নর্তকী আগে আগে নৃত্য করতে করতে চলল। বরযাত্রীরা আনন্দে উল্লাসে চলতে লাগলেন । মিথিলায় পৌছাতে দুই ভ্রাতাকে বরন করে নিলেন সুনয়না দেবী ও জনকের ভ্রাতা কুশধ্বজ এর পত্নী ।


মার্গশীর্ষ তে শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে মৃগশিরা নক্ষত্রে এই বিবাহ স্থির হয়েছিলো । এই উৎসব “বিবাহ উৎসব” নামে নেপালে এখনও পালিত হয় । বিবাহের দিন উপস্থিত হল। চার ভ্রাতা অতি উত্তম বস্ত্রে সুসজ্জিত হলেন । মিথিলা রাজবাড়ীতে বিবিধ বাজনা বাজতে লাগলো । ঢোল, ন্যাকরা, মৃদঙ্গ, দুন্দুভি, শিঙা, শঙ্খ বাঁজতে লাগলো । স্বর্ণ দ্বারা পরিহিত উঞ্জিস, হীরা- মণি যুক্ত মাল্য , স্বর্ণ দ্বারা খচিত ধুতি পড়ে চার ভ্রাতাকে দেবদূত মনে হতে লাগলো। বর দেখতে মিথিলাবাসীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়লো। সকলে এমন ঠেলাঠেলি করতে লাগলো- যেনো স্বর্গ থেকে ঈশ্বর অমৃত ভাণ্ড নিয়ে বিতরণ করতে উপস্থিত হয়েছেন । চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখেও মনের আশা মেটে না। যত দেখা যায় তত দেখার ইচ্ছার তিনগুন বৃদ্ধি পায় । চার কন্যা উত্তম রেশমি বস্ত্রে সুসজ্জিতা হলেন। নক্ষত্র মণ্ডলের দ্যুতির ন্যায় অলঙ্কারাদি দ্বারা চার বোন সজ্জিতা হলেন । মহর্ষি শতানন্দ ঠিক করলেন গোধূলী লগ্নে রাম সীতার বিবাহ দেবেন, অন্য লগ্নে বাকী তিন ভ্রাতার বিবাহ হবে । কিন্তু দেবতারা দেখলেন গোধূলী লগ্নে বিবাহ হলে রাম সীতার বিচ্ছেদ অসম্ভব । একদিকে যেমন নারদ মুনির শাপ ফলবে না তেমনি রাবণ বধ হবে না। অতএব ঐ লগ্ন নষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন । ইন্দ্রাদি দেবগণ তখন চন্দ্রদেবকে সুন্দরী নর্তকীর বেশে সভায় পাঠালেন । নিশানাথ শশীদেব এক অপূর্ব সুন্দরী নর্তকী সেজেছিলেন । যাঁর ঘুঙুরে মিষ্টি সুরে ত্যাগী পুরুষেরও ব্রহ্মচর্য খণ্ডন হয়। অপূর্ব চাউনি কটাক্ষে কামবাণে জর্জরিত করতে পারে। নরম গোলাপী ঠোট এর মধ্যে বিদ্যুত তরঙ্গ প্রবাহিত। সেই তরঙ্গ বোধ হয় সে মদন দেবের থেকে হরণ করে এনেছে। কালো অমাবস্যার রজনীর ন্যায় কেশ, ফনাধারী নাগিনীর ন্যায় তার কোমল পৃষ্ঠে খেলা করে । সেই নর্তকী এসে সভামাঝে নৃত্য আরম্ভ হল। নৃত্য দেখতে দেখতে সকলেই তন্ময় হয়ে গেলো। গোধূলী লগ্ন পার হয়ে গেলো। হঠাত সেই নর্তকী সভামাঝে অদৃশ্য হলেন । তখন সকলে সচেতন হলেন ।


অন্য লগ্নে চার ভ্রাতার বিবাহ একত্রে ঠিক হল । যথা সেই ক্ষণ আবির্ভূত হল। রামচন্দ্রের সাথে সীতার, ভরতের সাথে মাণ্ডবীর, লক্ষণের সাথে ঊর্মিলার, শত্রুঘ্নের সাথে শ্রুতকীর্তির বিবাহ সম্পন্ন করতে লাগলেন পুরোহিত শতানন্দ। রাজা দশরথ, রাজা জনক দুই মিত্রতে পরস্পরে শুভেচ্ছা কুশল বিনিময় করতে লাগলেন । ভগবানের বিবাহ তে স্বর্গ থেকে দেবতারা সস্ত্রীক মানবের ছদ্দবেশে নেমে এলেন । প্রজাপতি ব্রহ্মা- সরস্বতী দেবী, শিব- গৌরী, নারদ মুনি সকলে ছদ্দবেশে আসলেন । রাজা জনক অভ্যর্থনা জানালেন । মুনি ঋষিরা উপস্থিত হয়েছিলো। পবিত্র মন্ত্র উচ্চারন করে চারভ্রাতার বিবাহ হল। সকল উপস্থিত লোকেরা- সূপ, সুবাসিত অন্ন, পলান্ন, দৈবরা, ঘৃতান্ন, ক্ষীরমঞ্জরী, রসমঞ্জরী, দুগ্ধকদম, শিরা, পুরি, কচুরি, পিষ্টক, জিলাপী, লড্ডু, মোদক, বরফি, অষ্টাকি , মতিচুর, হালুয়া, ক্ষীর, নবনী, উত্তম দহি , ক্ষীরমণ্ড , বোঁদক, গজা- খাঁজা, সারিশি ( ক্ষীর মণ্ড উত্তম রূপে পাক করে চিনি গুর মিশ্রিত করে এক ধরণের মিষ্ট), কদমরস ( এক ধরণের মিষ্ট ), পায়সান্ন , প্যাঁডা, দৈরসা (নারকেল, বাদাম, কাজু, কিসমিস মিশ্রিত ময়াদার মণ্ড এলাচ মিশ্রিত মিষ্ট দুধে ঘন করে জ্বাল করা ) , অম্বল, কর্পূর- মশলাদি সজ্জিত তাম্বুল ( তামিল রামায়ন ) এমন ও আরোও অনেক ব্যাঞ্জন পেট পুড়ে ভোজন করে আবার অনেকে ভোজোনান্তে বাধা ছাঁদা করে নিয়ে গেলো । সকলে খেয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। নানারকম গান, বাজনা, নৃত্য ইত্যাদি মিথিলা রাজ্যে অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। রাজা প্রচুর দান ধ্যান করলেন ।


কন্যাবিদায়ের সময় যেমন পিতামাতা রোদন করেন- তেমনি মিথিলার লোকজন রোদন করতে লাগলেন । পুস্প, স্বর্ণ মাল্য দ্বারা চার ভ্রাতার রথ সাজানো হয়েছিলো। বরযাত্রীরা ধ্বজ, ছত্র, বিবিধ বাজনা নিয়ে অযোধ্যা ফিরবার প্রস্তুতি নিলেন। ঠিক সেই সময় এক অঘটন ঘটলো। মহর্ষি পরশুরাম এসে হাজির হলেন । পরশুরামের ক্রোধের কথা সকলে জানতেন। তিনি ২১ বার ধরিত্রী ক্ষত্রিয়শূণ্য করেছিলেন । তিনি আসতেই সমগ্র ক্ষত্রিয়রা ভূমিতে দণ্ডবৎ হয়ে প্রনাম জানাতে লাগলেন। রাজারা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন- কি জানি আবার ইনি ক্ষত্রিয় বধ আরম্ভ করেন কিনা । পরশুরাম ক্রোধে বললেন- “কে ভগবান শিবের ধনুক ভঙ্গ করেছে ? কে সেই বীর? সামনে আসুক সে। নচেৎ আজ একটি ক্ষত্রিয়কে আমি জীবিত রাখবো না। সব নাশ করে দেবো। আমি জমদাগ্নি পুত্র পরশুরাম । আমার নাম শুনে গর্ভস্থ ক্ষত্রিয় সন্তান অবধি থরথর করে কাঁপে।” লক্ষণ রেগে বললেন- “আপনি অত রাগছেন কেন? বাল্যকালে আমরা খেলাচ্ছল্লে কত ধনুক ভেঙ্গে ফেলেছি? এ আর এমন কি?” শুনে পরশুরাম ক্রোধে হুঙ্কার দিয়ে বললেন- “মূর্খ বালক। আমার সহিত রসিকতা? এ যে সে ধনুক নয়। রুদ্রদেবের প্রদত্ত ধনুক। একে ভঙ্গ তো দূর, তোলার শক্তি অবধি নেই। হে ক্ষত্রিয় বালক, স্তব্ধ হও, নাহলে এবার আর একবার আমি ক্ষত্রিয় নিধন করবো। তুমি কি শোনোনি যে আমি একুশবার ক্ষত্রিয় জাতির নাম বিলুপ্ত করেছি!”


লক্ষণ বললেন- “আপনিও রঘু বংশের বীরত্ব গাঁথা শোনেননি । আমরা থাকলে আপনি আর একুশ বার ক্ষত্রিয় শূন্য করতে পারতেন না। সমুচিত উত্তর দিতাম। আপনি গর্বে উন্মত্ত হয়ে আমাদিগকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু কদাপি আমরা ভীত হবো না।” শুনে পরশুরাম মুনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন- বললেন- “উদ্ধত বালক! আর একটি কথা বললেই ভগবান শিবের প্রদত্ত কুঠার দিয়ে তোমার বলি চড়াবো।” লক্ষণ নিজেও দমবার পাত্র নয়। অতএব তখন ভগবান রাম এসে করজোড়ে বললেন- “মহামুনি! আপনার শ্রী চরণে প্রনাম জানাই। আমি সেই, যে শিব ধনুক ভঙ্গ করেছে।” তখন ভগবান পরশুরাম কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন- “হে রামচন্দ্র! ভগবান শিব আমাকে একটি দিব্য ধনুক দিয়েছেন। দেখি তুমি এই ধনুকে জ্যা সংযোগ করো। তবেই বুঝবো।” বলে পরশুরাম তাঁর ধনুক এগিয়ে দিলেন। ভগবান রাম জ্যা পরালেন সেই ধনুকে । পরশুরাম মুনি অবাক হলেন। এরপর একটি তাজ্জব ঘটনা ঘটে গেলো। অকস্মাৎ পরশুরাম দেখেন তাঁর সম্মুখে রামচন্দ্রের স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন চতুর্ভুজ ভগবান নারায়ণ । তিনি মৃদু মৃদু হাসছেন । পরশুরাম মুনি করজোড়ে তখন রামচন্দ্রকে প্রনাম করলেন । স্তব স্তুতি করে বললেন- “হে রাম! আপনি আমার দর্প চূর্ণ করেছেন । ক্ষত্রিয় নিধন করতে করতে আমার মনে গর্ব উৎপন্ন হয়েছিলো। আজ আপনি তা চূর্ণ করলেন । আপনি দিব্য শর দ্বারা আমার সকল শক্তি হরণ করুন। এক যুগে একসময়ে দুটি অবতার একত্রে থাকতে পারে না। আমি প্রস্থান করবো।” তখন ভগবান রাম পরশুরামের ধনুক থেকে দিব্য বাণ নিক্ষেপ করে পরশুরামের সকল শক্তি নষ্ট করলেন। এরপর পরশুরাম সকলকে আশীর্বাদ করে প্রসন্ন চিত্তে মহেন্দ্র পর্বতে তপস্যার জন্য প্রস্থান করলেন ।


এরপর বরযাত্রী অযোধ্যায় এলেন। চারপুত্র চার বধূকে এনেছে , সমগ্র অযোধ্যা সেজে উঠলো। রাস্তাগুলি পরিষ্কার করে রংবাহারী মালা, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হল। গৃহগুলির সামনে কদলী বৃক্ষ, প্রদীপ, পুস্পমালা দিয়ে সাজানো হল । এছারা গৃহের আঙ্গিনায় রঙবেরঙ্গের রঙ দিয়ে রঙ্গোলি বানানো হল। বিবিধ আতসবাজিতে আকাশ ঢেকে গেলো। চতুর্দিকে আলোর রোশনাইতে ভরে গেলো। কৌশল্যা দেবী সীতাকে বরণ করে নিলেন, কৈকয়ী মাণ্ডবীকে বরণ করলেন। সুমিত্রা রানী, ঊর্মিলা আর শ্রুতকীর্তিকে বরণ করে নিলেন। বিবিধ উপঢৌকন দেওয়া হল। উপস্থিত রাজণ্য বর্গ বিবিধ অলঙ্কার, আভূষন উপহার দিলেন । দুন্দুভি, ন্যাকরা, বাঁশী, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, কাঁসর বাজতে লাগলো । সকলেই নববধূ দেখতে রাজমহলের দিকে ধাবমান হল । রাম সীতাকে দেখে মনে মনে তাঁরা বলতে লাগলো- “সাক্ষাৎ লক্ষ্মী নারায়ণ এক আসনে বিরাজিতা হয়ে আছেন।” রাজা দশরথ খুশী হয়ে মহাভোজ এর আয়োজন করলেন । সমস্ত রাজ্যে উৎসব । খালি একজন ছিলো অখুশী, সে ছিলো কৈকয়ীর দাসী মন্থরা । সমানে সে কৈকয়ীকে কুবুদ্ধি দিতে লাগলো। কৈকয়ী এসবকে মোটেও পাত্তা দিতো না । বিবাহ কে কেন্দ্র করে রাজা অনেক দান ধ্যান করলেন। এভাবে চার ভ্রাতার বিবাহ সমাপন হল। রাম সীতা আনন্দে থাকতে লাগলেন ।


কর্মের বাপ্তি

হিন্দুশাস্ত্রমতে মানব-সাধারণের ধর্ম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিশেষ বিশেষ কর্তব্য আছে। হিন্দুকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছাত্ররূপে জীবন ...