কর্তব্যনিষ্ঠা দ্বারা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির কিরূপ সহায়তা হয়, সে-বিষয়ে আরও অধিক আলোচনা করিবার পূর্বে ‘কর্ম’ বলিতে ভারতে আমরা যাহা বুঝিয়া থাকি, তাহার আর একটি দিক যত সংক্ষেপে সম্ভব তোমাদের নিকট বিবৃত করিতে চেষ্টা করিব। প্রত্যেক ধর্মেরই তিনটি করিয়া ভাগ আছে, যথা-দার্শনিক, পৌরাণিক ও আনুষ্ঠানিক। অবশ্য দার্শনিক ভাগই প্রত্যেক ধর্মের সার। পৌরাণিক ভাগ ঐ দার্শনিক ভাগেরই বিবৃতিমাত্র; উহাতে মহাপুরুষগণের অল্পবিস্তর কাল্পনিক জীবনী এবং অলৌকিক বিষয়সংক্রান্ত উপাখ্যান ও গল্পসমূহ দ্বারা ঐ দর্শনকেই উত্তমরূপে বিবৃত করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। আর আনুষ্ঠানিক ভাগ ঐ দর্শনেরই আরও স্থূলতর রূপ—যাহাতে সকলেই উহা ধারণা করিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে অনুষ্ঠান দর্শনেরই স্থূলতর রূপ। এই অনুষ্ঠানই কর্ম। প্রত্যেক ধর্মেই ইহা প্রয়োজনীয়, কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই—যতদিন না আধ্যাত্মিক বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিতেছে, ততদিন সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ধারণা করিতে অসমর্থ। লোকে সহজেই ভাবিয়া থাকে, তাহারা সকল বিষয়ই বুঝিতে পারে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়—সূক্ষ্ম ভাবসমূহ হৃদয়ঙ্গম করা বড়ই কঠিন। এই কারণে প্রতীকের দ্বারা বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে, আর প্রতীকের সাহায্যে কোন বস্তুকে ধারণা করিবার প্রণালী আমরা কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারি না।
স্মরণাতীত কাল হইতে সকল ধর্মেই প্রতীকের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। এক হিসাবে আমরা প্রতীক ব্যতীত চিন্তাই করিতে পারি না; শব্দসমূহ তো চিন্তারই প্রতীক। অন্য হিসাবে জগতের সমুদয় পদার্থকেই প্রতীকরূপে দেখা যাইতে পারে। সমগ্র জগৎ একটি প্রতীক, আর ইহার পশ্চাতে মূলতত্ত্ব ঈশ্বর। এই প্রতীকজ্ঞান পুরাপুরিভাবে মানব-সৃষ্ট নয়। কোন বিশেষ ধর্মাবলম্বী কয়েকজন ব্যক্তি একস্থানে বসিয়া ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্বকপোলকল্পিত কতকগুলি প্রতীকের সৃষ্টি করিলেন—এরূপ নয়। প্রতীকগুলি স্বভাবতঃ উৎপন্ন হইয়া থাকে। তাহা না হইলে কতকগুলি প্রতীক প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির মনেই কতকগুলি বিশেষ ভাবের সহিত জড়িত কেন? কতকগুলি প্রতীক সর্বজনীনভাবে প্রচলিত। তোমাদের অনেকের ধারণা—খ্রীষ্টধর্মের সংস্পর্শেই ক্রুশ-চিহ্ন প্রথম আবির্ভূত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খ্রীষ্টধর্মের বহু পূর্ব হইতে, মুশা জন্মিবার পূর্ব হইতেই, বেদের আবির্ভাব হইবার পূর্ব হইতে—এমন কি মানুষের কার্যকলাপের কোনপ্রকার মানবীয় ইতিহাস রক্ষিত হইবার পূর্ব হইতেই উহা বর্তমান ছিল। আজটেক ও ফিনিসীয় জাতির মধ্যেও যে ক্রুশ-প্রতীক প্রচলিত ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতে পারে। খুব সম্ভব, সকল জাতিই এই ক্রুশ-চিহ্ন ব্যবহার করিত।
আবার ক্রুশবিদ্ধ পরিত্রাতার—ক্রুশবিদ্ধ হইয়া রহিয়াছে এরূপ একটি মানুষের—প্রতীক প্রায় সকল জাতির মধ্যে ছিল বলিয়া বোধ হয়। সমগ্র জগতের মধ্যে বৃত্ত একটি উৎকৃষ্ট প্রতীকের স্থান অধিকার করিয়াছে। তাহার পর সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন প্রতীক ‘স্বস্তিক’ রহিয়াছে। এক সময়ে লোকে ভাবিত, বৌদ্ধগণ সমগ্র জগতে উহা ছড়াইয়া দিয়াছে, কিন্তু এখন জানা গিয়াছে যে, বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ের অনেক পূর্ব হইতেই বিভিন্ন জাতির মধ্যে উহা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন বাবিলন ও মিশরে ইহা দেখা যাইত। ইহা দ্বারা কি প্রমাণ হইতেছে?—এই প্রতীকগুলি শুধু রীতিগত বা কল্পনাপ্রসূত নয়। নিশ্চয়ই উহাদের কোন যুক্তি আছে, মনুষ্য-মনের সহিত উহাদের কোনরূপ স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে। ভাষাও একটা কৃত্রিম বস্তু নয়। কয়েকজন লোক একত্র হইয়া কতকগুলি ভাবকে বিশেষ বিশেষ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করিবে—এইরূপ সম্মত হওয়াতে ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে—ইহা সত্য নয়। কোন ভাবই তাহার অনুরূপ শব্দ ব্যতিরেকে অথবা কোন শব্দই তাহার অনুরূপ ভাব ব্যতিরেকে থাকিতে পারে না। শব্দ ও ভাব স্বভাবতই অবিচ্ছেদ্য। ভাবসমূহ বুঝাইবার জন্য শব্দ-বা বর্ণ-প্রতীক—উভয়ই ব্যবহৃত হইতে পারে। বধির ও মূক ব্যক্তিদিগকে শব্দপ্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীকের সাহায্যে চিন্তা করিতে হয়। মনের প্রত্যেকটি চিন্তার পরিপূরক হিসাবে একটি করিয়া রূপ আছে। সংস্কৃত দর্শনে উহাদিগকে ‘নাম-রূপ’ বলা হয়। যেমন কৃত্রিম উপায়ে ভাষা সৃষ্টি করা অসম্ভব, সেরূপ কৃত্রিম উপায়ে প্রতীক সৃষ্টি করাও অসম্ভব। পৃথিবীতে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতীকগুলির মধ্যে মানবজাতির ধর্মচিন্তার অভিব্যক্তি দেখিতে পাই। অনুষ্ঠান, মন্দির ও অন্যান্য বাহ্য আড়ম্বরের কোন প্রয়োজন নাই—এ-কথা বলা খুব সহজ। আজকাল ছোট শিশুও এ-কথা বলিয়া থাকে। কিন্তু ইহাই অতি সহজেই দেখা যায়—যাহারা মন্দিরে গিয়া উপাসনা করে না, তাহাদের চেয়ে যাহারা মন্দিরে উপাসনা করে, তাহারা অনেক বিষয়ে অন্যরূপ। এই কারণে কোন কোন ধর্মের সহিত যে-সব বিশেষ প্রকার মন্দির, অনুষ্ঠান ও অন্যান্য স্থূল ক্রিয়াকলাপ জড়িত আছে, তাহা সেই সেই ধর্মাবলম্বীর মনে—ঐ স্থূল বস্তুগুলি যে-সব ভাবে প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়, সেই-সব ভাবের উদ্রেক করিয়া দেয়। আর অনুষ্ঠান ও প্রতীক একেবারে উড়াইয়া দেওয়া বিজ্ঞজনোচিত কাজ নয়। এই সকল বিষয়ের চর্চা ও অভ্যাস স্বভাবতই কর্মযোগের একটি অংশ।
এই কর্ম-বিজ্ঞানের আরও অনেক দিক আছে। তাহাদের মধ্যে একটি এই—‘ভাব’ ও ‘শব্দ’-এর মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে এবং শব্দশক্তিদ্বারা কি সাধিত হইতে পারে, তাহা জানা। সকল ধর্মে শব্দশক্তি স্বীকৃত হইয়াছে; এমন কি কোন কোন ধর্মে সমগ্র সৃষ্টিই ‘শব্দ’ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে বলা হয়। ঈশ্বরের সঙ্কল্পের বাহ্যভাব ‘শব্দ’; আর যেহেতু ঈশ্বর সৃষ্টির পূর্বে সঙ্কল্প ও ইচ্ছা করিয়াছিলেন, সেইহেতু ‘শব্দ’ হইতেই সৃষ্টি হইয়াছে। এই জড়বাদী ইহসর্বস্ব জীবনের পেষণে ও ক্ষিপ্রতায় আমাদের স্নায়ুগুলি অচেতন ও কঠিন হইয়া পড়িতেছে। যতই আমরা বৃদ্ধ হই, যতই আমরা এই জগতে ঘা খাইতে থাকি, ততই আমরা অনুভূতিহীন হইয়া পড়ি; আর যে-সকল ঘটনা বারংবার আমাদের চতুর্দিকে ঘটিতেছে এবং আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করিতেছে, সেইগুলিকেও আমরা অবহেলা করিতে প্রবৃত্ত হই। যাহা হউক, সময়ে সময়ে মানবের নিজস্ব প্রকৃতি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং আমরা এই-সকল সাধারণ ঘটনার অনেকগুলি দেখিয়া বিস্মিত হই ও সেগুলির তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই। আর এইরূপ বিস্ময়ই জ্ঞানালোক-প্রাপ্তির প্রথম সোপান। শব্দের উচ্চ দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক মূল্য ছাড়িয়া দিলেও আমরা দেখিতে পাই, শব্দপ্রতীক মানবের জীবন-রঙ্গমঞ্চে এক প্রধান অংশ অভিনয় করিয়া থাকে। আমি তোমার সহিত কথা কহিতেছি, আমি তোমাকে স্পর্শ করিতেছি না। আমার কথা দ্বারা বায়ুর যে কম্পন হইতেছে, তাহা তোমার কর্ণে গিয়া তোমার স্নায়ুগুলি স্পর্শ করিতেছে এবং তোমার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতেছে। তুমি ইহার প্রতিরোধ করিতে পার না। ইহা অপেক্ষা অধিকতর আশ্চর্য আর কি হইতে পারে? এক ব্যক্তি আর এক ব্যক্তিকে ‘মূর্খ’ বলিল—অমনি সে উঠিয়া মুষ্টি বদ্ধ করিয়া তাহার নাকে ঘুষি মারিল। দেখ—শব্দের কি শক্তি! ঐ এক নারী দুঃখে-কষ্টে কাঁদিতেছে; আর এক নারী আসিয়া তাহাকে দুই-চারিটি মিষ্টকথা শুনাইলেন। অমনি সেই রোদনপরায়ণা নারীর বক্রদেহ সঙ্গে সঙ্গে সোজা হইল, তাহার শোক-দুঃখ চলিয়া গেল, তাহার মুখে হাসি দেখা দিল। দেখ, শব্দের কি শক্তি! উচ্চ দর্শনে যেমন, সাধারণ জীবনেও তেমনি শব্দের প্রচণ্ড শক্তি। এ-সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা ও অনুসন্ধান না করিয়াও আমরা দিবারাত্র এই শক্তি লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছি। এই শক্তির প্রকৃতি অবগত হওয়া এবং যথাযথভাবে উহার ব্যবহার করা কর্মযোগের অঙ্গবিশেষ।
অপরের প্রতি আমাদের কর্তব্যের অর্থ—অপরকে সাহায্য করা,জগতের উপকার করা। কেন আমরা জগতের উপকার করিব? আপাততঃ বোধ হয় যে, আমরা জগৎকে সাহায্য করিতেছি, বাস্তবিক কিন্তু আমরা নিজেদেরই সাহায্য করিতেছি। আমাদের সর্বদাই জগতের উপকার করিবার চেষ্টা করা আবশ্যক, ইহাই যেন আমাদের কর্মপ্রবৃত্তির শ্রেষ্ঠ প্রেরণা হয়; কিন্তু যদি আমরা বিশেষ বিচার করিয়া দেখি, তবে দেখিব,আমাদের নিকট হইতে এই জগতের কোন সাহায্যেরই প্রয়োজন নাই। তুমি আমি আসিয়া উপকার করিব বলিয়া এই জগৎ সৃষ্ট হয় নাই। আমি একবার এক (খ্রীষ্টীয়) ধর্মোপদেশে পড়িয়াছিলাম, ‘এই সুন্দর জগৎ অতি মঙ্গলময়, কারণ এখানে আমরা অপরকে সাহায্য করিবার সময় ও সুবিধা পাই।’ বাহ্যতঃ ইহা অতি সুন্দর ভাব বটে, কিন্তু জগতে আমাদের সাহায্য প্রয়োজন—এইরূপ বলা কি ঈশ্বরনিন্দা নয়? অবশ্য জগতে যে যথেষ্ট দুঃখ আছে, তাহা আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। সুতরাং আমরা যত কাজ করি, তাহার মধ্যে অপরকে সাহায্য করাই সর্বাপেক্ষা ভাল কাজ। যদিও আমরা শেষ পর্যন্ত দেখিব—পরকে সাহায্য করা নিজেরই উপকার করা। বাল্যকালে আমার কতকগুলি সাদা ইঁদুর ছিল। সেগুলি থাকিত একটি ছোট বাক্সে, তাহাতে ছোট ছোট চাকা ছিল। ইঁদুরগুলি যেই চাকার উপর দিয়া পার হইতে চেষ্টা করিত, অমনি চাকাগুলি ক্রমাগত ঘুরিত, ইঁদুরগুলি আর অগ্রসর হইতে পারিত না। এই জগৎ এবং উহাকে সাহায্য করাও সেইরূপ। তবে এইটুকু উপকার হয় যে, আমাদের মানসিক শিক্ষা হয়। এই জগৎ ভালও নয়, মন্দও নয়; প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের জন্য একটি জগৎ সৃষ্টি করে। অন্ধ ব্যক্তি যদি জগৎ-সম্বন্ধে ভাবিতে আরম্ভ করে, তবে তাহার কাছে জগৎ—হয় নরম বা শক্ত, ঠাণ্ডা বা গরমরূপে প্রতিভাত হইবে। আমরা একরাশ সুখ বা দুঃখের সমষ্টিমাত্র। আমরা জীবনে শত শত বার ইহা অনুভব করিয়াছি। যুবকেরা সাধারণতঃ সুখবাদী (optimist), এবং বৃদ্ধেরা দুঃখবাদী (pessimist) হইয়া থাকে। যুবকদের সম্মুখে সারাটা জীবন পড়িয়া রহিয়াছে; বৃদ্ধেরা কেবল অসন্তোষ প্রকাশ করে—তাহাদের দিন ফুরাইয়াছে, শত শত বাসনা তাহাদের হৃদয় আলোড়িত করিতেছে, কিন্তু এখন সেগুলি পূরণ করিবার সামর্থ্য তাহাদের নাই। দুজনেই মূর্খ। আমরা যেরূপ মন লইয়া জীবনকে দেখি, উহা সেইরূপেই প্রতীয়মান হইয়া থাকে, নতুবা স্বরূপতঃ এই জীবন ভালও নয়, মন্দও নয়। স্বরূপতঃ অগ্নি জিনিষটি ভালও নয়, মন্দও নয়। যখন উহা আমাদিগকে সুখতপ্ত রাখে, তখন আমরা বলি—অগ্নি কি সুন্দর! আবার যখন উহা আমাদের অঙ্গুলি দগ্ধ করে, তখন আমরা অগ্নির নিন্দা করিয়া থাকি। অগ্নি কিন্তু স্বরূপতঃ ভালও নয়, মন্দও নয়। আমরা উহার যেমন ব্যবহার করি, উহাও সেইরূপ ভাল-মন্দ ভাব জাগ্রত করে; জগৎ-সম্বন্ধেও এইরূপ। জগৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ; এ-কথার অর্থ—জগৎ নিজের সমুদয় প্রয়োজন পূরণ করিতে সম্পূর্ণভাবে সমর্থ। আমরা একেবারে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি যে, আমাদের সাহায্য ছাড়াও জগৎ বেশ চলিয়া যাইবে, উহার উপকারের জন্য আমাদিগকে মাথা ঘামাইতে হইবে না।
তথাপি আমাদিগকে পরোপকার করিতে হইবে; ইহাই আমাদের কর্মপ্রবৃত্তির সর্বোচ্চ প্রেরণা, কিন্তু আমাদের সর্বদাই জানা উচিত যে,পরোপকার করা এক পরম সুযোগ ও সৌভাগ্য। উচ্চ মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া পাঁচটি পয়সা লইয়া গরীবকে বলিও না,‘এই নে বেচারা’, বরং তাহার প্রতি কৃতজ্ঞ হও—ঐ গরীব লোকটি আছে বলিয়া তাহাকে সাহায্য করিয়া তুমি নিজের উপকার করিতে পারিতেছ। যে গ্রহণ করে সে ধন্য হয় না, যে দান করে সেই ধন্য হয়। তুমি যে তোমার দয়া ও করুণাশক্তি জগতে প্রয়োগ করিয়া নিজেকে পবিত্র ও সিদ্ধ করিতে সমর্থ হইতেছ, এজন্য তুমি কৃতজ্ঞ হও। সব ভাল কাজই আমাদিগকে পবিত্র ও সিদ্ধ হইতে সহায়তা করে। আমরা খুব বেশী কি করিতে পারি?—একটা হাসপাতাল, রাস্তা বা দাতব্য আশ্রম নির্মাণ করিতে পারি! গরীব-দুঃখীকে সাহায্য করিবার জন্য হয়তো আমরা বিশ-ত্রিশ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিতে পারি, তাহার মধ্যে দশ লক্ষ টাকায় একটা হাসপাতাল খুলিতে পারি, দশ লক্ষ টাকা নাচ-তামাশা-মদে খরচ করিতে পারি এবং দশ লক্ষের অর্ধেক কর্মচারীরা চুরি করিতে পারে এবং অবশিষ্ট অংশ হয়তো গরীবদের কাছে পৌঁছিল। কিন্তু তাহাতেই বা হইল কি? এক ঝটকায় পাঁচ মিনিটে সব উড়িয়া যাইতে পারে। তবে করিব কি? এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে রাস্তা, হাসপাতাল, নগর, বাড়ী সব উড়িয়া যাইতে পারে। অতএব এস, জগতের উপকার করিব—এই অজ্ঞানের কথা একেবারে পরিত্যাগ করি। জগৎ তোমার বা আমার সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করিতেছে না। তথাপি আমাদিগকে কার্য করিতে হইবে, সর্বদাই লোকের উপকার করিতে হইবে, কারণ উহা আমাদের পক্ষে এক আশীর্বাদস্বরূপ। কেবল এই উপায়েই আমরা পূর্ণ হইতে পারি। আমরা যে-সব ভিখারীকে সাহায্য করি, তাহারা কেহই আমাদের এক পয়সা ধারে না; আমরাই তাহাদের নিকট ঋণী, কারণ সে তাহার উপর আমাদের দয়াবৃত্তি অনুশীলন করিতে অনুমতি দিয়াছে। আমরা জগতের কিছু উপকার করিয়াছি বা করিতে পারি, অথবা অমুক অমুক লোককে সাহায্য করিয়াছি—এরূপ চিন্তা করা সম্পূর্ণ ভুল। ইহা মূর্খের চিন্তা, আর ঐরূপ চিন্তা দুঃখজনক। আমরা মনে করি, আমরা কাহাকেও সাহায্য করিয়াছি; এবং আশা করি, সে আমাকে ধন্যবাদ দিবে; আর সে ধন্যবাদ না দিলে আমরা মনে কষ্ট পাই। আমাদের কৃত উপকারের জন্য কেন আমরা প্রতিদান আশা করিব? যাহাকে সাহায্য করিতেছ, তাহার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, তাহাতে ঈশ্বর-বুদ্ধি কর। মানুষকে সাহায্য করিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিতে পাওয়া কি আমাদের মহাসৌভাগ্য নয়? যদি আমরা বাস্তবিক অনাসক্ত হইতাম, তবে এই বৃথা আশাজনিত কষ্ট এড়াইতে পারিতাম এবং সানন্দে জগতে কিছু ভাল করিতে পারিতাম। আসক্তিশূন্য হইয়া কাজ করিলে অশান্তি বা দুঃখ কখনই আসিবে না। এই জগৎ সুখ-দুঃখ লইয়া অনন্তকাল চলিতে থাকিবে এবং আমরা উহাকে সাহায্য করিবার জন্য কিছু করি বা না করি, তাহাতে কিছুই আসে যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি গল্প বলিতেছিঃ
নিবারক গোঁড়ারা মাতাল-বেচারাদের বাস্তবিক ভালবাসে? গোঁড়াদের গোঁড়ামির কারণ এই যে, তাহারা এই গোঁড়ামি করিয়া নিজেরা কিছু লাভের প্রত্যাশা করে। যুদ্ধ শেষ হইবামাত্র ইহারা লুণ্ঠনে অগ্রসর হয়। এই গোঁড়ার দল হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারিলেই শিখিবে—কিরূপে প্রকৃতভাবে ভালবাসিতে হয় এবং সহানুভূতি করিতে হয়, তখনই তোমাদের পক্ষে মাতালের সহিত সহানুভূতি করা সম্ভব হইবে; তখনই বুঝিবে—সেও তোমার মত একজন মানুষ; তখনই তোমরা বুঝিতে চেষ্টা করিবে যে, নানা অবস্থাচক্রে পড়িয়া সে ক্রমশঃ অবনত হইয়াছে; আর বুঝিবে, যদি তুমি তাহার মত অবস্থায় পড়িতে, হয়তো আত্মহত্যা করিতে। আমার একটি নারীর কথা মনে হইতেছে—তাহার স্বামী ছিল ঘোর মাতাল। স্ত্রীলোকটি আমার নিকট তাহার স্বামীর অতিরিক্ত পানদোষ-সম্বন্ধে অভিযোগ করিত। আমার কিন্তু নিশ্চিত ধারণা—অধিকাংশ লোক তাহাদের স্ত্রীর দোষে মাতাল হইয়া থাকে। তোষামোদ করা আমার কাজ নয়, আমাকে সত্য বলিতে হইবে। যে-সকল অবাধ্য মেয়েদের মন হইতে সহ্যগুণ একেবারে চলিয়া গিয়াছে এবং যাহারা স্বাধীনতা সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া বলিয়া থাকে, তাহারা পুরুষদিগকে নিজের মুঠোর ভিতর রাখিবে, এবং যখনই পুরুষেরা সাহস করিয়া তাহাদের অরুচিকর কথা বলে, তখনই চীৎকার করিতে থাকে—এরূপ মেয়েরা জগতের মহা অকল্যাণস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইতেছে, আর ইহাদের অত্যাচারে জগতের অর্ধেক লোক যে এখনও কেন আত্মহত্যা করিতেছে না, ইহাই আশ্চর্যের বিষয়। এই নারীগণ অর্ধাশনপীড়িত প্রচারকগণকে তাহাদের দিকে টানিয়া লইতেছে; আর তাহারাও বলিতেছে, ‘মহিলাগণ, আপনারাই জগতের সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য জীব।’ তখন আবার ঐ রমণীগণ এই প্রচারকদের সম্বন্ধে বলিতে থাকে ‘ইনিই আমাদের পক্ষের প্রচারক’ আর তাহাকে টাকাকড়ি ও অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যাদি দিতে থাকে। এইরূপেই জগৎ চলিতেছে, কিন্তু জীবনটা তো এরূপ একটা তামাশা নয়; জীবনে গভীরভাবে প্রণিধান ও আলোচনা করিবার বিষয় অনেক আছে।
এখন তোমাদিগকে আজিকার বক্তৃতার মুখ্য বিষয়গুলি পুনরালোচনা করিতে বলিতেছি। প্রথমতঃ আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে যে, আমরা সকলেই জগতের নিকট ঋণী; জগৎ আমাদের নিকট এতটুকু ঋণী নয়। আমাদের সকলেরই মহা সৌভাগ্য যে, আমরা জগতের জন্য কিছু করিবার সুযোগ পাইয়াছি। জগৎকে সাহায্য করিতে গিয়া আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরই কল্যাণ করিয়া থাকি। দ্বিতীয়তঃ এই জগতে একজন ঈশ্বর আছেন। ইহা সত্য নয় যে, এই জগৎ স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে এবং তোমার বা আমার সাহায্যের অপেক্ষায় রহিয়াছে। ঈশ্বর জগতে সর্বদাই বর্তমান। তিনি অবিনাশী, নিয়ত-ক্রিয়াশীল, তাঁহার সতর্কদৃষ্টি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। যখন বিশ্ব জগৎ নিদ্রা যায়, তখনও তিনি জাগিয়া থাকেন। তিনি অবিরত কাজ করিতেছেন। জগতে যাহা কিছু পরিবর্তন ও বিকাশ দেখা যায়, সবই তাঁহার কাজ। তৃতীয়তঃ আমাদের কাহাকেও ঘৃণা করা উচিত নয়। এই জগৎ চিরকাল শুভাশুভের মিশ্রণ হইয়াই থাকিবে। আমাদের কর্তব্য—দুর্বলের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা এবং অনিষ্টকারীকেও ভালবাসা। এ জগৎ একটি বিরাট নৈতিক ব্যায়ামশালা—এখানে আমাদের সকলকেই অনুশীলন করিতে হইবে, যাহাতে দিন দিন আমরা আরও বেশী আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করিতে পারি। চতুর্থতঃ আমাদের কোনপ্রকারের গোঁড়া হওয়া উচিত নয়, কারণ গোঁড়ামি প্রেমের বিপরীত। গোঁড়া ফস্ করিয়া বলিয়া বসে, ‘আমি পাপীকে ঘৃণা করি না, পাপকে ঘৃণা করি।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাপ ও পাপীর মধ্যে পার্থক্য করিতে পারে, এমন মানুষ দেখিবার জন্য আমি দূর-দূরান্তরে যাইতেও প্রস্তুত। ঐরূপ বলা খুব সহজ! যদি আমরা উত্তমরূপে দ্রব্য ও গুণের মধ্যে পার্থক্য করিতে পারি, তবে তো আমরা সিদ্ধ হইয়া যাই! ঐরূপ করা বড় সহজ নয়। অধিকন্তু যতই আমরা ধীরস্থির হইব এবং আমাদের স্নায়ুসমূহেও যতই শান্ত হইবে, ততই আমরা অধিকতর প্রেমসম্পন্ন হইব এবং আরও ভালরূপে কর্ম করিতে সমর্থ হইব।