পুরুষোত্তম-যোগ



 শ্রীভগবানুবাচ

ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।

ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যন্তং বেদ স বেদবিৎ।।১।।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-ঊর্ধ্বমূল ও অধঃশাখা-বিশিষ্ট একটি অব্যয় অশ্বত্থ বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রসমূহ সেই বৃক্ষের পত্রস্বরূপ। যিনি সেই বৃক্ষটিকে জানেন, তিনিই বেদজ্ঞ।


অধশ্চোর্ধ্বং প্রসৃতাস্তস্য শাখা

গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ।

অধশ্চ মূলান্যনুসন্ততানি

কর্মানুবদ্ধীনি মনুষ্যলোকে।।২।।

অনুবাদঃ এই বৃক্ষের শাখাসমূহ জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা পুষ্ট হয়ে অধোদেশে ও ঊর্ধ্বদেশে বিস্তৃত। ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহই এই শাখাগণের পল্লব। এই বৃক্ষের মূলগুলি তধোদেশে প্রসারিত এবং সেগুলি মনুষ্যলোকে সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ।


ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে

নাস্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা।

অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলম্

অসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা।।৩।।

ততঃ পদং তৎপরিমার্গিতব্যং

যস্মিন্ গতা ননিবর্তন্তি ভূয়ঃ।

তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে

যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী।।৪।।

অনুবাদঃ এই বৃক্ষের স্বরূপ এই জগতে উপলব্ধ হয় না। এর আদি, অন্ত ও স্থিতি যে কোথায় তা কেউই বুঝতে পারে না। তীব্র বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রের দ্বারা দৃঢ়মূল এই বৃক্ষকে ছেদন করে সত্য বস্তুর অন্বেষণ করা কর্তব্য, যেখানে গমন করলে, পুনরায় ফিরে আসতে হয় না। স্মরণাতীত কাল হতে যাঁর থেকে সমস্ত কিছু প্রবর্তন ও বিস্তৃত হয়েছে, সেই আদি পুরুষের প্রতি শরণাগত হও।


নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা

অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ।

দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ-

র্গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ।।৫।।

অনুবাদঃ যাঁরা অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্য-অনিত্য বিচার পরায়ণ, কামনা-বাসনা বর্জিত, সুখ- দুঃখ আদি দ্বন্দ্বসমূহ থেকে মুক্ত এবং মোহমুক্ত, তাঁরাই সেই অব্যয় পদ লাভ করেন।


ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।

যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।৬।।

অনুবাদঃ সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আমার সেই পরম ধামকে আলোকিত করতে পারে না। সেখানে গেলে আর জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।



মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।

মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি।।৭।।

অনুবাদঃ এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্রাম করছে।


শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ

গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ।।৮।।

অনুবাদঃ বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে অন্যত্র গমন করে, তেমনই এই জড় জগতে দেহের ঈশ্বর জীব এক শরীর থেকে অন্য শরীরে তার জীবনের বিভিন্ন ধারণাগুলি নিয়ে যায়।


শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনং চ রসনং ঘ্রাণমেব চ।

অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে।।৯।।

অনুবাদঃ এই জীব চক্ষু, কর্ণ, ত্বক, জিহ্বা, নাসিকা ও মনকে আশ্রয় করে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ উপভোগ করে।



উৎক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভুঞ্জানং বা গুণান্বিতম্।

বিমূঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানচক্ষুষঃ।।১০।।

অনুবাদঃ মূঢ় লোকেরা দেখতে পায় না কিভাবে জীব দেহ ত্যাগ করে অথবা প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিভাবে তার পরবর্তী শরীর সে উপভোগ করে। কিন্তু জ্ঞান-চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সমস্ত বিষয় দেখতে পান।


যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্।

যতন্তোহপ্যকৃত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ।।১১।।

অনুবাদঃ আত্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত যত্মশীল যোগিগণ, এই তত্ত্ব দর্শন করতে পারেন। কিন্তু আত্ম-তত্ত্বজ্ঞান রহিত অবিবেকী গণ যত্মপরায়ণ হয়েও এই তত্ত্ব অবগত হয় না।



যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ ভাসয়তেহখিলম্।

যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্।।১২।।

অনুবাদঃ সূর্যের যে জ্যোতি এবং চন্দ্র ও অগ্নির যে জ্যোতি সমগ্র জগতকে উদ্ভাসিত করে, তা আমারই তেজ বলে জানবে।


গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা। 

পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ।।১৩।।

অনুবাদঃ আমি পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হয়ে আমার শক্তির দ্বারা সমস্ত জীবদের ধারণ করি এবং রসাত্মক চন্দ্ররূপে ধান, যব আদি ওষধি পুষ্ট করছি।



অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ। 

প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।১৪।।

অনুবাদঃ আমি জঠরাগ্নি রূপে প্রাণগিণের দেহ আশ্রয় করে প্রাণ ও অপান বায়ুর সংযোগে চার প্রকার খাদ্য পরিপাক করি।


সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো

মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ। 

বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো

বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্।।১৫।।

অনুবাদঃ আমি সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত এবং আমর থেকেই স্মৃতি, জ্ঞান ও বিলোপ হয়। আমিই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য এবং আমিই বেদান্তকর্তা ও বেদবিৎ। 


 

দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ। 

ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।১৬।।

অনুবাদঃ ক্ষর ও অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতের সমস্ত জীবকে ক্ষর এবং চিৎ-জগতের সমস্ত জীবকে অক্ষর বলা হয়।


উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ। 

যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্তব্যয় ঈশ্বরঃ।।১৭।।

অনুবাদঃ এই উভয় থেকে ভিন্ন উত্তম পুরুষকে বলা হয় পরমাত্মা, যিনি ঈশ্বর ও অব্যয় এবং ত্রিজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে পালন করছেন।


যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।

অতোহস্মিন লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।।১৮।।

অনুবাদঃ যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর থেকেও উত্তম, সেই হেতু জগতে ও বেদে আমি পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত।


যো মামেবমসংমূঢ়ো জনাতি পুরুষোত্তমম্। 

স সর্ববিদ্ ভজতি মাং সর্বভাবেন ভারত।।১৯।।

 অনুবাদঃ হে ভারত! যিনি নিঃসন্দেহে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ এবং তিনি সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন।


ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ। 

এতদ্ বুদ্ধা বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত।।২০।।

অনুবাদঃ হে নিষ্পাপ অর্জুন! হে ভারত! এভাবেই সবচেয়ে গোপনীয় শাস্ত্র আমি তোমার কাছে প্রকাশ করলাম। যিনি এই তত্ত্ব অবগত হয়েছেন, তিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান ও কৃতার্থ হন।

 

কর্মের বাপ্তি

হিন্দুশাস্ত্রমতে মানব-সাধারণের ধর্ম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিশেষ বিশেষ কর্তব্য আছে। হিন্দুকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছাত্ররূপে জীবন ...