সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের ছোট খাটটিতে বসিয়া মার চিন্তা করিতেছেন। ক্রমে ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরদের আরতি আরম্ভ হইল। শাঁকঘন্টা বাজিতে লাগিল। মাস্টার আজ রাত্রে থাকিবেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর মাস্টারকে “ভক্তমাল” পাঠ করিয়া শুনাইতে বলিলেন। মাস্টার পড়িতেছেন —
চরিত্র শ্রীমহারাজ শ্রীজয়মল
জয়মল নামে এক রাজা শুদ্ধমতি।
অনির্বচনীয় তাঁর শ্রীকৃষ্ণ পিরীত ॥
ভক্তি-অঙ্গ-যাজনে যে সুদৃঢ় নিয়ম।
পাসাণের রেখা যেন নাহি বেশি কম ॥
শ্যামল সুন্দর নাম শ্রীবিগ্রহসেবা।
তাহাতে প্রপন্ন, নাহি জানে দেবী দেবা ॥
দশদণ্ড-বেলা-বধি তাঁহার সেবায়।
নিযুক্ত থাকয়ে সদা দৃঢ় নিয়ম হয় ॥
রাজ্যধন যায় কিবা বজ্রাঘাত হয়।
তথাপিহ সেবা সমে ফিরি না তাকায় ॥
প্রতিযোগী রাজা ইহা সন্ধান জানিয়া।
সেই অবকাশকালে আইল হানা দিয়া ॥
রাজার হুকুম বিনে সৈন্য-আদি-গণ।
যুদ্ধ না করিতে পারে করে নিরীক্ষণ ॥
ক্রমে ক্রমে আসি গড় ঘেরে রিপুগণ।
তথাপিহ তাহাতে কিঞ্চিৎ নাহি মন ॥
মাতা তাঁর আসি করে কত উচ্চধ্বনি।
উদ্বিগ্ন হইয়া যে মাথায় কর হানি ॥
সর্বস্ব লইল আর সর্বনাশ হৈল।
তথাপি তোমার কিছু ভুরুক্ষেপ নৈল ॥
জয়মল কহে মাতা কেন দুঃখভাব।
যেই দিল সেই লবে তাহে কি করিব ॥
সেই যদি রাখে তবে কে লইতে পারে।
অতএব আমা সবার উদ্যমে কি করে ॥
শ্যামলসুন্দর হেথা ঘোড়ায় চড়িয়া।
যুদ্ধ করিবারে গেলা অস্তর ধরিয়া ॥
একাই ভক্তের রিপু সৈন্যগণ মারি।
আসিয়া বান্ধিল ঘোড়া আপন তেওয়ারি ॥
সেবা সমাপনে রাজা নিকশিয়া দেখে।
ঘোরার সর্বাঙ্গে ঘর্ম শ্বাস বহে নাকে ॥
জিজ্ঞাসয়ে মোর অশ্বে সওয়ার কে হৈল।
ঠাকুর মন্দিরে বা কে আনি বান্ধিল ॥
সবে কহে কে চড়িল কে আনি বান্ধিল।
আমরা যে নাহি জানি কখন আনিল ॥
সংশয় হইয়া রাজা ভাবিতে ভাবিতে।
সৈন্যসামন্ত সহ চলিল যুদ্ধেতে ॥
যুদ্ধস্থানে গিয়া দেখে শত্তুরে সৈন্য।
রণশয্যায় শুইয়াছে মাত্র এক ভিন্ন ॥
প্রধান যে রাজা এবে সেই মাত্র আছে।
বিস্ময় হইয়া ঞিহ কারণ কি পুছে ॥
হেনকালে অই প্রতিযোগী যে রাজা।
গলবস্ত্র হইয়া করিল বহু পূজা ॥
আসিয়া জয়মল মহারাজার অগ্রেতে।
নিবেদন করে কিছু করি জোড়হাতে ॥
কি করিব যুদ্ধ তব এক যে সেপাই।
পরম আশ্চর্য সে ত্রৈলোক্য-বিজয়ী ॥
অর্থ নাহি মাগোঁ মুঞি রাজ্য নাহি চাহোঁ।
বরঞ্চ আমার রাজ্য চল দিব লহো ॥
শ্যামল সেপাই সেই লড়িতে আইল।
তোমাসনে প্রীতি কি তার বিবরিয়া বল ॥
সৈন্য যে মারিল মোর তারে মুই পারি।
দরশনমাত্রে মোর চিত্ত নিল হরি ॥
জয়মল বুঝিল এই শ্যামলজীর কর্ম।
প্রতিযোগী রাজা যে বুঝিল ইহা মর্ম ॥
জয়মলের চরণ ধরিয়া স্তব করে।
যাহার প্রসাদে কৃষ্ণকৃপা হৈল তারে ॥
তাঁহা-সবার শ্রীচরণে শরণ আমার।
শ্যামল সেপাই যেন করে অঙ্গীকার ॥
পাঠান্তে ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
[ভক্তমাল একঘেয়ে — অন্তরঙ্গ কে? জনক ও শুকদেব ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার এ-সব বিশ্বাস হয়? তিনি সওয়ার হয়ে সেনা বিনাশ করেছিলেন — এ-সব বিশ্বাস হয়?
মাস্টার — ভক্ত, ব্যাকুল হয়ে ডেকেছিল — এ-অবস্থা বিশ্বাস হয়। ঠাকুরকে সওয়ার ঠিক দেখেছিল কিনা — এ-সব বুঝতে পারি না। তিনি সওয়ার হয়ে আসতে পারেন, তবে ওরা তাঁকে ঠিক দেখেছিল কিনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — বইখানিতে বেশ ভক্তদের কথা আছে। তবে একঘেয়ে। যাদের অন্য মত, তাদের নিন্দা আছে।
পরদিন সকালে উদ্যানপথে দাঁড়াইয়া ঠাকুর কথা কহিতেছেন। মণি বলিতেছেন, আমি তাহলে এখানে এসে থাকব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, এত যে তোমরা আস, এর মানে কি! সাধুকে লোকে একবার হদ্দ দেখে যায়। এত আস — এর মানে কি?
মণি অবাক্। ঠাকুর নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — অন্তরঙ্গ না হলে কি আস। অন্তরঙ্গ মানে আত্মীয়, আপনার লোক — যেমন, বাপ, ছেলে, ভাই, ভগ্নী।
“সব কথা বলি না। তাহলে আর আসবে কেন?
“শুকদেব ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য জনকের কাছে গিয়েছিল। জনক বললে, আগে দক্ষিণা দাও। শুকদেব বললে, আগে উপদেশ না পেলে কেমন করে দক্ষিণা হয়! জনক হাসতে হাসতে বললে, তোমার ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর কি গুরু-শিষ্য বোধ থাকবে? তাই আগে দক্ষিণার কথা বললাম।”
সেবক হৃদয়ে
শুক্লপক্ষ। চাঁদ উঠিয়াছে। মণি কালীবাড়ির উদ্যানপথে পাদচারণ করিতেছেন। পথের একধারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর, নহবতখানা, বকুলতলা ও পঞ্চবটী; অপরধারে ভাগীরথী জ্যোৎস্নাময়ী।
আপনা-আপনি কি বলিতেছেন। — “সত্য সত্যই কি ঈশ্বরদর্শন করা যায়? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলিতেছেন। বললেন, একটু কিছু করলে কেউ এসে বলে দেবে, ‘এই এই’। অর্থাৎ একটু সাধনের কথা বললেন। আচ্ছা; বিবাহ, ছেলেপুলে হয়েছে, এতেও কি তাঁতে লাভ করা যায়? (একটু চিন্তার পর) অবশ্য করা যায়, তা নাহলে ঠাকুর বলছেন কেন? তাঁর কৃপা হলে কেন না হবে?
“এই জগৎ সামনে — সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জীব, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব। এ-সব কিরূপে হল, এর কর্তাই বা কে, আর আমিই বা তাঁর কে — এ না জানলে বৃথাই জীবন!
“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পুরুষের শ্রেষ্ঠ। এরূপ মহাপুরুষ এ-পর্যন্ত এ-জীবনে দেখি নাই। ইনি অবশ্যই সেই ঈশ্বরকে দেখেছেন। তা না হলে, মা মা করে কার সঙ্গে রাতদিন কথা কন! আর তা না হলে, ঈশ্বরের ওপর ওঁর এত ভালবাসা কেমন করে হল। এত ভালবাসা যে ভাবশূন্য হয়ে যান! সমাধিস্থ, জড়ের ন্যায় হয়ে যান। আবার কখন বা প্রেমে উন্মত্ত হয়ে হাসেন, কাঁদেন, নাচেন, গান!”