রামায়নে একাধিক অভিশাপের ঘটনা দেখা যায় । এবার ইন্দ্রলোকের কথা শোনা যাক । মহর্ষি দুর্বাসা একদিন ইন্দ্রলোকে পদার্পণ করেছেন । সেখানে একটি বিশেষ যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিলো । দেবরাজ মহেন্দ্র, অপ্সরা পুঞ্জস্থলাকে যজ্ঞের আয়োজন ও মহর্ষি দুর্বাসার সেবা করতে আদেশ দিয়েছিলেন । বয়সে ষোড়শী নবীনা অপরূপা সুন্দরী পুঞ্জস্থলা ছিলেন চঞ্চল মতির । একেবারে চঞ্চলা মন, অল্প বয়সী ছোটো মেয়েদের মতোন লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে চলা এমন । মহর্ষি দুর্বাসার কাজে গাফিলতিও ঘটালেন । কিন্তু দুর্বাসা ক্ষমা করলেন । শাস্ত্রে মহর্ষি দুর্বাসাকে অত্যাধিক ক্রোধী বলা হয়েছে। সামান্য কারণে তিনি ভয়ানক শাপ প্রদান করেন । এনারই অভিশাপে মাতা লক্ষ্মী দেবী পাতালে প্রবেশ করেছিলেন। যাই হোক একদিন যজ্ঞ চলাকালীন অপ্সরা পুঞ্জস্থলা দুর্বাসা মুনির পূজার উপকরণ ডিঙিয়ে চলে গেলেন। হিন্দু ধর্ম মতে খাবার, শায়িত ব্যাক্তি, গুরুদেব ব্রাহ্মণ গুরুজন বা তাদের ছায়া বা পাদুকা, পূজার উপকরণ ডিঙানো ঘোর অপরাধ । দুর্বাসা রেগে শাপ দিলেন- “বানরের মতো লাফিয়ে কোনো কিছু না দেখেই তুমি বিচরণ করো। এমন চঞ্চল মন নিয়ে স্বর্গে তোমার স্থান নেই। যাও পৃথিবীতে গিয়ে বানর কূলে জন্ম নাও।” এমন অভিশাপ শুনে অপ্সরা পুঞ্জস্থলা অনেক ক্ষমা প্রার্থনা করলেন । দুর্বাসা মুনি খুশী হয়ে বর দিলেন – “তুমি বানরী হয়ে জন্মাবে। তবে তোমার গর্ভে স্বয়ং ভগবান মহেশ্বর অবতার নেবেন। সেই অবতারে তিনি হরিভক্তি প্রচার করবেন। আবার রাক্ষস দলন করবেন। জগতে তুমি তাঁর মাতা রূপে পূজানীয়া হবে।”
অপ্সরা পুঞ্জস্থলা বানরী হয়ে জন্ম নিলো। তাঁর বিয়ে হোলো কেশরী নামক এক বানরের সাথে। ঝাড়খণ্ডে এমন একটি জায়গা আছে যেখানে কেশরী বানরের রাজ্য ছিলো বলে বলা হয় । কেশরী বীর ছিলো। সেও রাক্ষস বধ করেছিলো। পরবর্তী কালে ভগবান শিবের অবতার হনুমান এর জন্ম হয় এই দম্পতির ঘরে । মহর্ষি গৌতমের সুন্দর স্ত্রী ছিলেন অহল্যা দেবী। অহল্যা দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র একদিন অহল্যা দেবীকে শয্যাসঙ্গিনী হবার প্রস্তাব দিলেন । অহল্যা দেবী ঘৃনা ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন । কিন্তু ইন্দ্র দেবতার কু মানসিকতা দূর হোলো না । একদিন ফন্দী এটে রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ইন্দ্র দেবতা বণ মোরোগের ডাক ডাকলেন । মুনি ভাবলেন ব্রাহ্ম মুহূর্ত উপস্থিত । হিন্দু ধর্ম মতে ব্রাহ্ম কালে শয্যা ত্যাগ করা নিয়ম । মুনি স্নানে গেলেন কুমণ্ডলু নিয়ে । অপরদিকে ঘরে অহল্যা একা। ইন্দ্রদেবতা মুনি গৌতমের ছদ্দবেশ নিয়ে গৃহে প্রবেশ করে অহল্যাকে ভোগ করলেন। অহল্যা দেবী বুঝতে পারেন নি । তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অহল্যা দেবী ইন্দ্রের জালে পা দিলেন । মুনি ঘাটে গিয়ে দেখলেন তার সাথে ছলনা হয়েছে। দ্রুত ফিরে এসে আশ্রমে তাঁরই মতোন একজনকে দেখে অবাক হলেন । অহল্যাও অবাক আর ভয় ভীত হয়েছিলো। ইন্দ্র স্বরূপ ধরতেই , গৌতম মুনি শাপ দিলেন- “হে অধার্মিক ইন্দ্র। তুমি দেবতাদের রাজা হবার যোগ্য নও । দেবতা হয়েও তুমি এমন ঘৃন্য কাজ করেছো। তোমাকে শাপ দিচ্ছি, তোমার শরীরে সহস্র যোনি উৎপন্ন হোক।” ইন্দ্রের দেহে সহস্র যোনি উৎপন্ন হোলো। লজ্জায় ইন্দ্র কাউকে আর মুখ দেখাতে পারলো না ।
গৌতম মুনি এবার একটি অন্যায় কাজ করলেন। নীরিহ নির্দোষী, চক্রান্তের শিকার অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “তুমি প্রস্তরে পরিণত হও। যবে ভগবান নারায়ণ মানব অবতার নিয়ে এখানে এসে তোমার ওপর চরণ রাখবেন –সেদিনই তুমি মুক্তি পাবে।” সেই থেকে অহল্যা সেই পরিত্যক্ত আশ্রমে পাষাণ হয়ে থাকতে লাগলেন । ইন্দ্র দেবতা পড়ে আরাধনা করে বর পেয়েছিলেন। তাঁর দেহের সহস্র যোনি সহস্র চোখে পরিণত হোলো । এখানে একটি তত্ত্ব কথা আছে । ‘ব্যাঞ্জর’ বা অনাবাদী জমিকে ‘অহল’ অর্থাৎ হাল দেওয়া হয়নি বলা হয়। ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা। এমন অনাবাদী জমিতে ভরপুর বৃষ্টিকে কেউ ইন্দ্র দ্বারা অহল্যা ধর্ষণ বলেছেন । ইন্দ্র দেবতার সহস্র চোখ। যখন বৃষ্টি হয় তখন আমরা কল্পনা করে বলি আকাশের শত চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ইন্দ্র হলেন বৃষ্টির দেবতা। তাই এখানে ইন্দ্রের সহস্র চোখের বর্ণনা করা হয়েছে । যে আখ্যান মানে মানুক, আর যে তত্ত্ব কথা মানে মানুক ক্ষতি নেই। ক্ষতি তখন হয় যখন একজনের মতবাদ অন্যের ওপর জোর করে চাপানোর চেষ্টা হয় । সুতরাং যে যেটা মানে মানুক ।
হনুমান শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন সূর্য দেবতার কাছে । সূর্য দেবতা তাঁহাকে বৈদিক শাস্ত্রাদি জ্ঞান থেকে আরম্ভ করে যুদ্ধবিদ্যা সকল কিছুই প্রদান করলেন । সূর্য দেবতার দ্বিতীয়া পত্নী ছায়াদেবীর সন্তান ছিলেন শণি । সেসময়ের কথা- শণিদেবের খুব ক্রোধী মেজাজ ছিলো । কোনো কারণে একদিন শণিদেবের সাথে হনুমানের বিবাদ হয়। অবশেষে দুজনের মধ্যে যুদ্ধের সূত্রপাত হয় । যুদ্ধে শণিদেব দারুন ভাবে পরাজিত হয় । তখন সূর্য দেবতা এসে দুজনের মধ্যে মিটমাট করেন । উভয়ে বন্ধুত্ব স্বীকার করেন । শণিদেবতা তখন হনুমান কে বর প্রদান করেন। বলেন- “হে অঞ্জনালাল মারুতি! আমি কথা দিচ্ছি যারা তোমাকে ভজনা করবে তাহাদিগের ওপর আমি কদাপি কুদৃষ্টি দেবো না। তাহাদের সকল গ্রহ দোষ খণ্ডন হবে। নবগ্রহ তাহাদের ওপর সুপ্রসন্ন থাকবে। কলিকালে যাহারা তোমার বন্দনা করবে তাহাদিগের সকল গ্রহদোষ ও শণির দশা খণ্ডন হবে। তাহাদের নবগ্রহ আশীর্বাদ করবেন।” এই কারনে জ্যোতিষীরা “হনুমান চালিশা” পড়বার বিধান দেন। যাই হোক বিদ্যা শিক্ষা সমাপনের পর বালক হনুমান আবার মায়ের কোলে ফিরলেন । কিন্তু তাঁহার দুষ্টুমি কমল না। যেমন নারকেল দিয়ে ঢিলানো বা পক্ক ফলমূল চৌর্য বা ধ্যানরত মুনি ঋষি দের তুলে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া, বিশাল বৃক্ষ তুলে উৎপাটন ইত্যাদি। কয়েকবার খেলাচ্ছল্লে কিছু রাক্ষস কেই বাল্যকালে যমালয়ে পাঠালেন । একবার মহর্ষি রুশি তপস্যায় বসেছিলেন একটি বটবৃক্ষ তলে। হনুমান খেলাচ্ছল্লে ভূমি শুদ্ধ তাকে তুলে অন্যত্র রাখলেন। মহর্ষি রুশি অভিশাপ দিলেন- “তুমি তোমার অলৌকিক সকল দৈবশক্তি বিস্মৃত হও।”
এই দেখে অনান্যরা বলল- “মহর্ষি এ আপনি কি করলেন ? হনুমান রূপে দেবাদিদেব অবতার গ্রহণ করেছেন রাক্ষস কূলের সংহারের জন্য। আপনি অভিশাপ দিয়ে তাঁর শক্তি ভুলিয়ে দিলেন?” মহর্ষি রুশি বললেন- “যথা সময়ে কেউ যখন হনুমানের শক্তির কথা স্মরণ করাবে, তখন হনুমানের সমস্ত শক্তির কথা স্মরণ আসবে।” হনুমান তখন থেকে শান্ত হলেন । একদিনের কথা, ইন্দ্র দেবতা যখন স্বর্গে ছিলেন তখন অনান্য অপ্সরারা পুঞ্জস্থলার কথা বলছিল। পূর্বে বলা হয়েছে যে দুর্বাসা মুনির শাপে অপ্সরা পুঞ্জস্থলা, হনুমানের মাতা অঞ্জনা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন । অপ্সরা গন বলল- “হে মহেন্দ্র! অপ্সরা পুঞ্জস্থলা মর্তে জন্ম নিয়েছেন। তিনি দুর্বাসা মুনির শাপকে বাস্তবায়িত করে রুদ্রাবতার হনুমানের জন্ম দিয়েছেন। এখন তাকে স্বর্গে ফিরিয়ে আনা হোক।” ইন্দ্রদেবতা ভাবলেন তাই তো। পুঞ্জস্থলা স্বর্গের অপ্সরা । মর্তলোকে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন তাকে স্বর্গে ফিরিয়ে আনা হোক । সেই মতো ইন্দ্র কেশরী মহলে এসে নিজ শক্তি দ্বারা অপ্সরা পুঞ্জস্থলার স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন । অঞ্জনা অনেক মিনতি করলেন যে হনুমান এখন ছোটো। এই অবস্থায় দেহ ত্যাগ করলে হনুমানকে দেখবে কে? সে মা ছাড়া হয়তো আর বাঁচবেই না । ইন্দ্রদেবতা কোনো বাধা নিষেধ শুনতে চাইলেন না। উলটে শাসিয়ে গেলেন। বললেন- “তুমি আমার নির্দেশ না মানলে আমি বৃষ্টি বন্যা সৃষ্টি করে কেশরী রাজ্য ধ্বংস করবো। তুমি তো জানো দেবতাদের শক্তির কাছে মর্ত বাসী কত অসহায়। অতএব আমার নির্দেশ পালন করে স্বর্গে ফিরে চলো।”
অঞ্জনা দেবী আর কি করেন। মৃত্যুর জন্য তৈরী হতে লাগলেন । সর্বদা উদাস ভাব দেখে কেশরী, হনুমান অনেক জিজ্ঞাসা করলো, অঞ্জনা দেবী কিছুই বলেন না । শেষে অঞ্জনা দেবীকে জটিল রোগে ধরল । প্রানবায়ু নির্গত হোলো। এই ঘটনায় যেমন কেশরী শোক পেলেন, তেমনি হনুমান মাতৃবিয়োগে রোদন করতে লাগলেন । হনুমানের সেই রোদন পৃথিবী ছাড়িয়ে স্বর্গ এমন কি ব্রহ্মলোক, কৈলাস, বৈকুণ্ঠ অবধি কাঁপিয়ে দিয়েছিলো । ব্রহ্মা, বিষ্ণু মিলে ইন্দ্র দেবতাকে ভৎসনা করলেন । কি কারনে এমন করেছে জানতে চাইলেন। সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ভগবান শিব। তিনি ত্রিশূল দিয়ে ইন্দ্রকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু মিলে ভগবান নীলকণ্ঠকে শান্ত করলেন । ব্রহ্মা বললেন- “দুর্মতি ইন্দ্র, তুমি হনুমানের মাতা কেশরীর প্রান কেড়ে অন্যায় করেছো। হনুমানের মাতার আয়ু এখনও অনেক বাকী। তাঁহার আয়ুস্কাল পূর্ণ হয় নি।” ব্রহ্মা তখন হনুমানের মাতা অঞ্জনার প্রান ফিরিয়ে দিলেন। জীবিত হয়ে অঞ্জনা দেবী পুত্র হনুমান কে ক্রোড়ে নিয়ে বাৎসল্য আদর করতে লাগলেন ।
রাবণের সাথে একবার কিস্কিন্ধ্যার সম্রাট বালির যুদ্ধ হয়েছিলো। বালিকে ইন্দ্রদেবতা বর দিয়েছিল যে- যুদ্ধে শত্রু যখন বালির চোখে তাকাবে তখন শত্রুর অর্ধেক শক্তি বালির দেহে আসবে। আর অনায়েসে সেই শত্রু পরাজিত হবে । রাবণ একদা বালির রাজ্য আক্রমণ করে । কারন সেই সময় পরাক্রমী বালির নাম সুদূর লঙ্কাতে পৌছেছিলো। রাবণের বালির আস্ফালন সহ্য হচ্ছিল্ল না । একদিন রাবণ বালির রাজ্য আক্রমণ করলো। বানরদের সাথে রাক্ষসদের যুদ্ধ বাঁধলো। বালির হাতে অল্প সময়ে রাক্ষস কূল বিপর্যস্ত হল । রাবণের সাথে বালির যুদ্ধ হল। রাবণ পরাজিত হল, সেই সময় সূর্যাস্ত প্রায়। বালি সন্ধ্যাবন্দনা আদি কর্ম করবেন। বালি লেজে পেঁচিয়ে রাবণকে সাতবার জলে ডুবালো আর সাতবার তুলল । রাবণ প্রায় অর্ধমৃত দশা । রাবণের শোচনীয় অবস্থা দেখে দেবতারা প্রসন্ন হয়ে বালিকে আশীর্বাদ করতে লাগলো । এই অবস্থায় রাবণ, বালির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল- “আমাকে প্রাণদান করুন কিস্কিন্ধ্যা নরেশ । আমি আপনার রাজ্য আর কদাপি আক্রমণ করবো না। আপনার সাথে আমি মিত্রতা করতে ইচ্ছুক।” বালি রাবণের মিত্রতা স্বীকার করে রাবণকে ছেড়ে দিলো। সেই থেকে রাবণের মনে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে লাগলো যে কিভাবে বালির সর্বনাশ করা যায় ।
রাবণ তার মন্ত্রীদের সাথে শলাপরামর্শ করলো । রাক্ষসেরা বুদ্ধি দিল- এমন বুদ্ধি করতে যাতে বালি আর সুগ্রীবের ভাতৃত্ব বন্ধন নষ্ট হয়। এভাবে বালি শক্তিহীন হলে তাকে ধ্বংস করা সহজ হবে । রাবণের প্রেরিত কিছু বলশালী রাক্ষস বালির রাজ্যে এসে উপদ্রব শুরু করলো। মুনি ঋষিদের ধার্মিক কাজে বাধা দিলে তারা গিয়ে বালিকে নালিশ জানালো । বালি সেই সব বলশালী রাক্ষসদের বধ করে মুনি ঋষিদের অভয় দিয়ে বললেন- “আপনারা শান্তিতে ধার্মিক ক্রিয়াকলাপ করতে পারবেন। যদি কোন রাক্ষস বাধা উৎপত্তি করে তবে তাকে বধ করব।” অপরদিকে রাব তখন দুন্দুভি আর মায়াবি নামক দুই রাক্ষসকে বালির পেছনে লেলিয়ে দেয় । দুই রাক্ষস এসে কিস্কিন্ধ্যায় মহাউপদ্রব সৃষ্টি করে। বালি গদা নিয়ে আসে । প্রথমে মায়াবি নামক রাক্ষস বালির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় । যুদ্ধে হেরে মায়াবি পলায়ন করে । দুন্দুভি রাক্ষস প্রবল যুদ্ধ শুরু করে। পর্বত চূড়া সম উচ্চ উচ্চ প্রস্তর বিশাল বৃক্ষ তুলে বালির পানে নিক্ষেপ করতে থাকলে বালি সেগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলে নিজ গদা দ্বারা । অবশেষে দুন্দুভি শিং উচিয়ে তেঁরে আসে । বালির সাথে যুদ্ধ বাঁধে । বালি দুন্দুভিকে তুলে একটি পর্বতে আছাড় মারে। সেই আছাড়ে দুন্দুভির মস্তক চূর্ণ হয়। এরপর বালি দুন্দুভির মৃতদেহ ঋষমূক পর্বতে ছুড়ে ফেলেন । সেই পর্বতে মহর্ষি মতঙ্গ মুনির আশ্রম ছিলো । মহর্ষি যখন যজ্ঞ করছিলেন তখন তার আশ্রমে দুন্দুভির মৃতদেহ এসে পড়ে। মতঙ্গ মুনি অভিশাপ প্রদান করেন- “বালি তুমি আমার আশ্রম অপবিত্র করেছ । তোমাকে শাপ দিচ্ছি ভবিষ্যতে যদি তুমি ঋষমূক পর্বতের সীমানাতেও যদি চরণ রাখো, সেই মুহূর্তে তুমি ভস্মীভূত হবে।”
বালি এই অভিশাপের কথা জানতো। জীবনে সে আর ঋষমূক পর্বতে আসবার সাহস করেনি । রাবন একবার যমালয় আক্রমণ করেছিলো । দুজনের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ চলছিলো । একদিকে রাবণ অপরদিকে যমরাজ । যমরাজ ও রাবণ উভয়েই ছিলো বীর । এই যুদ্ধের কথা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে পৌছালো । ব্রহ্মার বরে রাবণ যমের হাতে বধ্য ছিলো না। কিন্তু সাক্ষাৎ মৃত্যুর দেবতা যমের সাথে লড়াই । এই ক্ষেত্রে কিছু একটা হতে পারে । যমালয় আক্রমণের বুদ্ধি নারদ মুনি, রাবণকে দিয়েছিলেন। নারদ মুনি বলেছিলেন- “রাবণ তোমার রাক্ষসেরা মরে নরকে গিয়ে যমালয়ে শাস্তি ভোগ করছে। তাদের শাস্তি দিয়েছেন স্বয়ং যম ।” শুনে রাবণ যমালয় আক্রমণ করে ফেলেন । ব্রহ্মা তখন ভগবান শিবের শরণ নিলেন । ভগবান শিব মধ্যস্থতা করে বন্ধ করলেন এই যুদ্ধ ।
অগস্ত্য মুনির নাম সকলেই শুনেছেন । এই মুনির তপঃ শক্তি ছিলো আশ্চর্য রকম। ব্রহ্মার আরাধনা করে অগস্ত্য মুনি অনেক অলৌকিক দিব্যশক্তি পেয়েছিলেন । একবার উনি সমুদ্রের জল এক গণ্ডূষে পান করেছিলেন বলে পুরাণ শাস্ত্রে লেখা । তিনিই নিজ স্ত্রীরূপে যজ্ঞ থেকে লোপামুদ্রা দেবীকে উৎপন্ন করেন । ব্রহ্মার কৃপা পেয়েও নির্লোভী এই মুনি শাস্ত্র নিয়ম মেনে অরণ্যে কুটিরে থাকতেন । এদের সাথে আজকালকার গুরুদেবের অনেক তফাৎ। আজকালকার যুগে বাজার চলতি করে খাওয়া এক ধরণের গুরুর আবির্ভাব হয়েছে । সামান্য ১০-২০ টা শিষ্য হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে শিষ্যের টাকায় শ্বেতপাথরের দালান কোঠা নির্মাণ করে মহাভোগে জীবন কাটান । যাই হোক । যক্ষ সুকেতুর কন্যা তাড়কার বিবাহ হয়েছিলো যক্ষ শুণ্ডের সাথে । একদিন গর্ভস্থ অবস্থায় তাড়কা অগ্যস্ত মুনির আশ্রমে আসেন । তাড়কা বলেন- “মহর্ষি আমার জন্য অপূর্ব সুন্দর রাজমহল নির্মাণ করে দিন। শুনেছি আপনি দেবতাদের বরে অনেক চমৎকার ঘটাতে সমর্থ । সেই রাজমহল হবে দ্বিতীয় অমরাবতী । স্বর্গের দেবতারা এই মহল দেখে হিংসায় জ্বলে মরবে।” অগস্ত্য মুনি মানা করে দিলেন। জানালে ঐ সব দাবী তিনি মানবেন না। এসমস্ত কর্মে তিনি যোগশক্তির ব্যবহার করবেন না ।
তাড়কা অনেক আকুতি মিনতি করল । অগস্ত্য মুনি কিছুতেই সম্মত হলেন না । তাড়কা রেগে তখন মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করলেন । আশ্রম তছনছ করে মুনিকে শাসাতে লাগলেন । প্রথমে মুনি চুপ থাকলেও শেষে ক্রোধে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “দুর্মতি নারী। তুই আমার আশ্রম উন্মত্ত রাক্ষসের ন্যায় ধ্বংস করেছিস । তুই তোর গর্ভস্থ সন্তান সহ রাক্ষস হবি। ভগবান হরির হস্তে নিধন হলেই তোদের মুক্তি ঘটবে । ” মুনির শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলল । তাড়কা রাক্ষসী হয়ে তপবনে বেড়াতে লাগলো। রাক্ষসী হবার পর তাড়কার প্রথম আঘাত গিয়ে পড়লো অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। মুনির আশ্রম লণ্ডভণ্ড করে মুনির শিষ্যদের চিবিয়ে ভক্ষণ করল । কৃত্তিবাসী রামায়নে বারংবার লেখা – রাবনের রাক্ষস বাহিনী ও রাক্ষসেরা নর মাংস আহার করতো। মনে হয় আমরা যে “ঠাকুমার ঝুলি” তে রাক্ষসের গল্প পড়েছি সেখানে নর মাংস ভক্ষণের কথা এই রামায়ন থেকেই এসেছে । তাড়কার তাণ্ডবে অগস্ত্য মুনির আশ্রম শ্মশানে পরিণত হোলো। মুনি যজ্ঞ করতে আরম্ভ করলেই রাক্ষসেরা ধেয়ে এসে যজ্ঞে রক্ত, অস্থি, মাংস, চর্বি নিক্ষেপ করতো । এইভাবে যজ্ঞ অপবিত্র করতো । মুনি অগস্ত্য শেষে তাঁর আশ্রম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন । এরপর তাড়কার নেতৃত্বে তার পুত্র মারীচ, সুবাহু নামক এক রাক্ষস ও অনান্য রাক্ষসরা ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক দুটি জনপদে হানা দিতে থাকে । রাক্ষসেরা সেখানে মানুষদের হত্যা করে রক্ত মাংস আহার করতে থাকে । রাক্ষসদের উৎপাত ভয়ানক আকার নেয় । মতঙ্গ মুনির আশ্রমেও তাণ্ডব চলে। মহর্ষি তখন আক্ষেপ করেন যে তিনি কেন বালিকে শাপ দিলেন । এই অবস্থায় বালি এখানে এসে রাক্ষস বধ করতে পারবে না ।
রাবণ এই সংবাদ শুনে খুবুই আহ্লাদিত হয়। অপরদিকে পঞ্চবটিতে রাবণের ভ্রাতা খর ও দূষনের নেতৃত্বে রাক্ষসদের তাণ্ডব আরম্ভ হয় । বালির ভয়ে তারা কিস্কিন্ধ্যাতে না গেলেও আশেপাশে তাণ্ডব শুরু করে। সুদূঢ হিমালয়েও রাক্ষস দের অত্যাচার আরম্ভ হয় কালনেমির মাধ্যমে । ‘মলদ’ ও ‘কুরূষ’ নামক রাজ্য ক্রমশঃ রাক্ষসদের আহার হতে লাগলে সেখানকার বেঁচে থাকা লোকেরা কিছু অযোধ্যায়, কিছু কিস্কিন্ধ্যায় আশ্রয় নেয়। পরিত্যক্ত নগরী ধীরে ধীরে জঙ্গল হয় । বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রম রেহাই পায় নি । এমনকি একবার নারদ মুনিকেউ আহার করতে গিয়েছিলো তাড়কার বাহিনী রাক্ষসেরা । নারদ মুনি পালিয়ে মহর্ষি দুর্বাসার আশ্রমে যান। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিয়ে রাক্ষসদের ভস্ম করেন । বিশ্বামিত্র মুনির আশ্রমে রাক্ষসদের তাণ্ডব হতে থাকে । গৌতম মুনির পরিত্যক্ত আশ্রমে কাউকে না পেয়ে রাক্ষসেরা বিশ্বামিত্রের আশ্রমে হানা দেয় । বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রোজ তাণ্ডব হোতো। বিশ্বামিত্রের যজ্ঞাদি পণ্ড হত । দেবতাদের সাহায্য চাইলে দেবতারা রাবণের ভয়ে রাক্ষস বধ করতে রাজী ছিলো না । বিশ্বামিত্রের আশ্রমে নারদ মুনি একদা পদার্পণ করলে বিশ্বামিত্র মুনি এর প্রতিকারের কথা জানতে চান । নারদ মুনি বলেন- “এই রাক্ষস দের ধ্বংসকর্তারা বানর রূপে জন্ম নিয়েছে। আর এই রাক্ষসদের ধ্বংস কেবল ভগবান শ্রীহরিই করতে পারবেন । আপনারা সকলে মিলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন।” অপরদিকে রক্তমালা নামক এক রাক্ষসীর হাতে আক্রান্ত হয়ে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর সাহায্য চাইলো । রক্তমালার ঔদ্ধত্য , তাড়কাকেউ ছাড়িয়ে গেছিলো। ভগবান বিষ্ণু একদা ছদ্দবেশে রক্তমালার হাতে আক্রান্ত তপবনে আসলেন ছদ্দবেশে। মুনির ছদ্দবেশে হরিকে দেখে রাক্ষসী রক্তমালা তাকে ভক্ষণ করতে আসলো। ভগবান নারায়ণ তখন সুদর্শন চক্রে রক্তমালার বধ করলেন ।
রাক্ষসদের এমন অত্যাচারে গোটা ভারতই আক্রান্ত হচ্ছিল্ল। রাক্ষসদের হাতে নিপীড়িত হতে হতে মুনি, ঋষি আদি মানব সকল ভগবান বিষ্ণুকে ডাকতে লাগলেন । এমনকি দেবতারা মিলে বৈকুণ্ঠে গমন করে ভগবান শ্রী বিষ্ণুকে সকল বৃন্তান্ত জানালেন । তারা বললেন- “রাক্ষস বাহিনীর মাত্রাছাড়া তাণ্ডবে ধর্ম কর্ম বিনষ্ট হতে বসেছে। অনার্য রাক্ষস সংস্কৃতিতে লুপ্ত হতে বসেছে বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞান। মুনি ঋষিরা যজ্ঞাদি করে দেবতাদের হব্য প্রদান করতে অসমর্থ হচ্ছেন । ধর্ম নষ্ট হয়ে অধর্মের প্রভাব সর্বত্র দেখা দিচ্ছে । যে জগদীশ আপনি কৃপা বশত পুনঃ আবির্ভূত হন । পূর্বে আপনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম অবতার গ্রহণ করে আসুরিক শক্তির নাশ করেছেন, পুনঃ আপনি দানবিক শক্তির সংহার করুন । ” এইভাবে দেবতারা সকলে কাকুতি মিনতি জানালেন। ভগবান মহেশ্বর বললেন- “হে নারায়ণ। আমার অবতার হনুমান মর্তে আবির্ভূত হয়েছে। এবার আপনি মর্তে অবতার গ্রহণ করুন। আপনি সৃষ্টি পালন করেন। এই কারনে আপনি অবতার গ্রহণ করেন, আগামীতেও করবেন। হে লক্ষ্মীনাথ ত্রিবিক্রম, আপনি রাক্ষস বিনাশের জন্য আবির্ভূত হন। রাবণ আপনার হাতেই বধ্য। ” বসুমতী দেবী বললেন- “হে জনার্দন । আমি সর্বংসহা বসুমতী। কিন্তু রাবণের পাপের বোঝা আমি গ্রহণে অসমর্থ । সে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মীর অবতার বেদবতীকে অসম্মান করেছে। এই মহাপাপীর বিনাশ না হলে ধরিত্রী ধ্বংস হবে।”
সকলের প্রার্থনা শুনে ভগবান বিষ্ণু অভয় দিয়ে তাঁর অবতারের কথা ঘোষোনা করে দিলেন । বললেন- “আপনারা চিন্তিত হবেন না । আমি ইক্ষাকু বংশে অযোধ্যার সম্রাট দশরথের নন্দন রূপে কৌশল্যা দেবীর গর্ভে আবির্ভূত হব। ধর্ম রক্ষা করে দুষ্ট রাক্ষস দিগকে বধ করবো। ধর্ম সংস্থাপন করে অধর্মের বিনাশ করবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন । ভগবান বিষ্ণু বললেন- “এই অবতারে দেবী লক্ষ্মীও অবতার গ্রহণ করে রাবণের বিনাশের হেতু হবেন ।” দেবী লক্ষ্মী বলিলেন- “বসুমতী ধরিত্রীর কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়ে আমি মিথিলা রাজ জনক ও তাঁর পত্নী সুনয়নার গৃহে প্রতিপালিত হবো।” দেবতারা আশ্বস্ত হলেন । ব্রহ্মা তখন মহর্ষি বিশ্বশ্রবা কে স্বপ্নে জানালেন- “বিশ্বশ্রবা তুমি তোমার পুত্র দশাননকে সংযত হতে বল। ভগবান হরি মর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন তাঁর বিনাশ করবার জন্য। সে এরূপ অধর্ম আশ্রয় করে থাকলে সে ধ্বংস হবেই, তাঁর কূলেও কেউ রক্ষা পাবে না।” বিশ্বশ্রবা রাবণকে অনেক বোঝালো, রাবণ সংযত হলই না। উলটে আস্ফালন করে বলল- “যদি বিষ্ণু আমাকে বধ করতে আবির্ভূত হয়, তবে আমি বিষ্ণু বধ করবো। কিন্তু বিষ্ণুর ভয়ে আমি ভীত হবো না। ”
এখানে সবাই প্রশ্ন করতে পারেন যে ভগবান বিষ্ণু ইচ্ছা করলেই গরুড়ে আসীন হয়েই লঙ্কা আক্রমণ করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। এতটাও দরকার হত না , তিনি বৈকুণ্ঠ থেকেই সুদর্শন চালনা করে রাক্ষস বধ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মর্তে আবির্ভূত কেন হবেন ? এটা ছেড়েও বলা যায়, দেবী লক্ষ্মীর অংশ বেদবতী নিজে যজ্ঞে ঝাঁপ না দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন । কিংবা রুদ্রাবতার হনুমান রাবণকে বধ করতে পারতেন, কিংবা দেবী পার্বতীকে লঙ্কায় নিয়ে যাবার কালে দেবী শাপ দিয়ে রাবণকে ভস্ম করতে পারতেন বা রাবণ যেদিন কৈলাস আক্রমণ করেছিলো সেদিনই ভগবান শিব তার বধ করতে পারতেন । কিন্তু এঁনারা এমন করলেন না। ভগবান শ্রীহরি কেন মর্তে অবতার নিতে চলেছেন ? এর কারন রূপে কেউ কেউ জয়- বিজয়ের প্রতি সনকাদি মুনিদের অভিসম্পাত , নন্দীর দেওয়া নর বানরের হাতে ধ্বংসের শাপ বা ব্রহ্মার প্রদত্ত নর বানরের হাতে বিনাশের বর প্রদান, বেদবতীর প্রদত্ত অভিশাপ বা রম্ভার অভিশাপকে মুখ্য হেতু মনে করতে পারতেন। যে ভগবান তাই মানব অবতার নিয়েছেন । হ্যা এইগুলো ঠিক । কিন্তু ভগবানের অবতারের দুটি উদ্দেশ্য – অসাধু বিনাশ ও জীবশিক্ষা প্রদান সাথে ভক্ত সঙ্গ । আমরা জানি ভগবান লাভ আমাদের কাছে মূল উদ্দেশ্য । হ্যা ঠিক, যে হরি ভক্ত সে হরিকে, যে শিব ভক্ত সে শিবকে যে দুর্গা ভক্ত সে দুর্গাদেবীর কৃপা প্রাপ্তির জন্যই অচলা ভক্তির পথে চলেন । কিন্তু আমরা কি জানি যে আমরা ভগবান প্রাপ্তির জন্য যতটা ব্যাকুল, ভগবান নিজে শুদ্ধভক্তের সঙ্গ প্রাপ্তির জন্য তাঁর অধিক ব্যাকুল। তিনি শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে বেড়ান। তাই ভক্তের জীবনে এত কষ্ট, এই কষ্ট ঈশ্বরের পরীক্ষা। তিনি পরীক্ষা করেন ভক্ত কতটা আঘাত সহ্য করে আমাকে ডাকে, তবেই না সে শুদ্ধভক্ত। ভগবান তখন সেই ভক্তের দাসানুদাস হন। ভগবান বলেন- “যে করে আমার আশ, করি তার সর্বনাশ। যদি না ছাড়ে পাশ, হই তার দাসের অনুদাস।” ভগবান রামের জীবনে আমরা এমন ভক্তের পরিচয় পাবো। তাই তো বলা হয় ভগবানের চেয়ে ভক্ত বড়। ভগবান এমন ভক্তকেই খোঁজেন, এটি তাঁর অবতারের আর একটি উদ্দেশ্য ।
ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে সরয়ূ নদীর তীরে এই রাজ্য অবস্থিত ছিলো। এই রাজ্যে সর্বত্র শ্রী, ঐশ্বর্য ছিলো। সুউচ্চ মহল, পুস্পশোভিত উদ্যান, নির্মল টলটলে জল ভরা সরোবরে হংস হংসী কেলি, মন্দির, মুনি – ঋষি , পাঠশালা, নাট্টশালা, পুস্পে ফলে শোভিত বৃক্ষ, পক্ষী কলতান সবে মিলে অযোধ্যা নগরী এক সুন্দর পরিবেশ ছিলো । এই রাজ্যের রাজা দশরথ ছিলেন প্রজা পালক, দেব দ্বিজে ভক্তি পরায়ণ , জিতেন্দ্রিয় , ধর্মনিষ্ঠ । এই রাজ্যে ব্রাহ্মণ গণ নিত্যযজ্ঞাদি করতেন । কদর্য, নাস্তিক, গরীব, মূর্খ, কামুক, কৃপণ, নিষ্ঠুর এ রাজ্যে ছিলো না। রাজা এত দানবীর ছিলেন দরিদ্রেরাও ধনী হত । এই নগরীর চারপাশে গভীর জলের পরিখাতে মনুষ্যমাংস আহারী কুমীর রাখা হত, যাতে শত্রু আক্রমণ করতে না পারে । সুপ্রশস্ত রাজপথ ছিল। নগরের চারপাশে সুরক্ষার জন্য ‘শতঘ্নি’ নামক অস্ত্র উচিয়ে রাখা হত । বিপুল সেনা চারপাশে পাহারা দিতো। বোধ হয় রাবনের রাক্ষস বাহিনীর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এমন আয়োজন । রাজর্ষি দশরথের সভায় ৮ জন বিচক্ষন , সু পরামর্শদাতা মন্ত্রী ছিলেন । এছাড়া ৭ জন ঋষি দশরথকে সুবুদ্ধি দিতেন । রাজা দশরথ সাগরের মতো গম্ভীর আর আকাশের ন্যায় নির্মল ছিলেন । তাঁর তিন রানী যথা- কৌশল রাজ্যের রাজকণ্যা কৌশল্যা, কেকয় রাজ্যের রাজকণ্যা কৈকয়ী, ও কলিঙ্গের রাজকণ্যা সুমিত্রা দেবী। দশরথের একটি কন্যা সন্তান ছিলেন তাঁর নাম শান্তা । শান্তার বিবাহ হয়েছিলো ঋষশৃঙ্গ মুনির সাথে। রাজার কোন পুত্র সন্তান ছিলো না ।
এক সময়ের কথা । রাজা দশরথের সুন্দর রাজ্যে একদিন অকাল নেমে আসলো । চারপাশে খরা। মাঠের ফসল মাঠেই রোদে পুড়ে গেলো। বর্ষা ঋতুতে কোন বৃষ্টি নেই। এমন সুন্দর স্বর্গসম রাজ্য বৃষ্টির অভাবে যেনো নরকে পরিণত হতে লাগলো। রাজা অন্নসত্র খুলে প্রজাদের অন্ন বিতরণ করতে লাগলেন । ধীরে ধীরে অন্নের ভাণ্ডার সমাপ্ত হতে লাগলো। রাজা সমস্ত প্রকার কর মুকুব করে দিলেন । কিন্তু ফসল না হলে খাবে কি? রাজা তখন জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হলেন । জ্যোতিষীরা বলল- “হে রাজন। ইন্দ্র দেবতার কোপে এই অনাবৃষ্টি হয় নি। গ্রহরাজ শণিদেব রোহিনী নক্ষত্রের শকট ভেদ করেছেন, তাই এই অবস্থা । এই অবস্থায় শণির দশায় আপনার রাজ্যে বারো বছর অনাবৃষ্টি হবে।” রাজা মহাচিন্তায় পড়লেন । রাজ্যে শণিপূজার আয়োজন করলেন শনি দেবকে সন্তুষ্ট করবার জন্য । কিন্তু শণিদেব তবুও রোহিনী নক্ষত্র ছেড়ে গেলেন না। রাজা বাধ্য হয়ে শণিদেবকে আক্রমণ করলেন । দুজনে মহাযুদ্ধ হল। দশরথ রাজা একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। তিনি এমন সব দিব্যাস্ত্র চালনা করলেন যে দেবতা হয়ে শণিদেব পর্যন্ত অবাক হলেন । কিন্তু দৈবশক্তির বিরুদ্ধে কতক্ষণ আর লড়াই চলে। ঘায়েল হলেন দশরথ । তখন জটায়ু পাখী তাকে সুস্থ করলেন । জটায়ু বললেন- “রাজন। আমি গরুড় পুত্র জটায়ু। আপনাকে আমি সুস্থ করেছি।” রাজা দশরথ বললেন- “হে জটায়ু। আপনি আমার প্রান রক্ষা করে আমাকে নবজীবন দান করেছেন । আজ থেকে আপনি আমার মিত্র।” সুস্থ হয়ে রাজা দশরথ পুনঃ শনিদেবকে আক্রমণ করলেন । একজন মানবের এত স্পর্ধা দেখে শণিদেব আশ্চর্য চকিত হলেন । দুজনের নানা দিব্যাস্ত্রে গগন ছেয়ে গেলো।
নারদ মুনি মধ্যস্থতা করলেন। শণিদেবকে বললেন- “হে সূর্য পুত্র। আপনি রোহিনী নক্ষত্রে এসেছেন বলেই অযোধ্যায় অনাবৃষ্টি হচ্ছে। সেই কারনেই দশরথ রাজা আপনাকে আক্রমণ করেছেন । উপরন্তু ভগবান হরির আগামী অবতারের পিতা হচ্ছেন দশরথ। আপনি প্রভুর পিতার কোনো ক্ষতি করলে তখন হরির কোপ থেকে আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবেন না। অতএব আপনি রোহিনী নক্ষত্র ছেড়ে চলে যান।” শনিদেব বললেন- “তাই হবে। আমি কদাপি আর রোহিনী নক্ষত্রের সীমা অতিক্রম করবো না।” শনিদেব চলে গেলেন। অযোধ্যায় আবার সুদিন ফিরে এলো। অপরদিকে সম্বর নামক অসুরের হাতে দেবাতারা রাজ্যপাট হারিয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন- “সম্বর অসুর কেবল দশরথের হাতে বধ্য । তোমরা তাহাকে যুদ্ধে আনো।” দেবতারা গিয়ে দশরথকে সব কিছু বললেন। দশরথ যুদ্ধে আসলেন । সাথে আসলেন তাঁর স্ত্রী কৈকয়ী । অসুরের সাথে যুদ্ধে দশরথ দারুন ভাবে আহত হলেন । কিন্তু সম্বর অসুরকে বধ করলেন । অসুরের বধ হতে দেবতারা স্বর্গ ফিরে পেলো । কৈকয়ী যুদ্ধে স্বামীকে সাহায্য করেছিলেন । এমনকি দশরথ দারুন ভাবে আহত হয়েছিলেন । সমস্ত শরীরে আঘাত স্থানে পচন ধরেছিল । স্বর্গের বৈদ্য অশ্বিনী কুমার ঔষধ দিলেন। কৈকয়ী প্রানপণে সেবা করে দশরথকে সুস্থ করলেন। খুশী হয়ে দশরথ বললেন- “কৈকয়ী তোমার সেবাতে আমি সুস্থ হয়ে নব জীবন লাভ করেছি। এই ঋণ আমি কদাপি বিস্মৃত হবো না। তোমাকে আমি দুটি বর দিতে চাই। প্রতিজ্ঞা করছি দুই বরে তুমি যা চাইবে তাই আমি দেবো।” কৈকয়ী বললেন- “সময় আসলে আমি অবশ্যই আপনার কাছে দুটি বর চেয়ে নেবো। এখন না।”
অযোধ্যা নগরীর নরপতি রাজা দশরথের কোন পুত্র সন্তান ছিলো না । তিনি তাঁর কন্যা শান্তার স্বামী ঋষশৃঙ্গ মুনিকে রাজা হতে অনুরোধ জানালে ঋষশৃঙ্গ মুনি মানা করলেন । কারন ঋষি তপ, যোগ, সাধনা নিয়েই সুখে ছিলেন । এই নিয়ে রাজা দশরথের চিন্তার শেষ ছিলো না। শেষে কি এই মহান ইক্ষাকু বংশ বিলুপ্ত হবে ? একদিনের কথা রাজা দশরথ মৃগয়াতে বনে গেছেন । পাত্র, মিত্র, সেনা নিয়ে জঙ্গলে মৃগ অন্বেষণ করছেন । মৃগ মাংস তৎকালীন আহার্য ছিলো। মৃগ চর্মে বসে সাধনা করা হত। এছাড়া মৃগ নাভি, মাংস যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হত । অপরদিকে সেই তপবনে এসেছেন শ্রবন কুমার। তিনি তার বৃদ্ধ বয়স্ক মাতাপিতাকে নিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বেড়িয়েছেন । শ্রবণকুমার তার পিতামাতাকে স্কন্ধে বহন করে বিভিন্ন তীর্থে গমন করতেন । তাঁর পিতামাতা বয়সের ভারে জরাজীর্ণ, তার উপর অন্ধ। শ্রবণকুমার এক আদর্শ হিন্দু পুত্র। আজকালকার যুগে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । কোন কোন গুরুদেব আবার অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের সন্ন্যাস নিতে বলছেন পিতামাতার সেবা না করে । কেউ আবার পিতামাতার সেবা না করে ভগবানকে ছাপান্ন ভোগ দিচ্ছেন, তিনবেলা আরতি করছেন। কত সব নিয়ম । কেউ আবার জীবিতকালে পিতামাতাকে খেতে দেয় না, দেখে না, মরলে পড়ে ঘটা করে এলাহী ভোজ খাইয়ে শ্রাদ্ধ, বামন ভোজোন , বৈষ্ণব সেবা, কীর্তন দান ধ্যান আবার গয়াযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন ।
তাই বলে কেউ ধরে নেবেন না যে শাস্ত্রে লেখা ঐ সব কথা মিথ্যা। যে ব্যাক্তি শাস্ত্র মানে না- ইহলোকে সে শান্তি তো পায় না, মরেও মুক্তি পায় না। হ্যা শাস্ত্র নিয়ম অবশ্যই পালনীয়, কিন্তু জীবিত থাকাকালিন পিতামাতার সেবা করা, দেখাশোনা করাও শাস্ত্রের বিধান । গণেশ জী বিশ্ব পরিক্রমা করেছিলেন হরগৌরীকে পরিক্রমা করেই। পিতার অঙ্গীকার করা বচন রাখতে রামচন্দ্র বনবাস গেছিলেন । খালি শাস্ত্রের একদিকটা দেখলেই হয় না। যাই হোক শ্রবণ কুমার পীঠে দাঁড়িপাল্লার মতোন বাঁশের সাথে বাধা ঝুঁড়িতে পিতামাতাকে বসিয়ে তীর্থে যেতেন । একদা শ্রবণ কুমার অন্ধ পিতামাতাকে একস্থানে বসিয়ে দ্বিপ্রহরের ফল মূলাদি সংগ্রহ করতে বের হলেন। ত্রেতা যুগে ভারতবর্ষের বন আজকের মতো রুক্ষ ছিলো না। চারপাশে সবুজে সবুজ, এছাড়া গাছ গুলি নানাপ্রকার মিষ্ট ফলে বারোমাস ভরা থাকতো। মানুষ পশু পাখীর তুলনায় ত্রিনগুণ বৃক্ষ ছিলো। যত ইচ্ছা বনের ফল খাও – এমন ছিলো । শ্রবণ কুমার ফলমূলাদি আহরণ করে নদীতে জল নিতে গেলো। নদীর নিকটেই দশরথ রাজা ধনুর্বাণ নিয়ে মৃগ অন্বেষণ করছিলেন । শ্রবন কুমার যখন জল ভরছিলেন তাঁর শব্দে দশরথ রাজা ভাবলেন কোন মৃগ জল খাচ্ছে । তিনি আগেপিছে না দেখে অব্যর্থ শব্দেভেদী বাণ চালালেন । বাণ গিয়ে শ্রবন কুমারের বুক বিদ্ধ করল । মানবের চিৎকারে দশরথ রাজা ভয় পেয়ে গিয়ে দেখেন তার বাণ শ্রবণকুমারের বুক বিদ্ধ করছে। দশরথ রাজা মুনির সামনে গিয়ে বললেন- “হে মুনিকুমার । আমার দ্বারা অজান্তে মহাপাপ হয়েছে। আমি আপনাকে বধ করতে চাইনি। আমি মৃগ ভ্রমে বাণ নিক্ষেপ করেছিলাম। আপনি এই অধম দশরথকে ক্ষমা করুন।”
আহত শ্রবণকুমার বললেন- “হে রাজন! আমি শ্রবন কুমার। আমার পিতা অন্ধমুনির কাছে আমাকে শীঘ্র নিয়ে চলুন। আমার পিতামাতা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।” এই বলে শ্রবণকুমার দেহত্যাগ করলেন । রাজা মুনি কুমারের মৃতদেহ তার পিতামাতার কাছে নিয়ে গেলেন । মুনি আর মুনি পত্নী কে বললেন- “মুনিবর । আমি অযোধ্যার নৃপতি দশরথ । মৃগ ভ্রমে আমার নিক্ষেপিত শরে আপনাদের পুত্র শ্রবণ কুমারের প্রান গেছে। আমার দ্বারা অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটি হয়েছে । ” শুনে বৃদ্ধ পিতামাতা শোকে কেঁদে উঠলেন । বিশেষ করে শ্রবণকুমারের মা এই শোক সহ্য করতে না পেরে তখুনি প্রান ত্যাগ করলেন। বৃদ্ধ অন্ধ মুনি বললেন- “দশরথ। অগ্নিতে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হাত দিলে হাত পুড়েই যায়। তোমার অনিচ্ছাকৃত ভুলে আমরা পুত্র হারালাম। আমার স্ত্রী দেহ রেখেছেন। আমিও আর এই দেহ রাখবো না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যেভাবে আমরা পুত্রশোকে দেহ ত্যাগ করলাম, তুমিও পুত্রশোকে ইহলোকে ত্যাগ করবে।” দশরথ বললেন- “মুনিন্দ্র আমি অপুত্রক। আমার কোন পুত্র নেই। কিভাবে আপনার শাপ বাস্তবায়িত হবে?” অন্ধ মুনি বললেন- “সম্রাট । ব্রাহ্মণের বাক্য কদাপি মিথ্যা হয় না। তুমি ঋষশৃঙ্গ মুনিকে এনে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ সম্পন্ন কর। তোমার অবশ্যই পুত্র হবে।” এই বলে অন্ধ মুনি প্রান ত্যাজিলেন । দশরথ তিনজনকে প্রনাম জানিয়ে বললেন- “আপনারা আশীর্বাদ দিলেন অভিশাপের ছলে।” এরপর রাজা তিনজনের দেহ সৎকার করলেন ।
তিনজন ব্রাহ্মণ হত্যা হওয়াতে রাজা দশরথ খুবুই শোকার্ত ও দুঃখিত ছিলেন। বিশেষত তিনি যখন রাজ্যে অর্থ, জমি দিয়ে ব্রাহ্মণ গণকে তুষ্ট রাখেন । এই কথা জানলো মাত্র সুমন্ত্র সারথি ও দশরথের সু পরামর্শদাতা । এখন কি হবে উপায় ? ব্রহ্মহত্যার পাপে দেবতারা না অভিশাপ প্রদান করেন গোটা অযোধ্যা নগরী কে । তিনি বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে গেলেন । এখানে একটু আলোচনা করলে মন্দ হয় না । “ব্রাহ্মণ” কে ? এই ক্ষেত্রে জন্ম সূত্রে পৈতেধারী বংশের বিপ্র গণ বলবেন – “তাঁরাই ব্রাহ্মণ”। সাথে কিছু স্মৃতির বুলি আউরে দেবেন । প্রথমে বলে রাখা প্রয়োজন- স্মৃতি গুলি যুগানুসারে লেখা। ঐ যুগ শেষ, ঐ স্মৃতি গুলির প্রয়োজনীয়তা শেষ । “শ্রীমদ্ভগবতগীতায়” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ মুখে চতুর্বর্ণের সংজ্ঞা দিয়েছেন । এছাড়া সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগে তপস্যার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ হতে হতো। যেমন ছিলেন বিশ্বামিত্র বা শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত সমাধি বৈশ্য । এঁনারা তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তি করেছিলেন । আর স্বয়ং নারায়ণ যখন অবতার ধারন করলেন তিনি এসে এই ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র মুনিকে গুরুপদে বরণ করলেন। রামচন্দ্রের অপর গুরু ছিলেন বশিষ্ঠ ও অগ্যস্ত । শ্রীরাম ক্ষত্রিয় কূলের ছিলেন। বংশে নয়- সাধন ভজনেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্তি সম্ভব , ভগবান রাম এই শিক্ষাই মানব জাতিকে দিয়েছেন । কিন্তু তাই বলে এটা ভাববেন না যে বর্তমানে যারা জন্মসূত্রে পৈতেধারী তাদের অসম্মান করবো । একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সব সাপের বিষ নেই। কিন্তু আমরা দাঁড়াশ, লাউডগা, ধরা ইত্যাদি নির্বিষ সাপ দেখলেও ভয় পাই। তাদের থেকে দূরে থাকি। তেমনি কলির বামুন তেজ, শক্তি, তপ শক্তি হীন। কিন্তু আমাদের কর্তব্য তাদের সম্মান করা ।
এই সম্মান বলতে কেউ ভাববেন না, বয়সে ছোটো ব্রাহ্মণ দের প্রনাম করা, তাঁদের পাদোদক পান, তাদের ছায়া না ডিঙানো, তাদের জুতা না ডিঙানো এগুলো। এগুলো চলে না। যেমন পূজা সকলেই করতে পারে। কিন্তু বারোয়ারী পূজা বা মন্দিরের পূজা বা বাৎসরিক পূজো, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি এই জন্মগত পৈতেধারীদের দিয়েই করাবেন । হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবারই অবদান আছে । ব্রাহ্মণ সমস্ত জাতিকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণ করবেন , ক্ষত্রিয় যুদ্ধ বিদ্যা দ্বারা গো- ব্রাহ্মণ- শাস্ত্র - নারী ও প্রজা রক্ষা করবেন । বৈশ্য ব্যবসা দ্বারা জাতির আর্থিক উন্নতি মজবুত করবেন আর শূদ্র সেবা দ্বারা সমাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবেন । দেখতে গেলে শূদ্রের অবদান কিছু কম নয়। সে ময়লা, আবর্জনা পরিষ্কার করে আমাদের করছেন জীবানুমুক্ত । রামায়নেই আমরা দেখবো ভগবান ভক্তের ভালোবাসায় মোহিত হয়ে শূদ্র ভক্তিনীর মুখের উচ্ছিষ্ট ফল পরম তৃপ্তির সাথে খেয়েছিলেন । ভগবান ছুঁৎমার্গ করেন না। তিনি শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে বেড়ান । যাকে তিনি ভালোবেসে নিজ শাশ্বত ধামে নিয়ে যাবেন । যাই হোক জন্মগত পৈতেধারী দেখলে আপনি শাস্ত্র নিয়ম মেনে তাকে সম্মান করবেন । পূজার পর দক্ষিণা দিবেন, খাওয়াবেন । আজকাল কার বিপ্ররা খুবুই দরিদ্র। আগের মতো অবস্থা নেই। সুতরাং হিন্দু হিসাবে আপনার কর্তব্য হিন্দুর পাশে দাঁড়ানো । যাই হোক রাজা দশরথ মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইতে গেলেন। বশিষ্ঠ মুনি সেসময় আশ্রমে ছিলেন না। তাঁর পুত্র বামদেব সব শুনে বললেন- “হে রাজন! দস্যু রত্নাকর পবিত্র ‘রাম’ নাম জপ করে মহর্ষি হয়েছেন। আপনি তিনবার রাম নাম জপ করুন । রাম নামে মহাপাপ খণ্ডন হয়।” রাজা দশরথ নদীতে স্নানাদি করে পবিত্র চিত্তে ‘রাম’ নাম জপ করে রাজ্যে ফিরে গেলেন । বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে পুত্র বামদেবের মুখে সব শুনে ক্রোধিত হয়ে বললেন- “মূর্খ। তুই রাজাকে তিনবার রাম নাম নিতে কেন বললি?” বামদেব জানালেন- “রাজা তিনটি ব্রহ্মহত্যা করেছেন তাই।”
বশিষ্ঠ মুনি শুনে আরো অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন- “ওরে মূর্খ । একবার ‘রাম’ নামে কোটি ব্রহ্মহত্যার পাপ নাশ হয়। তোর রাম নামে এত অবিশ্বাস যে রাজাকে তিনবার রাম নাম নিতে বললি ? যা গিয়ে নিষাদ কূলে জন্ম নে।” মুনিপুত্র বামদেব নিষাদ কূলে জন্ম নিয়েছিলেন। এর পেছনেও ভগবানের লীলা আছে । ভাবুন ‘রাম’ নামের কি মহিমা। রামায়ন বলেছে- “একবার ‘রাম’ নাম নিলেই কোটি ব্রহ্মহত্যার পাপ দূর হয়।” ভগবানের নামের এতই মহিমা । নিশ্চিন্ত হয়ে ভগবান রামের নাম করুন । যমের সাধ্যি নেই আপনাকে স্পর্শ করবার । তবে এখানে একটা কথা নাস্তিক ও ঘোর অদ্বৈতবাদী বলবেন- “তাহলে সমানে পাপ করবো আর রাম নাম জপে যাবো।” তেমন না। প্রতিদিন পাপ করে রাম নাম জপলে ভগবান রাম নিজেই শাস্তি দেবেন । ভগবান শুধরানোর সুযোগ সকলকেই দেন। আমাদের উচিৎ সেই শুধরানোর সুযোগ নিয়ে পাপ কর্ম থেকে বিরত হয়ে শাস্ত্র নির্দেশিত পথে চলা । তবেই এই রাম নাম কার্যকারী হবে। ব্রহ্মর্ষি হবার পর বাল্মিকী মুনি কিন্তু আর ডাকাতি করেন নি। জগাই মাধাই ভক্ত হবার পর আর কিন্তু পাপে নিমগ্ন হয়নি । সেই রকম । রোজ রোজ মহাপাপ করে কোটি কোটি নাম করলেও ভগবান আপনাকে ক্ষমা করবেন না ।
রাজা দশরথ বশিষ্ঠ মুনির সাথে কথাবার্তা বললেন । বশিষ্ঠ মুনি জানালেন অন্ধমুনির প্রদত্ত শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলবে । কিন্তু ইক্ষাকু বংশকে ধরে রাখবার জন্য পরবর্তী অযোধ্যার সম্রাট রূপে রাজার বংশজ ত চাই । নাহলে শত্রু রাজ্য অযোধ্যা দখল করবে। রাজা হীন রাজ্য আর তালাখোলা সিন্দুক এক সমান । রাজা নিজ জীবনের তোয়াক্কা না করে ‘পুত্রেষ্টি’ যজ্ঞ করতে মন দিলেন । ঋষশৃঙ্গ মুনিকে আনা হল । রাজা দূত পাঠিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের আমন্ত্রণ জানালেন। মুনি ঋষি দের সাদরে আহ্বান করলেন । বোধ হয় তখন ভারতে আর্য, অনার্য মিত্রতা হয় নি। এই মিত্রতার সূত্রপাত করেছিলেন ভগবান রামচন্দ্র। পরবর্তীতে দেখবো ভগবান রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে রক্ষ রাজ বিভীষণ, বানর কূলের সুগ্রীব, অঙ্গদ, হনুমান যোগ দিয়েছিলেন । কিন্তু দশরথ রাজার যজ্ঞে এনারা কেউ আসেন নি । রাবণের সাথে মিত্রতা হবার চান্স তো ছিলোই না, কিস্কিন্ধ্যা থেকেও কেউ আসেন নি । পুলোম, বিশ্বশ্রবা, অগ্যস্ত, বৈশ্যাম্পন, দুর্বাসা, গৌতম, জৈমিনী, পরাশর, ভৃগু, মতঙ্গ, কৌন্ডিন্য, নিশাকর, সনকাদি মুনি, মার্কণ্ড, ভরত, ভরদ্বাজ, পরশুরাম , অষ্টাবক্র, ভৃগু, কূর্ম, দক্ষ , গর্গ , শরভঙ্গ , বিশ্বামিত্র, শতানন্দ, কপিল, বেদবান, চক্রবান, সাবর্ণি , মৎস্যকর্ণি, সৌভরি , বাল্মিকী , বিভাণ্ডক ইত্যাদি ঋষি গণ তাঁহাদিগের বিশাল শিষ্য সহ এলেন । সপ্তর্ষি, জটায়ু আসলেন। অসুর গুরু শুক্রকেউ আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো, তিনি আসেন নি । অপরদিকে অন্য সব রাজা যেমন জনক, কাশী, লোমপাদ , তৈলঙ্গ, পুরন্দর, ঘনশ্যাম, চম্পেশর, মাগধ ইত্যাদি রাজা আসলেন । কৃত্তিবাসী রামায়নে এই সংখ্যা অনেক বেশী । ৮৮ লক্ষ কোটি রাজার কথা বলা হয়েছে ।
অযোধ্যা নগরীতে আনন্দের বাণ বইল । রাজা দশরথ নিজ মৃত্যু ভুলে সেই আনন্দে যোগ দিলেন । ব্রাহ্মণ গণ পরিবার সহিত অযোধ্যায় এলেন । সমগ্র অযোধ্যা মঙ্গল কলস, স্বস্তিক, ওঁকার ধ্বজা, কলা বৃক্ষ দিয়ে সাজানো হল । রাস্তা ঘাট পুস্প দ্বারা সজ্জিত করা হল । কৃত্তিবাসী রামায়নে লেখা ৮১ যোজন দীর্ঘ, ১২ যোজন প্রস্থ সমান ঘরে এই যজ্ঞ আরম্ভ হয় । মুনি গণ পবিত্র মন্ত্র আরম্ভ করলেন । যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত হল । ঋষশৃঙ্গ মুনি বৈদিক মন্ত্র পড়ে যজ্ঞে আহুতি দিতে লাগলেন । যজ্ঞ ধূমে পবিত সুগন্ধি সুবাস চতুর্দিকে ছেয়ে গেল । খাঁটি গব্য ঘৃত, উৎকৃষ্ট বনজ মৌমাছির মধু, মৃগ নাভি, কস্তূরী সুবাসিত বিবিধ দ্রব্য যজ্ঞদেবতাকে অর্পিত করা হল। যজ্ঞে আমরা যে আহুতি দেই সেই আহুতি অগ্নিদেবতা গ্রহণ করে বিভিন্ন দেবী দেবতার কাছে পৌছে দেন। যজ্ঞের বিধিবিধান ভুল বা ত্রুটি বা মন্ত্র অশুদ্ধ উচ্চারণে ভয়ানক কুপ্রভাব সৃষ্টি হয়। অগ্নি দেবতা বৈশ্বানর কুপিত হয়ে সর্বস্ব গ্রাস করেন । সেজন্য সর্বদা বেদজ্ঞ সংস্কৃত শাস্ত্র জ্ঞাত, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ দ্বারা যজ্ঞ করানো উচিৎ। ভোগী ব্রাহ্মণ দের দ্বারা নয় । যাই হোক রাজা দশরথের রাজ্যে দান ধ্যান আদি কর্ম করা হল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চার বর্ণের মানুষ দান পেলো । সকলে রাজার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন । অবশেষে যজ্ঞে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ সুসম্পন্ন করা হল । যজ্ঞের অগ্নি রাশি থেকে অগ্নি দেবতা স্বর্ণ পাত্রে চরু নিয়ে উঠে আসলেন ।
অগ্নিদেবতা বললেন- “রাজন! তোমার আয়োজিত যজ্ঞে দেবতাবৃন্দ অত্যন্ত প্রীত হয়েছেন । তোমার যজ্ঞ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে । এই চরু তোমার রানীদিগকে ভোজোন করাবে। তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।” রাজা দশরথ প্রথমে সেই চরু কৌশল্যা ও কৈকয়ীর মধ্যে ভাগ করে দিলেন । কিন্তু রানী সুমিত্রা এসে সেই চরুর ভাগ চাইলো। তখন কৌশল্যা ও কৈকয়ী নিজের অংশের থেকে অল্প ২ জনে ২ অংশ সুমিত্রাকে দিলেন । এভাবে তিন রানী অগ্নি দেবতা প্রদত্ত চরু ভক্ষণ করলেন । কালে কালে তিন রানীর গর্ভের লক্ষণ প্রকাশ পেলো। মহারানী কৌশল্যার শরীরে দিব্যজ্যোতি দেখা দিলো । তাঁর রূপ ফুটে উঠলো । যারা এসময় কৌশল্যাকে দেখতেন তারা অবাক হতেন যেমন মানব শরীরে এমন দেবজ্যোতি ! কৌশল্যা দেবীর গর্ভে অবস্থান করছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীহরি । শুধু তাই নয়, এই সময় কৌশল্যা দেবী অনেক দিব্য দর্শন লাভ করতেন । সুরবৃন্দ করতেন কি কৌশল্যা দেবীকে দর্শন করতে আসতেন । মানব হয়ে সচরাচর দেবতার দর্শন পাওয়া যায় না । এমন কারণে কৌশল্যা দেবী মাঝে মাঝে ভীত হতেন । নানারকম দেবতার স্বপ্ন দেখতেন । ব্রহ্মা, শিব দর্শন পেতেন । ধীরে ধীরে ভগবান, কৌশল্যার গর্ভে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন ।
চৈত্র মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে অবশ্যই রাম নবমী তিথি পালন করুন । জন্মাষ্টমীর মতোন নিয়ম । তবে শ্রীরামের জন্ম দ্বিপ্রহরে । তাই পূজা দ্বিপ্রহরে ১ টার মধ্যে সমাপন করবেন । উপোবাসী থেকে পূজাদি করে প্রসাদ সেবা নিয়ে ভগবানের নাম কীর্তন করে পালন করবেন এই তিথি । পূজাতে আপনার সাধ্য মতো ফলমূল ও একটি লাড্ডু হলেও দিবেন। কেউ কেউ মাটির সড়ায় ছাতু, মধু, দৈ, ঘৃত , শর্করা একত্রে দেন । ভগবানের পূজার আড়ম্বর নেই। যার যেমন সামর্থ্য। ভগবান রাম শবরীর দেওয়া উচ্ছিষ্ট জাম ফল খেয়েই তুষ্ট হয়েছিলেন । গর্বে উন্মত্ত হয়ে রাশি রাশি ভোগ দিলে ভগবানের কাছে তা বিষ, আবার ভক্তিভাবে এক পাত্র জল দিলেই তিনি তা আনন্দে সেবা করেন । সুদামার তিন মুঠ চিড়াতেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন , আবার বিদূরের স্ত্রী , ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে ভক্তিভাবে এতই উন্মত্ত হয়েছিলেন যে কলা খেতে দিয়ে ভাবে মোহিত হয়ে নিজেই কলা ছুলে কলার পরিবর্তে কলার খোসা নিবেদন করেছিলেন । আর ভগবান হাসতে হাসতে সেই কলার খোসা সেবা নিয়েছিলেন ।