ভগবান ভক্তের প্রদত্ত যেমন পূজা, নৈবদ্য সানন্দে গ্রহণ করেন, তেমনি ভক্ত রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিলে ভগবান সানন্দে তা মাথা পেতে গ্রহণ করেন । ভগবান শ্রী হরির পরম ভক্ত নারদ মুনির কথা শোনা যাক । একবার নারদ মুনি হিমালয়ে কঠিন যোগসাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন । অবিরত তুষারপাতেও তাঁর সেই সাধনা ভঙ্গ হয়নি। দেবতারা এসে তাকে আহ্বান করলেও তিনি যোগসাধনা ভঙ্গ করেননি । ইন্দ্রদেবতা তখন মদন দেব ও রতি দেবীর শরণাপন্ন হলেন। মদন দেবতা হিমালয়ে সেই তুষারাছন্ন পরিবেশে বসন্ত সৃষ্টি করে নারদ মুনিকে কামবাণ নিক্ষেপ করে বিদ্ধ করলেন। কিন্তু মদনের বাণ উপেক্ষা করেই নারদের যোগ সাধনা চলতে লাগলো। অবশেষে একদিন নারদের যোগা সমাপ্ত হোলো। নারদ মুনি নিজেকে শিবতুল্য জ্ঞান করলেন, যেহেতু কাম বাণে দেবাদিদেবের মনে কাম জাগেনি, সেইরূপ নারদের ওপর কামবাণ ব্যর্থ হয়েছে- সেইহেতু নারদ মুনি নিজেকে শিবতুল্য জাহির করলেন। নারদের এরূপ অহংকার দেখে প্রজাপতি ব্রহ্মা চিন্তায় পড়ে বৈকুণ্ঠে গেলেন। ভগবান নারায়ণকে অনুরোধ জানালেন নারদের দর্প চূর্ণ করতে । ভগবান নারায়ণ একটি অদ্ভুত লীলা করলেন। যোগমায়া শক্তি অবলম্বন করে একটি মায়াপুরী নির্মাণ করলেন । তথায় সমুদ্র রাজা রত্নাকর কে রাজা বানিয়ে বসালেন। লক্ষ্মী দেবীর অংশ রূপিনী এক সুন্দরী সুশীলা কন্যা সেই রাজ্যের রাজকণ্যা হয়ে নিবাস করতে লাগলেন। বিষ্ণু মায়াতে সেখানে প্রজাদি ঘর গৃহ নির্মিত হল ।
একদা নারদ মুনি ভ্রমণ করতে করতে সেই রাজ্যে উপস্থিত হলেন । তথায় তিনি রাজকণ্যাকে দেখে মোহিত হয়ে ভাবেন এই রাজকন্যাকেই বিবাহ করবেন । রাজকন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন- “হে কন্যে তুমি কেমন পতি আশা কর?” কন্যা বললেন- “আমি হরি সদৃশ পুরুষ কেই পতি রূপে গ্রহণ করবো।” নারদ মুনি ছদ্দবেশী রত্নাকর কে জানালেন শীঘ্র মেয়ের স্বয়ম্বর আয়োজন করতে । এই বলে নারদ মুনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে নারায়ণকে বললেন- “প্রভু আমাকে হরি মুখ করে দিন।” হরি শব্দের এক অর্থ বানর , যেহেতু বানর সুযোগ পেলেই হরণ করে। শ্রী নারায়ণ নারদ মুনিকে বানর মুখী করে দিলেন । নারদ মুনি আয়না তে নিজ মুখ না দেখেই স্বয়ম্বরের দিন সেই রাজ্যে গেলেন। তাকে দেখে সকলে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলো । নারদ মুনি ধারনা করলেন তাঁর সুন্দর মুখ দেখে হয়তো সকলে হিংসা বশত হাস্য করছে । কন্যা বরমাল্য নিয়ে ঘুরতে লাগলো। মর্কটের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নারদ মুনি তার আগে পিছে ঘুরতে লাগলো। কিন্তু কন্যা কিছুতেই তাকে বরমালা দিলেন না । হঠাত সভা মাঝে শ্রী নারায়ণ আবির্ভূত হলেন। কন্যা শ্রী নারায়নের কণ্ঠে মাল্য দিলেন। এই দেখে নারদ মুনি রেগে নদীর ধারে চলে গেলো। জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বৈকুণ্ঠে গিয়ে বলল- “প্রভু আপনি আমাকে ছলনা করলেন?” নারায়ণ বললেন- “দেবর্ষি তুমি হরি মুখ চেয়েছিলে, হরি শব্দের এক অর্থ বাঁদর, তুমি তো বল নি যে আমার মতোন মুখাবয়ব প্রদান করতে।” নারদ মুনি বললেন- “হে প্রভু। আপনি আমাকে যে ছলনা করলেন তার শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। আমি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি যেমন আমি সেই রাজকণ্যাকে হারালাম , আপনিও আগামী অবতারে বারংবার স্ত্রী বিচ্ছেদের কষ্ট পাবেন।”
নারদের অভিশাপ বাক্য মাথা পেতে নিলেন নারায়ণ । তখন ব্রহ্মা প্রকট হয়ে বললেন- “পুত্র তোমার গর্ব চূর্ণ করবার জন্যই এই লীলা রচনা হয়েছে । সেই কণ্যা স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী। আর সেই রাজা লক্ষ্মী দেবীর পিতা রত্নাকর। তুমি ব্রহ্মচারী, তোমার মনে এইহেন চিন্তা কিভাবে আসে ? কিভাবে তুমি নিজেকে শিবতুল্য মনে কর ?” নারদ মুনির দর্প চূর্ণ হল। তিনি বুঝলেন তিনি মহাপাপ করেছেন। বারংবার নারায়নের চরণে ক্ষমা প্রার্থনা চাইলেন । শ্রীনারায়ন জানালেন , “ভক্তের অভিশাপ অসত্য হবে না। তোমার অভিশাপে বারংবার আমার আর লক্ষ্মী দেবীর বিচ্ছেদ ঘটবেই।” অপরদিকে রাবনের দিগ্বিজয় বেড়ে চলল। যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, কিন্নর, অসুর, দেবতা, মানব ইত্যাদিরা রাবণের বশ্যতা স্বীকার করলো । কিন্তু সে যখন পাতালপুরী অসুর রাজ বলির রাজ্য আক্রমণ করলো- তখন তার আর রক্ষা থাকলো না। বলির সাথে যুদ্ধে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হোলো। বলি রাবণকে বন্দী বানিয়ে কারাগারে আটকে রাখলো। শেষে মহর্ষি পুলস্ত্য এসে বলিকে অনুরোধ জানিয়ে রাবণ কে মুক্তি করলো ।
ইক্ষাকু ক্ষত্রিয় কূলে ভগবান শ্রীরাম আবির্ভূত হয়েছিলেন । ইক্ষাকু কূলের মহান দাতা রাজা হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান রামায়নে আছে । ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র মুনির ফুলে ফলে শোভিত বাগানে প্রত্যহ স্বর্গ থেকে দেবকন্যারা এসে ফুল, ফল নিয়ে যেতো। বিশ্বামিত্র মুনি, তাঁর শিষ্যদের চৌকিদারীতে রেখেও সুফল পেলেন না, দেবতাদের মায়ায় শিষ্যরা নিদ্রামগ্ন হতেই দেবকন্যারা ফুল, ফল নিয়ে গেলো। একদিন মুনি বিশ্বামিত্র তপঃ তেজে নিজে এক মায়া রচলেন। যেই মায়াতে দেবকন্যারা ফুল নিতে আসলে লতাপাতার বেস্টনীতে জড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলো। রাজা হরিশ্চন্দ্র সেখান দিয়ে যাবার সময়, সেই দেবকন্যাদের মুক্ত করলেন। বিশ্বামিত্র মুনি যোগবলে সব জেনে ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা হরিশ্চন্দ্রকে বললেন- “হে সম্রাট। তুমি কেন সেই দেবকন্যাদের মুক্তি করেছো?” রাজা বললেন- “হে মহর্ষি সেই দেবকন্যারা আমার নিকট মুক্তি ভিক্ষা চেয়েছিলো। আমি দাতাকে তাঁর ইস্পিত সম্পদ দান করি। ইহা আমার জীবনের প্রতিজ্ঞা।” বিশ্বামিত্র শুনে বললেন- “তাই যদি হয়, তবে তুমি তোমার রাজ্য সম্পদ এখুনি আমাকে দান করে এক বস্ত্রে বিদায় হও। আমি তোমার কাছে তোমার রাজ্য দান চাইছি। ” রাজা হরিশ্চন্দ্র তাই দান করে এক বস্ত্রে বেরিয়ে গেলেন। সাথে থাকলো মহারানী শৈব্যা, পুত্র রোহিতাশ্ব ।
রাজা সসাগড়া রাজ্য মুনিকে দান করেছেন, তাই পৃথিবীতে আর কোথাও যাওয়া যাবে না। কিন্তু কাশীধাম কোনো রাজার রাজত্বে নয়। কাশীধাম ভগবান শিবের ত্রিশূলে অবস্থিত। এই স্থানের রাজা ভগবান শিব । রাজা হরিশ্চন্দ্র স্ত্রী, পুত্র নিয়ে কাশীধামে আসতেই বিশ্বামিত্র পুনঃ এসে বলল- “রাজা দান তো দিলে, কিন্তু দক্ষিণা কই ?” রাজা হরিশ্চন্দ্র তখন নিজ স্ত্রী শৈব্যা আর পুত্র রোহিতাশ্ব কে কাজের ঝি হিসাবে বিক্রি করে দিলেন। নিজেও চণ্ডালের কাছে বিক্রিত হয়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র কে দান দিলেন। তবুও মুখের প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গলেন না । মহারানী শৈব্যা আর রাজপুত্র রোহিতাশ্ব ঝিগিরি করে বহু কষ্টে দিন যাপন করতে লাগলো । অপরদিকে হরিশ্চন্দ্র কাশীর শ্মশানে ডোম হয়ে জীবন কাটাতে লাগলেন । একদিনের কথা, রোহিতাশ্বকে সর্পে দংশন করলো। ছটফট করতে করতে মায়ের কোলেই মারা গেলো। রানী শৈব্যা কাশীর শ্মশানে পুত্রকে দাহ করতে গেলেন । অন্ধকার রাত্রিতে সেখানে ডোম রূপে হরিশ্চন্দ্রের দেখা পেলেও একে অপরকে চিনলো না। শৈব্যা তখন ডোম হরিশ্চন্দ্রকে দাহ করতে বললে, হরিশ্চন্দ্র বলল- “মূল্য ছাড়া দাহ হবে না। এ আমাদের সর্দারের আদেশ। যাও মূল্য নিয়ে এসো। ” শৈব্যা কাঁদতে কাঁদতে জানালো- মূল্য নেই। সে নিজেই পড়ের বাড়ীর ঝি। অবশেষে শৈব্যা নিজের মলিন ছিন্ন বস্ত্র থেকে সামান্য বস্ত্র ছিড়ে হরিশ্চন্দ্র কে দিয়ে বলল- “এই নিন। আমার কাছে আর কিছুই নেই।”
রাজা হরিশ্চন্দ্র চিতা সাজিয়ে মৃত রোহিতাশ্বকে রেখে মশাল আনতে গেলো। মশাল নিয়ে এসে চিতায় শায়িত নিজ পুত্রকে দেখে ক্রন্দন করতে লাগলেন। শৈব্যা আর হরিশ্চন্দ্রের মিলন হোলো। মৃত পুত্রকে জড়িয়ে হরিশ্চন্দ্র আর শৈব্যা খুব কাঁদলেন । তারপর হরিশ্চন্দ্র তিনটে চিতা সাজালেন, ঠিক করলেন পুত্রের চিতায় আগুন দিয়ে তারাও চিতেতে উঠে অগ্নিতে নিজেদের ভস্ম করবেন । ঠিক এই সময় শ্মশান আলো করে কাশীর রাজা ভগবান শিব ও কাশীর রাণী মাতা গৌরী আবির্ভূত হলেন। ভগবান শিব মহারাজ হরিশ্চন্দ্র আর রানী শৈব্যার প্রশংসা করে রোহিতাশ্বকে প্রাণদান করলেন । রোহিতাশ্ব তার পিতামাতাকে ফিরে পেলো। অপরদিকে মহর্ষি বিশ্বামিত্র মুনি সেখানে উপস্থিত হলেন। বললেন- “হে রাজন। আমি তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। তুমি সত্যি মহান দাতা। সত্যবাদীর সাক্ষাৎ রূপ। যাও তোমাকে তোমার রাজ্য ফিরিয়ে দিলাম। আজ থেকে তুমি সত্যবাদী রাজা হরিশ্চন্দ্র রূপে খ্যাত হবে।” রাজা হরিশ্চন্দ্র তখন রানী শৈব্যা ও রোহিতাশ্বকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরলেন। রাজা আবার রাজাসনে বসলেন। মহারানী শৈব্যা পুত্র রোহিতাশ্বকে ক্রোড়ে নিয়ে রাজার বামে বসলেন। ত্রিলোকে রাজার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো ।
রামায়ন কথা অপূর্ব সঙ্গীত ।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কৃত্তিবাস পণ্ডিত ।।
মহারাজ হরিশ্চন্দ্রের অপূর্ব আখ্যান ।
ত্রিলোকে গাহে রাজার কীর্তি ব্যাখান ।।
ইক্ষাকু বংশীয় রাজা ভগীরথ স্বর্গ থেকে পতিত পাবনী গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন পূর্বপুরুষ দের মুক্তি প্রদান করবার জন্য। এই মহান ইক্ষাকু বংশে ভগবান রাম আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগীরথ ছিলেন ভগবান রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ । ইক্ষাকু বংশীয় রাজা ছিলেন মহারাজ সগর । তাঁর দুই স্ত্রী ছিল- কেশিনী ও সুমতি। কেশিনীর গর্ভে অসমঞ্জ নামক পুত্র জন্মায়। পৌরানিক গাঁথা অনুসারে সুমতির ৬০ হাজার পুত্র ( এখানে বলা প্রয়োজন কোনো মানবীর পক্ষে ৬০ হাজার সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। হয়তো রাজার ৬ টি সন্তান ছিলো, বাকীরা ছিলো সেনা। রাজা হলেন প্রজার পিতা। তিনি সেনাদেরও পিতা। কারন সেনারাও একভাবে রাজার প্রজা। তাই সব মিলিয়ে ৬০ হাজার বলা হয়েছে। একটা রাজ্যে ৬০ হাজার সেনা থাকা অস্বাভাবিক নয়।) সন্তান জন্মায় । একদা রাজা সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। অশ্ব দিগবিদিক পরিক্রমা করলো- ৬০ হাজার রাজপুত্র তাঁর পেছন পেছন গিয়ে নানা রাজ্য জয় করে রাজধানীর থেকে ফিরতে লাগলো। এমন সময় দেবতাদের রাজা ইন্দ্রদেবতা যজ্ঞের অশ্ব চুরি করে কপিল মুনির আশ্রমে রেখে আসেন চুপিসারে। অশ্বের খোঁজে ৬০ হাজার রাজপুত্র খুঁজতে খুঁজতে কপিল মুনির আশ্রমে অশ্ব দেখতে পেয়ে মুনিকে চোর, বদমাশ, ভণ্ড বলে গালাগালি করতে লাগলেন। কপিল মুনি শাপ দিয়ে ৬০ হাজার রাজপুত্রকে ভস্ম করলে ৬০ হাজার রাজপুত্র প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে মুক্তির জন্য ছটফট করতে লাগলো। রাজবাড়ীতে খবর গেলো। অসমঞ্জের ছেলে অংশুমান গিয়ে মুনির আশ্রম থেকে অশ্ব নিয়ে এসে কোনো রকমে যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। ৬০ হাজার রাজপুত্রের আত্মার মুক্তির জন্য কুলগুরু বশিষ্ঠ স্বর্গ থেকে গঙ্গা কে মর্তে আনার পরামর্শ দিলেন ।
গঙ্গাকে মর্তে আনার জন্য তপস্যা করতে করতে রাজা সগর, অসমঞ্জ, অংশুমান, দিলীপ রাজা মারা গেলেন, তবুও ব্রহ্মা দর্শন দিলেন না। অন্তিমে রাজা দিলীপের পুত্র ভগীরথ তপস্যা করে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করলেন। ব্রহ্মার কাছে গঙ্গাকে মর্তে আনার বর চাইলেন । পরমপিতা ব্রহ্মা জানালেন – “গঙ্গা সরাসরি মর্তে আসলে পৃথিবী রসাতলে প্রবেশ করবে, গঙ্গার প্রচণ্ড বেগ ধরিত্রী দেবী সহ্য করতে পারবেন না।তুমি ভগবান শিবের তপস্যা করো। তিনি আধার রূপে গঙ্গাকে ধারন করে পতন উম্মুখ গঙ্গার বেগ রোধ করতে পারেন।” ভগীরথ ভগবান শিবের তপস্যা করে সন্তুষ্ট করলেন ভগবান শিবকে । স্বয়ং গঙ্গা দেবী যখন স্বর্গ থেকে মর্তে প্রবাহিত হচ্ছিল্ল, হিমালয়ে ভগবান শিব গঙ্গা কে জটায় আবদ্ধ করলেন। ভগবান শিবের এক নাম তাই গঙ্গাধর । তারপর তিনি গঙ্গাকে মুক্ত করলেন। ভগীরথ আগে আগে যেতে লাগলো, গঙ্গা তার পিছে, পথে এক হস্তী গঙ্গা দেবীকে কুপ্রস্তাব দিলে, গঙ্গার ভীষন স্রোতে তার প্রান ওষ্ঠাগত হলে, ক্ষমা চাইলে মা গঙ্গা তাকে জীবন দান করলেন। জহ্নু মুনির আশ্রম গঙ্গা দেবী ভাসিয়ে দিলে মুনি ক্রোধে গঙ্গাকে পান করেন, পুনরায় কর্ণ দ্বারা বের করেন। তাই গঙ্গার এক নাম জাহ্নবী। অন্তিমে কপিল মুনির আশ্রমের কাছে গঙ্গা দেবী এসে ৬০ হাজার রাজপুত্রের অস্থি ভাসিয়ে দিলেন। গঙ্গার পবিত্র স্পর্শে ৬০ হাজার প্রেতাত্মার সদ্গতি হল। সেখানেই তিনি সাগরে বিলীন হলেন। গঙ্গাকে ভগীরথ এনেছিলেন, তাই গঙ্গার নাম ভাগীরথী ।
ভোগোলিক তথ্যে গঙ্গার উৎপত্তি গোমুখী শৃঙ্গ থেকে। আকাশ ( স্বর্গ ) থেকে পতিত মেঘের জল ও তুষার গলিত জল একত্রিত হয়ে গঙ্গা নদীর সৃষ্টি। গঙ্গা যেখানে অলকানন্দার সহিত মিলিত হয়েছেন সে স্থানের নাম দেবপ্রয়োগ । যেখানে যমুনা ও গপ্তা সরস্বতীর সাথে মিলিত হয়েছেন সে স্থানের নাম ‘প্রয়োগ’ বা ‘ত্রিবেনীসঙ্গম’। গঙ্গার সহিত গোমতী, ঘর্ঘরা, শোন, বরুণা, অসি, গণ্ডকী, কুশী, রূপনারায়ন ইত্যাদি বহু নদ নদী মিলিত হয়েছে । ভগীরথ কিন্তু কেবল নিজ পূর্বপুরুষ দের মুক্তির কথাই ভাবেন নি। প্রজা কল্যাণের জন্য তথা পূর্বপুরুষদের মুক্তির জন্য ইক্ষাকু বংশীয় সগর, অসমঞ্জ, অংশুমান, দিলীপ রাজারা ভোগবিলাস ত্যাগ করে তপস্যা করতে করতেই প্রান ত্যাজেছিলেন । এমনই মহান বংশ ইক্ষাকু রাজবংশ । অন্তিমে ভগীরথ কাজটি সম্পূর্ণ করেছিলেন । এই বংশের রাজারা প্রতিজ্ঞার জন্য, প্রজা কল্যাণের জন্য নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিতেও পিছপা হতেন না । গঙ্গা এনে সমগ্র মানবজাতির মুক্তির দ্বার উন্মোচন করার জন্য ইক্ষাকু রাজবংশ খ্যাতনামা হয়ে আছেন ।
দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি গঙ্গে,
ত্রিভুবনতারিণি তরলতরঙ্গে ।
শঙ্করমৌলিনিবাসিনি বিমলে,
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে ।।
মহান ইক্ষাকু বংশকেই ভগবান নারায়ণ তাঁর আবির্ভাবের কেন্দ্র রূপে বেছে নিয়েছিলেন । কেন ? কারণ সুপিতামাতা বা মহান উদার বংশ না হলে ভগবান সেই কূলে কিভাবে আবির্ভাব হবেন ? ত্যাগী, সত্যবাদী, সংযমী এমন কূলেই ভগবান আবির্ভূত হন । যেমন কশ্যপের সন্তান রূপে ভগবান শ্রীগোবিন্দ , বামন রূপে প্রকট হয়েছিলেন । মহর্ষি জমদাগ্নি সন্তান রূপে ভগবান হরি পরশুরাম রূপে আবির্ভূত হলেন । আবার দেবকী, বসুদেবের উদার চিত্ত- বিশেষ করে বসুদেবের আত্মত্যাগ নিজের সন্তান দের কংসের হাতে তুলে দিয়েছেন কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গেন নি । ভগবান অবতার গ্রহণ করেছেন এমন বংশেই । ইক্ষাকু বংশীয় ভগবান রামের পূর্বপুরুষ মহারাজ রঘু ছিলেন এমনই ন্যায় নীতি পরায়ণ । দানে, বীরত্বে, ত্যাগে ছিলেন অটল । একদিন ইন্দ্রদেবতা ও যমদেবতা মিলে মহারাজ রঘুর পরীক্ষা নিচ্ছিল্লেন । ইন্দ্রদেবতা একটি কপোত অপরদিকে যম দেবতা একটি বাজপাখীর রূপ নিলেন । আকাশ মার্গে কপোত , বাজের থাবা দেখে বাঁচতে মহারাজ রঘুর কাছে গিয়ে বললেন- “হে রাজন। আমাকে ঐ বাজের হস্ত থেকে রক্ষা করুন।” মহারাজ রঘু তখন বাজকে বললেন- “হে বাজ। তুমি প্রস্থান করো। এই কপোত এখন আমার শরণ নিয়েছে। আমি একে পরিত্যাগ করতে পারি না।” বাজ রূপী ধর্মরাজ বললেন- “ওহে রাজন। তুমি একে শরণ দিয়ে নিজ ধর্ম পালন করছ। কিন্তু ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কাছে থেকে তাঁর মুখের আহার কেড়ে নেওয়া, বা তাকে খেতে বাধা দেওয়া তো পাপ। ঐ কপোত আমার আহার। ঈশ্বর আমাকে এই ভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তুমি আমার আহার কেড়ে আমার সাথে অধর্ম করছ।”
মহারাজ রঘু দেখলেন তাইতো। বাজের আহার কেড়ে নেওয়াও অধর্ম, আবার শরণাগত কে বিপদে ঠেলে দেওয়াটাও পাপ । মহারাজ রঘু বললেন- “বল বাজ। এই মুহূর্তে আমি কি করবো ? শরণাগতকে ত্যাগ করা আমার কূলের রীতি নয়। অতএব তাই এই কপোতকে কিছুতেই আমি তোমাকে দিতে পারবো না। তোমাকে অন্য আহার আমি প্রদান করবো । ” বাজ বলল- “মহারাজ। হয় আমাকে ঐ কপোত প্রদান করুন, অন্যথায় ঐ কপোতের ওজনের সমপরিমাণ আপনার দেহের মাংস প্রদান করুন। ইহা ভিন্ন আমার অন্য কিছু চাই না। যদি আপনি আমাকে এই দুটির মধ্যে একটিও না প্রদান করেন তবে আপনার নামে অযশ হবে।” মহারাজ রঘু দাঁড়িপাল্লা আনলেন। একটি দিকে কপোত কে রাখলেন, অপর দিকে নিজের দেহ থেকে চাকু দিয়ে মাংস কেটে রাখতে থাকলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ! কত মাংসের টুকরো রাজা নিজ দেহ থেকে দিলেন, তবুও দাঁড়িপাল্লা সমান আর হয় না। রাজার সর্বাঙ্গ রক্তে প্লাবিত হচ্ছে, তবুও রাজা নিজ দেহের নানান স্থান থেকে ছুড়ি দিয়ে মাংস কেটে দাঁড়িপাল্লায় রাখছেন । শেষে রাজা নিজ হৃৎপিণ্ড উপরে দিতে গেলেন। তখন কপোত আর বাজ স্বরূপ ধরলেন। ইন্দ্র দেবতার কৃপায় রাজা সুস্থ হলেন। ইন্দ্র ও যম বললেন- “মহারাজ রঘু। আমরা আপনার পরীক্ষা নিচ্ছিল্লাম। ধন্য আপনার কূল। ধন্য আপনি। নিজ কর্ম নিজ জীবন দিয়েও পালন করতে চলেছিলেন। আমাদের আশীর্বাদে আপনার নাম যশ ত্রিলোকে বৃদ্ধি পাবে।”
এই ইক্ষাকু বংশে অনরণ্য নামক এক রাজা ছিলেন। বয়সের ভারে তিনি বৃদ্ধ অবস্থায় পৌছেছিলেন । দক্ষিণ ভারতে যখন রাক্ষসদের অত্যাচার শুরু হয়েছিলো, বহু মুনি ঋষি সে সকল স্থান ছেড়ে উত্তর ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে সুগ্রীবের দাদা বালি কিছুটা সহায় হয়েছিলেন। বালি নিজেও শেষ জীবনে অধর্ম করলেও তিনি লঙ্কার বহু রাক্ষস দের মেরে মুনি ঋষি দের রক্ষা করেছিলেন। পরবর্তী পর্বে সেগুলো দেখা যাবে । অনরণ্য রাজার সময়ে বালি বা হনুমানের আবির্ভাব হয় নি । বৃদ্ধ রাজা রাবণের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। রাক্ষসদের হাতে অযোধ্যা সেদিন পরাজিত হয়েছিলো। রাজা অনরণ্য নিজেও রাবণের হাতে বধ হলেন। মরবার আগে রাজা অনরণ্য, রাবণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন- “ ইক্ষাকু বংশ কে এত সাধারন ভেবো না দশানন। এই বংশের কোনো একজনের হাতে তুমি নিহত হবে।”
রাবনের ত্রিভুবন বিজয়ের ইচ্ছা বেড়েই চলল। মহারাজ কার্ত্তবীর্য্যার্জুন সহস্র বাহু শক্তি হবার বর প্রাপ্তি করেছিলেন । তাঁর দেহে একশো মত্ত হস্তীর বল ছিলো। রাবণ তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় । শেষে মহর্ষি পুলস্ত্য পুনঃ এসে রাবণকে উদ্ধার করেন। মহর্ষি পুলস্ত্য বলেন- “হে রাবণ! তুমি আমার বংশজ। বারংবার কেন তুমি পূর্বপুরুষদের কলঙ্ক দিচ্ছ ? তোমার কৃত কর্মের জন্য আমি লজ্জা বোধ করছি। তুমি সৎ ধার্মিক হও। তুমি শাস্ত্রবিদ। আয়ুর্বেদের বহু ঔষধি তোমার করায়ত্ত । তুমি ধার্মিক হয়ে মানব কল্যাণ করো।” রাবণ কিন্তু মহর্ষির কথা শোনে নি । অপরদিকে কার্ত্তবীর্য্যার্জুন মহর্ষি জমদাগ্নির আশ্রম তছনছ করে জমদাগ্নিকে হত্যা করে , সর্ব অভীষ্ট প্রদায়ক কামধেনু গাভী হরণ করে। এরপর ভগবান পরশুরাম কার্ত্তবীর্য্যার্জুনকে বধ করে । রাবণের হাতে বহু কন্যা লাঞ্ছিত হয়েছিলো। কোনো এক কন্যা অভিশাপ দিয়েছিলো- “ দুরাচারী দশানন। আমার মতোই অপহৃতা নারীর জন্যই তুমি সবংশে নিহত হবে। তোমার কূলে কেউ বাঁচবে না।” রাবণ এসব অভিশাপকে মোটেও গুরুত্ব দিতো না ।
মাতা লক্ষ্মী দেবী ভগবান বিষ্ণুকে পতি রূপে প্রাপ্তির জন্য ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন । তাঁর নাম ছিলো বেদবতী । ভগবান বিষ্ণুকে প্রাপ্তি করবার জন্য তিনি অখন্ড ব্রহ্মচর্য পালন করে কঠোর উপাসনায় ব্রতী হয়েছিলেন । বেদবতী যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান করছিলেন। ঠিক সেসময় রাবণ সেখানে উপস্থিত হল । বেদবতীর রূপে মোহিত হয়ে রাবণ বলল- “হে সুমুখী। তুমি কেন বৃথা তপস্যায় ক্লেশ ভোগ করছ ? তুমি আমাকে বিবাহ করো। আমি তোমাকে লঙ্কায় নিয়ে যাবো। তুমি লঙ্কায় ভোগ বিলাসে জীবন কাটাবে।” বেদবতী ঘৃনা ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে জানালো- “দুষ্ট। ভগবান বিষ্ণু ব্যাতীত কেউ আমার পতি হতে পারেন না। আমি তাঁহাকেই পতি রূপে প্রাপ্তির জন্য এই যজ্ঞের আয়োজন করছি।” রাবণ ক্রোধিত হয়ে বেদবতীর কেশ আকর্ষণ করে বলল- “তুমি আমার সহিত না গমন করলে বল পূর্বক তোমাকে হরণ করে বিবাহ করবো।” বেদবতী অনেক বুঝালো রাবণ শুনলো না । অতঃ বেদবতী রাবণকে অভিশাপ দিয়ে বলল- “ হে রাবণ। আমি এই শরীর ত্যাগ করবো। তোমাকে অভিশাপ প্রদান করছি পরজন্মে তোমার কাল রূপে আবি আবার আবির্ভূত হব। আমি তোমার ধ্বংসের কারণ হব। আমার জন্যই রাক্ষস কূল ধ্বংস হবে। সেই ধ্বংসের আগুন তোমাকেউ গ্রাস করবে।” বেদবতী এই বলে অগ্নি দেবতাকে আহ্বান করে নিজেকে ভস্মীভুত করলেন । এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলো ত্রিলোক ।
রাবণ শুনেছিলো তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইকে ভগবান শিব কৈলাসে আশ্রয় দিয়েছেন। কুবেরকে ধ্বংস করার প্রস্তাব রাবণের মাতা কেকসী রাবণকে দিয়েছিলো । পুস্পক রথে চড়ে রাবণ কৈলাসে আক্রমণ করলো । কৈলাসের বিশাল গিরিশৃঙ্গের সামনে নন্দী মহারাজ ছিলেন পাহারায় । রাবণের সাথে নন্দী মহারাজের যুদ্ধ হোলো। কিন্তু ব্রহ্মার বর প্রাপ্ত রাবণকে পরাজিত করতে পারলো না । নন্দীদেব রাবণের হাতে অর্ধমৃত হল । নন্দী মহারাজের বিশাল শিং, লম্ব কর্ণ দেখে রাবণ উপহাস করে বলতে লাগলো – “ওরে তুই নর না বানর ? তোর শরীর নরের আবার বানরের মতো লম্ফঝম্ফ করছ? তুমি আদতে কি?” রাবনের উপহাস শুনে নন্দী মহারাজ কুপিত হোলো। নন্দী মহারাজ রাবণকে অভিসম্পাত করে বলল- “তুমি আমাকে নর বানর বলে উপহাস করলে। তোমাকে শাপ দিচ্ছি হে দশগ্রীব, তুমি ঐ নর বানরের হাতেই বিনাশ প্রাপ্ত করবে।” রাবণ মোটেও ভীত না হয়ে বলল- “ওহে মূর্খ। নর জাতি আমার অনুচর রাক্ষসদের আহার্য, আর বানরকে পায়ে পিষে মারবার ক্ষমতা রাক্ষসদের আছে। তোমার অভিশাপ কোনোকালেই ফলবে না।” নন্দী মহারাজ শিবভক্ত। তিনি পূর্বে দক্ষ প্রজাপতিকে ছাগ মুণ্ড হবার বর দিয়েছিলেন । নন্দী মহারাজের অভিশাপ ফলেছিল ।
রাবণ নন্দীদেবের অভিশাপ পেয়েও দমে নি। কৈলাসের দিকে অগ্রসর হবার সময় নন্দীকে মহাদেব আদেশ দিলেন রাবণের গতি রোধ না করতে । নন্দী বললেন, “রাবন তুমি জানো না কৈলাস মহাদেবের স্থান । তুমি ভগবান শিবের ধামে আক্রমণ করেছো। এবার দেখো তোমার কি গতি হয়।” রাবণ বলল- “আজ আমি শিব সমেত কৈলাস পর্বতকে তুলে নিক্ষেপ করে কুবেরকে বধ করবো।” এই বলে দশগ্রীব দশানন সমগ্র বাহু দিয়ে কৈলাস পর্বতকে তুলে ধরল । কৈলাসে প্রচণ্ড আলোড়ণ সৃষ্টি হোলো । কৈলাসের বরফের স্তূপ ভেঙ্গে প্রচণ্ড বেগে প্রবাহিত হতে লাগলো । ভয়ে ভীত হয়ে দেবী পার্বতী , মহাদেবকে জড়িয়ে ধরলেন । ভগবান মহেশ্বর অভয় দিয়ে বললেন- “হে দেবী। ভীত হয়ো না। আমি এখুনি রাবণের উদ্ধত আচরণকে ধ্বংস করবো ।” রাবণ কৈলাস পর্বতকে তুলে ছিলো। ভগবান শিব বাম চরণের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে মাটিতে চাপ দিলেন। সাথে সাথে কৈলাস পর্বত নেমে এসে রাবণের ওপর পতিত হোলো। রাবণের অর্ধ শরীর পর্বতের নীচে চলে গেলো । এইভাবে কিছুকাল গত হল। ব্রহ্মা দেব তখন সূর্য দেবতাকে দিয়ে রাবন কে সংবাদ প্রেরন করলেন । সূর্য দেবতা বললেন – “রাবণ । প্রজাপতি ব্রহ্মা এই সংবাদ দিয়েছেন । তুমি সাক্ষাৎ পরমপুরুষ শিবকে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলে। তিনি অনাদি, শাশ্বত, নিরাকার ব্রহ্মের সাকার রূপ। তুমি সেই স্বয়ম্ভু নীলকণ্ঠকে অপমান করেছো, তাই তোমার এই দশা। তুমি সেই পরব্রহ্মের স্তব করো। প্রজাপতি হংসবাহন ব্রহ্মা এই সংবাদ তোমাকে পাঠিয়েছেন ।”
রাবণ তখন শিব স্তব আরম্ভ করলেন । এই গুলি “শিবতাণ্ডবস্তব” নামে খ্যাত। যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে- যিনি জটারূপ অরণ্য থেকে নির্গত গঙ্গাদেবীর প্রবাহে পবিত্র করা সর্পের বিশাল মালা কণ্ঠে ধারন করে ডমরুতে ডম, ডম, ডম- এই শব্দ তুলে প্রচণ্ড নৃত্য করেছেন, সেই শিব যেন আমার কল্যাণ সাধন করেন । ১ যাঁর মস্তক জটারূপ কড়াইতে বেগে ভ্রমণকারী গঙ্গার চঞ্চল তরঙ্গ- লতাসমূহে সুশোভিত হচ্ছে, যাঁর ললাটাগ্নি ধক্ ধক্ করে জ্বলছে , মস্তকে অর্ধচন্দ্র বিরাজিত, সেই ভগবান শিবে যেন আমার নিরন্তর অনুরাগ থাকে । ২ গিরিরাজকিশোরী পার্বতীর বিলাসকালোপযোগী উচ্চ- নীচ মস্তকভূষণ দ্বারা দশদিক প্রকাশিত হতে দেখে যাঁর মন আনন্দিত, যাঁর নিত্য কৃপাদৃষ্টির ফলে কঠিন বাধাবিপত্তি দূর হয়ে যায়, সেই দিগম্বররূপ তত্ত্বে যেন আমার মন আনন্দ লাভ করে । ৩ যাঁর জটাজুটের মধ্যে সর্পের ফনায় অবস্থিত মণির প্রকাশিত পিঙ্গল ছটা দিশারূপিণী অঙ্গনাদের মুখে কুঙ্কুমের রং ছড়ায়, মত্ত হাতীর বিকশিত চর্মকে উত্তরীয় ( চাদর ) – রূপে ধারন করায় যিনি স্নিগ্ধবর্ণ লাভ করেছেন, সেই ভূতনাথে আমার চিত্ত অদ্ভুদ তৃপ্তি বোধ করুক । ৪ যাঁর চরণপাদুকা ইন্দ্রাদি সকল দেবতার ( প্রনামের সময় ) মস্তকের ফুলের পরাগে ধূসরিত হয় ; নাগরাজ ( শেষ ) এর মালায় বাঁধা জটাসম্পন্ন সেই ভগবান চন্দ্রশেখর আমার জন্য চিরস্থায়ী সম্পত্তির ব্যবস্থাপক হয়ে থাকুন। ৫ যিনি তাঁর ললাটরূপ বেদীতে প্রজ্বলিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তেজে কামদেবকে ভস্মীভূত করেছিলেন, যাঁকে ইন্দ্র নমস্কার করেন, চন্দ্রের কলা দ্বারা সুশোভিত মুকুট সম্পন্ন সেই শ্রীমহাদেবের উন্নত বিশাল ললাটের জটিল মস্তক আমার সম্পত্তির কারণ হোক । ৬ যিনি তাঁর ভীষণ কপালের ধক্ ধক্ রূপ জ্বলন্ত অগ্নিতে কামদেবকে আহুতিদান করেছিলেন, গিরিরাজকণ্যার স্তন্যাগ্রে পত্রভঙ্গ রচনা করার একমাত্র শিল্পী সেই ভগবান ত্রিলোচনের ওপর আমার রতি ( অনুরাগ ) থাকে। ৭
যাঁর কন্ঠে নবীন মেঘমালা বেষ্টিত অমাবস্যার অর্ধরাত্রের ন্যায় দরূহ্ অন্ধকারসম শ্যামলতা বিরাজ করে, যিনি গজচর্মপরিহিত, সেই জগদভার বহনকারী , চন্দ্রের অর্ধাকৃতিতে মনোহর ভগবান গঙ্গাধর যেন আমার সম্পত্তির বিস্তার করেন । ৮ যাঁর কন্ঠদেশ প্রস্ফুটিত নীলকমল সমূহের শ্যামশোভার অনুকরণকারী হরিণীর ছবির ন্যায় চিহ্নে সুশোভিত এবং যিনি কামদেব, ত্রিপুর, ভব ( সংসার ), দক্ষ- যজ্ঞ, হাতি( গজাসুর) , অন্ধকাসুর এবং যমরাজের উচ্ছেদকারী, আমি তাঁর ভজনা করি ।। ৯যিনি নিরাভিমান পার্বতীর কলারূপ কদম্বমঞ্জরীর মকরন্দস্রোতের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মাধুরী পানকারী মধুপ এবং কামদেব, ত্রিপুর, ভব, দক্ষ- যজ্ঞ, হাতি, অন্ধকাসুর ও যমরাজের বিনাশকারী, আমি তাঁর ভজনা করি ।। ১০যাঁর মস্তকের ওপর অত্যন্ত বেগে ঘূর্ণমান ভুজঙ্গের নিঃশ্বাসে ভয়ঙ্কর অগ্নি ক্রমাগত প্রজ্বলিত হচ্ছে, ধিমি ধিমি শব্দে মৃদঙ্গের গম্ভীর মঙ্গলধ্বনির সঙ্গে যিনি প্রচণ্ড নৃত্য করছেন, সেই ভগবান শঙ্করের জয় হোক । ১১ পাথর এবং সুন্দর কোমল বিছানায় সর্প ও মুক্তমালায়, বহু মূল্য রত্ন এবং মৃত্তিকায় , মিত্র ও শত্রুপক্ষে , তৃণ ও কমলনয়না তরুণীতে , সাধারণ প্রজা ও পৃথিবীর মহারাজার প্রতি যিনি সমভাব রাখেন, সেই সদাশিবকে আমি কবে ভজনা করব ! ১২ সুন্দর ললাটসম্পন্ন ভগবান চন্দ্রশেখরকে চিত্ত সমর্পণ করে নিজ কুচিন্তা পরিত্যাগ করে, গঙ্গার তীরে কোন কাননের অভ্যন্তরে থেকে মস্তকের ওপর হাত জোড় করে বিহ্বলনয়নে ‘শিব’ মন্ত্র উচ্চারণ করে আমি কবে সুখলাভ করব ? ১৩ যে ব্যাক্তি এভাবে উক্ত অতি উত্তম স্ত্রোত্র নিত্য পাঠ , স্মরণ এবং বর্ণনা করে, সে সদা শুদ্ধ থাকে এবং অতি শীঘ্র সুরগুরু শ্রীশঙ্করের প্রতি প্রকৃত ভক্তিভাব প্রাপ্ত হয় । সে কখনও বিপথে যায় না ; কারণ শ্রীশিবের সুচিন্তা প্রাণিবর্গের মোহ নাশ করে । ১৪ সায়ংকালে পূজা সমাপ্ত হলে দশানন রাবণ দ্বারা গীত এই শম্ভুপূজন সম্পর্কীয় স্ত্রোত্র যিনি পাঠ করেন, ভগবান শঙ্কর সেই ব্যক্তিকে রথ, হাতি, ঘোড়া সমন্বিত চিরস্থায়ী অনুকূল সম্পত্তি প্রদান করেন । ১৫ ( ১৫ টি শ্লোকে এই স্তব রাবন করেছিলেন )।
রাবণের স্তবে মুগ্ধ হয়ে দেবাদিদেব শিব আবির্ভাব হলেন । রাবণকে সেই দশা থেকে মুক্ত করলেন। রাবণ বললেন- “আজ থেকে রাবণের ইষ্ট রূপে দেবাদিদেবের এক নাম হবে রাবণেশ্বর । আমি, আপনি ছাড়া কারো চরণে নত হবো না ।” ভোলানাথ স্বল্পেতেই তুষ্ট হন। একটি বিল্বপত্র ও এক ঘটি গঙ্গা জলেই তুষ্ট তিনি । দেবাদিদেব রাবণকে “চন্দ্রহাস” নামক এক খড়গ দিয়ে বললেন- “হে রাবন তোমার যশ কীর্তি বৃদ্ধি হোক। এই চন্দ্রহাস খড়গ গ্রহণ করো। ত্রিলোকে এমন অস্ত্র নেই যে এই খড়গ কে বিফল করতে পারে। তবে আমার কোনো ভক্তের ওপর এই অস্ত্র নিক্ষেপ করলে এই অস্ত্র বিফল হয়ে আমার কাছে চলে আসবে।”
রাবণকে এই অস্ত্র প্রদানের ঘটনায় দেবতারা চিন্তিত ছিলো। মাতা পার্বতীও রুষ্ট ছিলেন । তিনি বলেছিলেন – “ হে প্রভু। আপনি দুরাচারী নারী নীপিড়ক রাবণকে কেন আশীর্বাদ দিলেন ? আপনি কি বিস্মৃত হয়েছেন যে দেবী কমলার অংশে জন্ম বেদবতী এই রাবণের জন্যই অগ্নিতে প্রবেশ করেছিলেন।” দেবাদিদেব জানালেন – “ হে দেবী। আমি কিছুই অজ্ঞাত নহি। সময় না আসলে কোনো নির্ধারিত কাজ হয় না। রাবন শ্রী বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্রের হস্তেই বধ হবে। কিন্তু তপস্যার ফল প্রদান করা কর্তব্য। কি সে অসুর, মানব, দানব, দেবতাই হোন। রাবণের তপস্যার ফল সে লাভ করেছে। সময় আসলে সে সকল যাবতীয় পাপ কর্মের ফলও ভোগ করবে।” রাবণের মাতা কেকসী ভাবল – ভগবান শঙ্কর যদি এত অল্পেই তুষ্ট হয়ে যান, তাহলে ভগবানকে লঙ্কায় এনে রাখলে আরোও উত্তম। রাবণ অজেয় হবে। অতএব শিবের আরাধনা করে তাঁকে তুষ্ট করতে হবে। কেকসী মহর্ষি বিশ্বশ্রবার কাছে বিশ্বশ্রবা পূজিত জাগ্রত শিবলিঙ্গ প্রার্থনা করলো। বিশ্বশ্রবা এর কারণ জানতে চাইলে কেকসী সব বলল। এই রকম অকল্যাণ জনক বাসনা শুনে বিশ্বশ্রবা রাজী হোলো না। বিশ্বশ্রবা বলল- “তোমার চিন্তাভাবনা ও উদ্দেশ্য ত্রিলোকের অমঙ্গল ডেকে আনবে। তুমি যদি মহৎ উদ্দেশ্যে সেই লিঙ্গ প্রার্থনা করতে তবে অবশ্যই দিতাম ।” কেকসী সেই শিবলিঙ্গ জোর করে তুলে নিয়ে গেলো। বিশ্বশ্রবা অনেক বোঝালো যে শিবলিঙ্গ স্ব স্থান থেকে সড়ানো মহাপাপ। কিন্তু কেকসী শুনলো না ।
সেই শিবলিঙ্গ পূজাকালে ইন্দ্রদেবতা সেই লিঙ্গ হরণ করলো। কেকসী ফিরে গিয়ে রাবণ কে সব জানালো। রাবণ পুনঃ শিব তপস্যায় মগ্ন হোলো। এত কঠিন তপস্যা যে রাবণ নিজ উদর ছিন্ন করে নাড়ি বের করে সেতারের মতো বাজিয়ে শিবের স্তব করতে লাগলো। দশ মাথা ছিন্ন করে যজ্ঞে দিতে লাগলো। ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে বর দিতে প্রকট হলেন। রাবন বললেন- “হে আশুতোষ। আপনি সর্বদাই আমার ওপর প্রসন্ন। কৃপা করে আপনি আমাকে দেবী পার্বতী প্রদান করুন। আমি ভদ্রকালী রূপে দেবীর স্থাপনা করে লঙ্কায় বসন্ত ঋতুতে দুর্গা পূজা করবো। আর আপনিও আমার সাথে চলুন। লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে আপনাকে পূজা দেবো।” মহাদেব শিব এখন কি করেন। নিজ স্ত্রীকে কিভাবে দান করবেন। আর ভক্তের মনস্কামনা পূর্ণ করতেই হবে। ভগবান শিব বললেন- “তাই হোক।আমার আত্মলিঙ্গ ও দেবী গৌরীকে গ্রহণ করো।” রাবণকে আত্মলিঙ্গ ও দেবী পার্বতী প্রদান করলেন। শিব বললেন- “হে রাবণ। মনে রেখো আমার এই আত্মলিঙ্গ যেখানে ভূমি স্পর্শ করবে সেখানেই স্থাপিত হবে। অতএব লঙ্কা তে নিয়ে গিয়েই আমার আত্মলিঙ্গ ভূমিতে রাখবে।” রাবণ পুস্পক বিমানে দেবী পার্বতী ও মহাদেবের আত্মলিঙ্গ নিয়ে আসতে লাগলেন । মাতার বিহনে কৈলাসে গণেশ, কার্ত্তিক, নন্দী, ভৃঙ্গি গণেরা রোদন করতে লাগলেন। সেই সময় ভগবান বিষ্ণু অভয় দিলেন। তিনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বেশে রাবণের সামনে গেলেন। দেবী পার্বতী রাবণের অজ্ঞাতে বৃদ্ধা কুৎসিত রূপ ধরলেন । বৃদ্ধ রূপী নারায়ণ বললেন- “হে রাবণ। মহাদেব তোমার সাথে ছলনা করছেন। তিনি নিজ স্ত্রীকে তোমাকে দেন নি। দেখো।” রাবণ বৃদ্ধা কুৎসিত রূপী দেবীকে দেখে বললেন- “তুমি প্রস্থান করো। তোমাকে চাই না।” রাবণের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেবী পার্বতী স্বরূপ ধরে কৈলাসে গেলেন। অপরদিকে রাবণের উদরে ভগবান বিষ্ণু গঙ্গা ও যমুনা , সপ্ত পবিত্র নদী প্রবেশ করলেন ।
উদ্দেশ্য ছিলো রাবণের হাত থেকে আত্মলিঙ্গ উদ্ধার । এই ব্যাপারে দেবতারা বিঘ্ন বিনাশক, মঙ্গল মূর্তি গণেশের শরণাপন্ন হলেন । প্রচণ্ড মূত্রবেগ উপস্থিত হওয়াতে রাবণ পুস্পক বিমান থেকে নামলেন। এত মূত্র বেগ অথচ শিবলিঙ্গ নিয়ে শৌচাদি কর্ম করা নিষেধ । সেই সময় বিঘ্ন বিনাশক গজানন এক রাখালের বেশে আবির্ভূত হলেন। রাবণ সেই রাখালের হাতে শিবলিঙ্গ দিয়ে বললেন- “বালক এই শিবলিঙ্গ ধারন করো। ভুলেও একে মাটিতে রাখবে না। প্রাকৃতিক ক্রিয়া সুসম্পন্ন করে আমি এসে তোমাকে পুরস্কার প্রদান করবো।” রাখাল বেশী গণেশ বলল- “এত ওজন আমার সহ্যের বাইরে। আমি তিনবার তোমাকে আহ্বান করবো। এর মধ্যে না আসলে আমি আর ধরে রাখতে পারবো না।” রাবন মূত্র ত্যাগ করতে বসলো। রাখাল রূপী গণেশ তিনবার ডেকে শিবলিঙ্গ মাটিতে রেখে দিলো। সেখানেই স্থাপিত হোলো ভগবান শিবের আত্মলিঙ্গ । রাবণ ফিরে এসে রাখালকে দেখতে পেলো না। ঐ শিবলিঙ্গ অনেক ওঠানোর চেষ্টা করেও বিফল হোলো। রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গেলো । ঐ স্থান “বৈদ্যানাথ ধাম” নামে খ্যাত। ভারতের ঝাড়খণ্ডে এই ধাম অবস্থিত । রাবনের মূত্রে সেখানে যে পুষ্করিণী সৃষ্টি হয়েছিলো তা এখনও আছে । এখানে দেবী সতীর হৃদয় পতিত হয়েছিলো। এখানে দেবী দুর্গা রূপে অবস্থান করছেন। দেবীর ভৈরব হলেন এই বৈদ্যনাথ । শ্রাবন মাসে এখানে প্রচুর ভীর ও মেলা হয়। ভারতে আসলে অবশ্যই এই ধাম দর্শন করবেন। এরপর দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু সহিত এই স্থানে এসে ভগবান শিবের পূজা করলেন ।
রামায়নে একাধিক অভিশাপের ঘটনা দেখা যায় । এবার ইন্দ্রলোকের কথা শোনা যাক । মহর্ষি দুর্বাসা একদিন ইন্দ্রলোকে পদার্পণ করেছেন । সেখানে একটি বিশেষ যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিলো । দেবরাজ মহেন্দ্র, অপ্সরা পুঞ্জস্থলাকে যজ্ঞের আয়োজন ও মহর্ষি দুর্বাসার সেবা করতে আদেশ দিয়েছিলেন । বয়সে ষোড়শী নবীনা অপরূপা সুন্দরী পুঞ্জস্থলা ছিলেন চঞ্চল মতির । একেবারে চঞ্চলা মন, অল্প বয়সী ছোটো মেয়েদের মতোন লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে চলা এমন । মহর্ষি দুর্বাসার কাজে গাফিলতিও ঘটালেন । কিন্তু দুর্বাসা ক্ষমা করলেন । শাস্ত্রে মহর্ষি দুর্বাসাকে অত্যাধিক ক্রোধী বলা হয়েছে। সামান্য কারণে তিনি ভয়ানক শাপ প্রদান করেন । এনারই অভিশাপে মাতা লক্ষ্মী দেবী পাতালে প্রবেশ করেছিলেন। যাই হোক একদিন যজ্ঞ চলাকালীন অপ্সরা পুঞ্জস্থলা দুর্বাসা মুনির পূজার উপকরণ ডিঙিয়ে চলে গেলেন। হিন্দু ধর্ম মতে খাবার, শায়িত ব্যাক্তি, গুরুদেব ব্রাহ্মণ গুরুজন বা তাদের ছায়া বা পাদুকা, পূজার উপকরণ ডিঙানো ঘোর অপরাধ । দুর্বাসা রেগে শাপ দিলেন- “বানরের মতো লাফিয়ে কোনো কিছু না দেখেই তুমি বিচরণ করো। এমন চঞ্চল মন নিয়ে স্বর্গে তোমার স্থান নেই। যাও পৃথিবীতে গিয়ে বানর কূলে জন্ম নাও।” এমন অভিশাপ শুনে অপ্সরা পুঞ্জস্থলা অনেক ক্ষমা প্রার্থনা করলেন । দুর্বাসা মুনি খুশী হয়ে বর দিলেন – “তুমি বানরী হয়ে জন্মাবে। তবে তোমার গর্ভে স্বয়ং ভগবান মহেশ্বর অবতার নেবেন। সেই অবতারে তিনি হরিভক্তি প্রচার করবেন। আবার রাক্ষস দলন করবেন। জগতে তুমি তাঁর মাতা রূপে পূজানীয়া হবে।”
অপ্সরা পুঞ্জস্থলা বানরী হয়ে জন্ম নিলো। তাঁর বিয়ে হোলো কেশরী নামক এক বানরের সাথে। ঝাড়খণ্ডে এমন একটি জায়গা আছে যেখানে কেশরী বানরের রাজ্য ছিলো বলে বলা হয় । কেশরী বীর ছিলো। সেও রাক্ষস বধ করেছিলো। পরবর্তী কালে ভগবান শিবের অবতার হনুমান এর জন্ম হয় এই দম্পতির ঘরে । মহর্ষি গৌতমের সুন্দর স্ত্রী ছিলেন অহল্যা দেবী। অহল্যা দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবতাদের রাজা ইন্দ্র একদিন অহল্যা দেবীকে শয্যাসঙ্গিনী হবার প্রস্তাব দিলেন । অহল্যা দেবী ঘৃনা ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন । কিন্তু ইন্দ্র দেবতার কু মানসিকতা দূর হোলো না । একদিন ফন্দী এটে রাত্রির তৃতীয় প্রহরে ইন্দ্র দেবতা বণ মোরোগের ডাক ডাকলেন । মুনি ভাবলেন ব্রাহ্ম মুহূর্ত উপস্থিত । হিন্দু ধর্ম মতে ব্রাহ্ম কালে শয্যা ত্যাগ করা নিয়ম । মুনি স্নানে গেলেন কুমণ্ডলু নিয়ে । অপরদিকে ঘরে অহল্যা একা। ইন্দ্রদেবতা মুনি গৌতমের ছদ্দবেশ নিয়ে গৃহে প্রবেশ করে অহল্যাকে ভোগ করলেন। অহল্যা দেবী বুঝতে পারেন নি । তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অহল্যা দেবী ইন্দ্রের জালে পা দিলেন । মুনি ঘাটে গিয়ে দেখলেন তার সাথে ছলনা হয়েছে। দ্রুত ফিরে এসে আশ্রমে তাঁরই মতোন একজনকে দেখে অবাক হলেন । অহল্যাও অবাক আর ভয় ভীত হয়েছিলো। ইন্দ্র স্বরূপ ধরতেই , গৌতম মুনি শাপ দিলেন- “হে অধার্মিক ইন্দ্র। তুমি দেবতাদের রাজা হবার যোগ্য নও । দেবতা হয়েও তুমি এমন ঘৃন্য কাজ করেছো। তোমাকে শাপ দিচ্ছি, তোমার শরীরে সহস্র যোনি উৎপন্ন হোক।” ইন্দ্রের দেহে সহস্র যোনি উৎপন্ন হোলো। লজ্জায় ইন্দ্র কাউকে আর মুখ দেখাতে পারলো না ।
গৌতম মুনি এবার একটি অন্যায় কাজ করলেন। নীরিহ নির্দোষী, চক্রান্তের শিকার অহল্যাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “তুমি প্রস্তরে পরিণত হও। যবে ভগবান নারায়ণ মানব অবতার নিয়ে এখানে এসে তোমার ওপর চরণ রাখবেন –সেদিনই তুমি মুক্তি পাবে।” সেই থেকে অহল্যা সেই পরিত্যক্ত আশ্রমে পাষাণ হয়ে থাকতে লাগলেন । ইন্দ্র দেবতা পড়ে আরাধনা করে বর পেয়েছিলেন। তাঁর দেহের সহস্র যোনি সহস্র চোখে পরিণত হোলো । এখানে একটি তত্ত্ব কথা আছে । ‘ব্যাঞ্জর’ বা অনাবাদী জমিকে ‘অহল’ অর্থাৎ হাল দেওয়া হয়নি বলা হয়। ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা। এমন অনাবাদী জমিতে ভরপুর বৃষ্টিকে কেউ ইন্দ্র দ্বারা অহল্যা ধর্ষণ বলেছেন । ইন্দ্র দেবতার সহস্র চোখ। যখন বৃষ্টি হয় তখন আমরা কল্পনা করে বলি আকাশের শত চোখ দিয়ে জল পড়ছে। ইন্দ্র হলেন বৃষ্টির দেবতা। তাই এখানে ইন্দ্রের সহস্র চোখের বর্ণনা করা হয়েছে । যে আখ্যান মানে মানুক, আর যে তত্ত্ব কথা মানে মানুক ক্ষতি নেই। ক্ষতি তখন হয় যখন একজনের মতবাদ অন্যের ওপর জোর করে চাপানোর চেষ্টা হয় । সুতরাং যে যেটা মানে মানুক ।
ভক্ত হনুমান
হনুমানজি রুদ্রাবতার । কেশরী বানরের সন্তান রূপে হনুমানের আবির্ভাব হয়েছিলেন । রাবণের রাক্ষস কূলের আতঙ্ক এত বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে মুনি ঋষি দেবতারা মিলে ভগবান শিবের শরণাপন্ন হলেন । ভগবান শিব অভয় দিয়ে বললেন “আমার অংশ কেশরী পুত্র রূপে জন্ম নেবে। সেই অবতারে একদিকে যেমন ভগবান নারায়নের সহায়ক হবো, তাঁর নাম মাহাত্ম্য প্রচার করবো, অপরদিকে রাক্ষস নিধন করে সৎ জনকে রক্ষা করবো।” অতঃ মহাদেব পবন কে বললেন- “হে মরুত । তুমি আমার সেই অবতারের পালক পিতা হবে। তুমি তাহাকে যাবতীয় বিদ্যা দেবে।” এরপর মহেশ্বর সূর্য দেবতাকে বললেন- “হে তপন । তুমি যেরূপ আলোক বিকিরণ করে অন্ধকার দূর করো, সেই রূপ আমার সেই অবতারের গুরু হয়ে আমাকে সকল বিদ্যা দিয়ে জ্ঞানালোকে নিয়ে আসবে। ” মহাদেবের ইচ্ছায় দেবর্ষি নারদ মুনি গিয়ে অঞ্জনা দেবীকে শিব উপাসনা করবার পরামর্শ দিলেন ।
অঞ্জনা দেবী বনে গিয়ে ভগবান শিবের তপস্যা করলেন। ভগবান মহাদেব প্রকট হয়ে বললেন- “হে দেবী! তুমি আমার অংশের মাতা হবে। এই অবতারে আমি তোমার বাৎসল্য গ্রহণ করবো।” এরপর অঞ্জনা দেবী এক বলশালী পুত্রের জন্ম দিলেন । হনুমান যখন আবির্ভূত হলেন তখন সকলে খুশী হয়ে পুস্প বর্ষণ করতে লাগলো। গাছ গুলি ফুলে ঢেকে গেলো, পক্ষীরা মধুর সুরে ডাকতে লাগলো। প্রকৃতি যেনো তাঁর নিজস্ব ছন্দ ফিরে পেলো। কেবল লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন দেখা দিলো। হনুমান এর আবির্ভাব হয়েছিলো চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে (পূর্বভাদ্র নক্ষত্র মীন রাশি, কর্কট লগ্ন ) । বাল্য হনুমান ভগবান শিবের বাল্যরূপ । কেশরী বানরের রাজ্যে উৎসব আনন্দ অনুষ্ঠান হোলো। তিনি ব্রাহ্মণ ভোজোন, দান ধ্যান, মহাভোজের আয়োজন করলেন । সকলে এসে রাজার দান গ্রহণ করে ধন্য ধন্য করতে লাগলো । দেবতারা ছদ্দবেশে আসলেন । ভগবান শিবের বাল্যরূপ দর্শন সহজে মেলে না। চরণ স্পর্শ করে দেবতারা আশীর্বাদ গ্রহণ করতে লাগলেন । শুধু দেবতারাই নয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সরস্বতী দেবী, লক্ষ্মী দেবী এমনকি মাতা গৌরী অবধি ছদ্দবেশে এসে দর্শন করলেন ভগবান শঙ্করের শিশু রূপ । মাতা অঞ্জনা দেবীর লালন পালন আদর যত্ন পেয়ে হনুমান জী বড় হতে লাগলেন । কেশরী কূলের ইষ্ট দেবতা ছিলেন পবন দেব । পবন দেব মাঝে মাঝে হনুমানকে দর্শন করতে আসতেন ।
হনুমান মহারাজ ছোটো থেকেই চঞ্চল ছিলেন । লাড্ডু, মোদোক, মিষ্ট, পক্ক ফলমূলের প্রতি তাঁর ছিলো বেশী আকর্ষণ । অপূর্ব সুন্দর মিষ্ট দর্শন শিশু হনুমান কে দেখে মোহিত হয়ে যেতেন সকলে। ক্রোড়ে নিয়ে আদর করতেন । শত দুষ্টামি শর্তেও সকলের নয়নের মণি ছিলেন। হনুমানের দেখাদেখি অন্য সকল দেবতাদের তেজ রূপে বানর কূলে জন্ম নিলেন। নল নীল, গবাক্ষ , বালি, সুগ্রীব, মৈনাক আদি বানর বীরেরা । ব্রহ্মার মানস পুত্র রূপে জাম্বুবান ভল্লুক কূলে জন্ম নিলেন । অপর দিকে রাবণের স্ত্রী মন্দাদোরী এক বীর পুত্রের জন্ম দিলেন। সে জন্মে মেঘের ন্যায় রোদোন করতে থাকলে রাবণ তার নাম দিলো মেঘনাদ । নল বিশ্বকর্মার পুত্র । কিন্তু এর পেছনে একটি প্রেমের কাহানী, অভিশাপের কাহানী এক অপ্সরার কাহানী জড়িয়ে আছে। পরবর্তী পর্বে তা বলা যাবে ।
বিশ্বকর্মাকে নিয়ে পুরানে অনেক আখ্যান লিখিত আছে । তাঁর মধ্যে থেকে একটি আখ্যান শোনা যাক। ঋষি শাপে একদা দেবশিল্পীকে বানর হতে হয়েছিল । ঘটনা টা ঠিক এই রূপ। বিশ্বকর্মা বিয়ে করেছিলেন স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচীকে ।ঘৃতাচীদেবী একজন অপ্সরা- তাই তিনি নৃত্যকলা কে নিয়ে থাকতে চান- কিন্তু স্বামী বিশ্বকর্মা ঘোর নারাজ। তিনি বলেন বিবাহের পর ওসব চলবে না। একদা স্বর্গে নৃত্য প্রতিযোগিতা হয়েছিল। স্বামীর অমতে ঘৃতাচী দেবী লুকিয়ে নাচতে গিয়ে বিশ্বকর্মার হাতে লাঞ্ছিতা হলেন। বিশ্বকর্মার এক কন্যা হয়- তার নাম চিত্রঙ্গদা। অপূর্ব সুন্দরী চিত্রাঙ্গদার নৃত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল- কিন্তু পিতার বদ মেজাজের জন্য- চিত্রাঙ্গদা চুপি চুপি মায়ের কাছে নৃত্য কলা শিখতো, প্রকাশ্যে শেখার সাহস পেতো না । একসময় সূর্য বংশীয় নৃপতি রাজা সুরথের সাথে চিত্রাঙ্গদার ভালোবাসা হয় । তারা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতেন। কিন্তু দেবতাদের দিব্যদৃষ্টি থাকে। সুতরাং পিতা বিশ্বকর্মার থেকে বেশীদিন লুকিয়ে থাকলো না। মর্তের পিতারা যা করেন- মেয়ের প্রেমিক স্ট্যাটাসে, পয়সায় ছোটো হলে , মেয়ে ভালোবাসায় অন্ধ হলে , মেয়েকে বন্দী করে রাখেন, বিশ্বকর্মা তাই করলেন। এই অবস্থায় মর্তের মেয়েরা যা করে পালিয়ে যায়- চিত্রাঙ্গদাও তাই করলেন।
বিশ্বকর্মা ক্রোধে অন্ধ হয়ে প্রথমে স্ত্রীর সাথে খানিক ঝগড়া করে স্বর্গের দেবতাদের কাছে সাহায্য চাইতে গেলেন। দেবতারা বিশ্বকর্মার বদমেজাজের জন্য সাহায্য করতে চাইলেন না। মর্তের পিতারা যা করে এই সময়, মেয়ের প্রেমিক কে শাস্তি দেবার জন্য নেতা, উচ্চ পদস্থ পুলীশের কাছে যায়- বিশ্বকর্মা সেই মতো প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন- “মেয়েদের স্বয়ম্বর সভার মাধ্যমে পতি নির্বাচনের অধিকার আমি দিয়েছি, তোমার মেয়ে নিজ পছন্দের পাত্র নির্বাচন করেছে। সে ঠিক কাজ করেছে। ” বিশ্বকর্মা এরপর বৈকুন্ঠে লক্ষ্মী জনার্দনের কাছে গেলেন। মা লক্ষ্মী বললেন- “আমি নিজেই সমুদ্র মন্থনের পর প্রকট হয়ে ভগবান হরির কন্ঠে মাল্য দিয়েছিলাম। আমি কন্যার পতি নির্বাচনের অধিকারকে সমর্থন করি। আমি তোমার কন্যার পক্ষেই আছি।” বিফল হয়ে বিশ্বকর্মা কৈলাশে গেলে গৌরী দেবী জানালেন- “তোমার কন্যা নিজ পাত্র নিজে নির্বাচন করে স্ত্রী ধর্ম পালন করেছে। অতএব আমরা তোমাকে কোনোরূপ সাহায্য করতে পারবো না।” সাহায্য না পেয়ে বিশ্বকর্মা ক্রোধে নিজ মেয়েকে অভিশাপ দিলেন- “বিয়ের পর তুই বিধবা হবি।” চিত্রাঙ্গদা ভাবল তাঁর জন্য রাজার মৃত্যু হবে- তাই এই বিবাহ করা উচিৎ না। এই ভেবে চিত্রাঙ্গদা নদীর জলে ঝাঁপ দিলো। রাজা সুরথ পাগল হয়ে বনে চলে গেলো। মহর্ষি ঋতধ্বজ এর শিষ্যরা চিত্রাঙ্গদাকে নদী থেকে তুলে আশ্রমে নিয়ে গেলো। সুস্থ করলো। মহর্ষি ঋতধ্বজ সব শুনে বিশ্বকর্মা কে অভিশাপ দিলেন- “তুই পিতা না। তুই পশু। তাই তুই পশু যোনিতে বানর হয়ে থাক। যতদিন তুই তোর মেয়েকে রাজা সুরথের সাথে বিবাহ না দিবি, শাপ ফিরিয়ে না নিবি , ততদিন তুই বানর হয়ে থাকবি।”
বিশ্বকর্মা এর পর মর্তে বানর হয়ে জন্মান। ঘৃতাচী দেবীও বানরী হয়ে জন্মান। দুজনের বিবাহ হয়। নল নামে তাঁদের এক পুত্র হয়। বিশ্বকর্মা অবশেষে শাপ তুলে নিয়ে চিত্রাঙ্গদার সাথে সুরথের বিবাহ দেন। এই কাজে মধ্যস্থতা করেন বালক হনুমান আর জাম্বুবান । তখন ঋষি শাপ ও কেটে যায় । নল হলেন ইঞ্জিনিয়ার । যিনি রামসেতু তৈরী করেছিলেন । এই বিদ্যা তিনি তাঁর পিতার কাছে পেয়েছিলেন। নল ছোটোবেলায় খুব চঞ্চল ছিলেন। মুনি ঋষিদের পূজার জিনিস লোটা, আসন, যজ্ঞকাষ্ঠ , জপের মালা, দণ্ড সব নিয়ে নদীতে ফেলে দিতেন । এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন কোনো এক মুনি তাঁকে অভিশাপ প্রদান করেন যে – “যা জলে ফেলবে সে সকল ডুবে যাবে না। সব জলের বুকে ভেসে থাকবে।” শাপে বর হয়েছিলো । পরবর্তী কালে ভারত থেকে লঙ্কা যাবার সেতু নির্মাণ করেছিলেন ।
একদিনের কথা । জটায়ুর ভাই সম্প্রতি আকাশে উড়তে উড়তে একেবারে সৌরলোকে উপস্থিত হয়েছেন । পক্ষী হয়ে সূর্যের নিকটে যেতেই সূর্য দেবতা এমন তাপ বিকিরণ করলেন যে সম্প্রতি পক্ষীর ডানা পুড়ে গেলো । ডানা হারিয়ে সেই পক্ষী সূর্য দেবতার কাছে অনুনয় বিনয় করতে সূর্য দেবতা বললেন- “ তোমার এই উদ্ধত আচরণের জন্যই এই শিক্ষা প্রদান করলাম। তুমি দক্ষিণে সমুদ্র তটে অবস্থান করো। যথাসময়ে তুমি তোমার পাখা ফিরে পাবে। তোমাকে দিয়ে একটি মহৎ কাজ হবে। সেই অবধি প্রতীক্ষা করে রাম নাম জপ করো।” হনুমান শিশু অবস্থায় পালক পিতা পবন দেবতার কাছে আকাশ মার্গে বিচরণের শক্তি পেয়েছিলো । একদিনের কথা । প্রভাতে পূর্ব গগনে উজ্জ্বল লাল দিনমণিকে দেখে হনুমান মহারাজ ভাবলেন সেটি নিশ্চয় মিষ্ট ফল। আকাশে ঝুলে আছে । অতএব ঐ ফল খেয়েই দেখতে হবে । ভাবা মাত্রই লম্ফ দিয়ে ছুটে গেলেন । একেবারে ভূলোক ছাড়িয়ে সোজা ঐ সূর্য লোকে । সেসময় খণ্ডিত রাহুর মস্তক সূর্য কে গ্রাস করবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল্ল । সূর্য দেবতা জানতেন সৃষ্টির নিয়ম অনুসারে গ্রহণ হবে। হনুমানকে দেখে রাহু ও সূর্য উভয়ে চমকে গেলো। হনুমান মহারাজ ঐ বাল্যকালেই রাহুর খণ্ডিত মস্তক তুলে বহুদূরে নিক্ষেপ করে সূর্যকে গিলতে অগ্রসর হল ।
রাহু গিয়ে স্বর্গে ইন্দ্রের কাছে বলল- “হে দেবেন্দ্র! সৃষ্টির নিয়মে আমি চন্দ্র সূর্যকে গ্রাস করি। তবে আজ কোথা থেকে সেই উদ্ধত বালক এসে আমার কর্মে হস্তক্ষেপ করছে?”এইদিকে হনুমান সূর্য কে গ্রাস করলো। সমগ্র জগত প্রথমে ভাবল গ্রহণ উপস্থিত । কিন্তু বহু সময় পরেও সূর্য গগনে দেখা দিলো না দেখে সকলে ভয়ভীত হোল । রুদ্রাবতার হনুমান সূর্য গ্রাস করেছেন । ইন্দ্র দেবতা বজ্র ধারন করে ঐরাবত স্কন্ধে আসলেন । বললেন- “কপি বালক। সূর্য দেবকে উন্মুক্ত করে ফিরে যাও। অন্যত্থায় তোমাকে দণ্ড প্রদান করবো ।” হনুমান তো কিছুতেই সূর্য দেবতাকে ছাড়বেন না । ইন্দ্রদেবতা তখন বজ্র অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। বজ্র গিয়ে হনুমানের বুকে আঘাত হানলো । হনুমানের মুখ থেকে সূর্য বেরিয়ে এলো। রক্তাক্ত অবস্থায় হনুমান আছড়ে পড়লো আরবল্লী পর্বতের উপর । পবন দেবতা এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দ্রদেবতার কাছে গিয়ে বললেন- “হে মহেন্দ্র। আপনি কেন একজন বালকের ওপর বজ্র অস্ত্র প্রয়োগ করলেন ?” ইন্দ্রদেবতা অনেক বোঝালেন যে সূর্য দেবতাকে উন্মুক্ত করতেই এটা করতে হয়েছিলো। পবন দেবতা বললেন- “দেবরাজ । হনুমান আমার পালক পুত্র। এর প্রতিশোধ আমি নেবোই। আজ বিশ্ব সংসার দেখবে পবন দেবতার শক্তি কত। একজন পুত্রহারা পিতার শোকে এই জগত ধ্বংস হবে আজ।” পবন দেবতা সমগ্র জগত থেকে উৎক্ষেপন বায়ু, অবক্ষেপন বায়ু, আকুঞ্চন বায়ু, গমন বায়ু, প্রসারণ বায়ু, প্রান বায়ু, অপান বায়ু, ব্যান বায়ু, সমান বায়ু, উদান বায়ু , নাগ বায়ু, কূর্ম বায়ু, কৃকর বায়ু, দেবদত্ত বায়ু, ধনঞ্জয় বায়ু হরণ করলেন । সমস্ত বায়ু বিশ্ব থেকে নিজের মধ্যে সংহরিত করলেন পবন দেবতা ।
বিশ্ব সংসারে মহাপ্রলয় নেমে আসলে জীব প্রানী কূল বিনষ্ট হতে থাকলো । ইন্দ্রদেবতা, প্রজাপতি ব্রহ্মা অনেক বোঝালেন। পবন দেবতা বললেন- “হনুমানের প্রান দান করা হলেই এই প্রলয় স্তব্ধ হবে। অন্যত্থায় বিশ্ব নষ্ট করবো।” ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বললেন- “হে দেবেন্দ্র। হনুমানের আবির্ভাব দেবশত্রু রাক্ষস দের বিনাশের জন্য। আর দেবতা হয়ে তুমি দেবতাদের মিত্রকে বধ করে দেব শত্রুদের কল্যাণ করলে। তুমি নিজের ক্ষতি নিজেই আহ্বান করেছো।” ব্রহ্মা প্রান দান করতে রাজী হলে পবন দেবতা শান্ত হয়ে সব বায়ু ফিরিয়ে দিলেন । দেবতারা আরবল্লী পর্বতে গেলেন। দেখলেন হনুমান মরে নি। তবে ভয়ানক আহত হয়ে মূর্ছা গেছেন। বজ্রের আঘাত খেয়েও জীবিত। ব্রহ্মা হনুমানের নব নাম দিলেন ‘বজ্রংবলী’ । ব্রহ্মা বর দিলেন – হনুমান তুমি চারযুগে অমর হবে। কোনো অস্ত্রই তোমাকে রোধ করতে পারবে না । ইন্দ্র বর দিলেন- বজ্রের ন্যায় বল পাবে। পবন দিলেন- বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী হবে তুমি। বহু দূরের বাক্য তুমি জানতে পারবে। অগ্নি বর দিলেন- আগুনে তোমার ক্ষতি হবে না । বরুণ বর দিলেন- ‘জলের তলে তুমি অবাধে বিচরণ ও শ্বাস নিতে পারবে। যম হনুমানকে গদা দিয়ে বললেন- “এই গদা দিয়ে দুষ্ট দমন করো। তোমার বৃদ্ধির সাথে সাথে এই গদাও বৃদ্ধি পাবে।” সূর্য দেবতা হনুমানের লোমকূপে সমগ্র কিরণ দিলেন । ব্রহ্মা বললেন- “যাবতীয় বিদ্যার জ্ঞাতা হবে তুমি।” বিশ্বকর্মা বর দিলেন- “অযুত শক্তিমান হও।” নারদ বললেন- মহান হরি ভক্ত রূপে খ্যাত হবে। বাসুকী নাগ বললেন- “নাগেরা তোমার বশে থাকবে। তোমার নামে নাগ ভয় দূর হবে।” এভাবে বাকী দেবতারা নানান বর দিলেন । হনুমান এরপর সূর্য লোকে শিক্ষা প্রাপ্তির জন্য গেলেন ।
বাল সময় রবি ভক্ষি লিয়ো তব ।
তীনহুঁ লোক ভয়ো অঁধিয়ারো ।
তাহি সোঁ ত্রাস ভয়ো জগ কো
য়হ সঙ্কট কাহু সোঁ জাত না টারো ।।
দেবন আনি করী বিনতী তব
ছাঁড়ি দিয়ো রবি কষ্ট নিবারো ।
কো নহিঁ জানত হৈ জগমেঁ কপি
সংকটমোচন নাম তিহারো ।।