কর্ম সংস্কার




কর্ম শব্দটি সংস্কৃত ‘কৃ’-ধাতু হইতে নিষ্পন্ন; ‘কৃ’-ধাতুর অর্থ ‘করা’; যাহা কিছু করা হয়, তাহাই কর্ম। এই শব্দটির আবার পারিভাষিক অর্থ ‘কর্মফল’। দার্শনিকভাবে ব্যবহৃত হইলে কখনও কখনও উহার অর্থ হয়—সেই-সকল ফল,আমাদের পূর্ব কর্ম যেগুলির কারণ। কিন্তু কর্মযোগে আমাদের ‘কর্ম’ শব্দটি কেবল ‘কাজ’ অর্থেই ব্যবহার করিতে হইবে। মানবজাতির চরম লক্ষ্য—জ্ঞানলাভ। প্রাচ্য দর্শন আমাদের নিকটে এই একমাত্র লক্ষ্যের কথাই বলিয়াছেন। মানুষের চরম লক্ষ্য সুখ নয়, জ্ঞান। সুখ ও আনন্দ তো শেষ হইয়া যায়। সুখই চরম লক্ষ্য—এরূপ মনে করা ভ্রম। জগতে আমরা যত দুঃখ দেখিতে পাই, তাহার কারণ—মানুষ অজ্ঞের মত মনে করে, সুখই আমাদের চরম লক্ষ্য। কালে মানুষ বুঝিতে পারে, সুখের দিকে নয়, জ্ঞানের দিকেই সে ক্রমাগত চলিয়াছে। দুঃখ ও সুখ উভয়েই তাহার মহান্ শিক্ষক, সে শুভ এবং অশুভ হইতে সমভাবে শিক্ষা পায়। সুখ-দুঃখ যেমন আমাদের মনের উপর দিয়া চলিয়া যায়, অমনি তাহারা উহার উপর নানাবিধ চিত্র রাখিয়া যায়, আর এই চিত্রসমষ্টি বা সংস্কার-সমষ্টির ফলকেই আমরা মানুষের ‘চরিত্র’ বলি। কোন ব্যক্তির চরিত্র লইয়া আলোচনা করিয়া দেখ, বুঝিবে উহা প্রকৃতপক্ষে তাহার মনের প্রবৃত্তি—মনের প্রবণতাসমূহের সমষ্টিমাত্র। দেখিবে, সুখ দুঃখ—দুই-ই সমভাবে তাহার চরিত্রগঠনের উপাদান; চরিত্রকে এক বিশেষ ছাঁচে ঢালিবার পক্ষে ভাল-মন্দ উভয়েরই সমান অংশ আছে; কোন কোন স্থলে সুখ অপেক্ষা বরং দুঃখ অধিকতর শিক্ষা দেয়। জগতের মহাপুরুষদের চরিত্র আলোচনা করিলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুখ অপেক্ষা দুঃখ তাঁহাদিগকে অধিক শিক্ষা দিয়াছে—ধনৈশ্বর্য অপেক্ষা দারিদ্র্য অধিক শিক্ষা দিয়াছে, প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দারূপ আঘাতই তাঁহাদের অন্তরের অগ্নি প্রজ্বলিত করিতে অধিক পরিমাণে সাহায্য করিয়াছে।

এই জ্ঞান আবার মানুষের অন্তর্নিহিত। কোন জ্ঞানই বাহির হইতে আসে না, সবই ভিতরে। আমরা যে বলি মানুষ ‘জানে’, ঠিক; মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হইবে—মানুষ ‘আবিষ্কার করে’ (discovers) বা ‘আবরণ উন্মোচন করে’ (unveils)। মানুষ যাহা ‘শিক্ষা করে’, প্রকৃতপক্ষে সে উহা ‘আবিষ্কার করে’। ‘Discover’ শব্দটির অর্থ—অনন্ত জ্ঞানের খনিস্বরূপ নিজ আত্মা হইতে আবরণ সরাইয়া লওয়া। আমরা বলি, নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করিয়াছিলেন। উহা কি এক কোণে বসিয়া তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল? না, উহা তাঁহার নিজ মনেই অবস্থিত ছিল। সময় আসিল, অমনি তিনি উহা দেখিতে পাইলেন। মানুষ যতপ্রকার জ্ঞানলাভ করিয়াছে, সবই মন হইতে। জগতের অনন্ত পুস্তকাগার তোমারই মনে। বহির্জগৎ কেবল তোমার নিজ মনকে অধ্যয়ন করিবার উত্তেজক কারণ—উপলক্ষ্য মাত্র, তোমার নিজ মনই সর্বদা তোমার অধ্যয়নের বিষয়। আপেলের পতন নিউটনের কাছে উদ্দীপক কারণ-স্বরূপ হইল, তখন তিনি নিজের মন অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। তিনি তাঁহার মনের ভিতর পূর্ব হইতে অবস্থিত ভাবপরম্পরা আর একভাবে সাজাইয়া উহাদের ভিতর একটি নূতন শৃঙ্খলা আবিষ্কার করিলেন; উহাকেই আমরা মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম বলি। উহা আপেল বা পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত কোন পদার্থে ছিল না। অতএব লৌকিক বা পারমার্থিক সমুদয় জ্ঞানই মানুষের মনে। অনেক স্থলেই উহারা আবিষ্কৃত (বা অনাবৃত) হয় না, বরং আবৃত থাকে; যখন এই আবরণ ধীরে ধীরে সরাইয়া লওয়া হয়, তখন আমরা বলি ‘আমরা শিক্ষা করিতেছি’, এবং এই আবরণ অপসারণের কাজ যতই অগ্রসর হয়, জ্ঞানও ততই অগ্রসর হইতে থাকে। এই আবরণ যাঁহার ক্রমশঃ উঠিয়া যাইতেছে, তিনি অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী; যাহার আবরণ খুব বেশী, সে অজ্ঞান; আর যাঁহার ভিতর হইতে অজ্ঞান একেবারে চলিয়া গিয়াছে, তিনি সর্বজ্ঞ। পূর্বে অনেক সর্বজ্ঞ পুরুষ ছিলেন; আমার বিশ্বাস একালেও অনেক হইবেন, আর আগামী কল্পনা সমূহে অসংখ্য সর্বজ্ঞ পুরুষ জন্মাইবেন। চকমকি পাথরে যেমন অগ্নি নিহিত থাকে, মনের মধ্যেই সেইরূপ জ্ঞান রহিয়াছে; উদ্দীপক কারণটি যেন ঘর্ষণ—জ্ঞানাগ্নিকে প্রকাশ করিয়া দেয়। আমাদের সকল ভাব ও কার্য সম্বন্ধেও সেইরূপ; যদি আমরা ধীরভাবে নিজেদের অন্তঃকরণ অধ্যয়ন করি, তবে দেখিব, আমাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আশীর্বাদ-অভিসম্পাত, নিন্দা-সুখ্যাতি—সবই আমাদের মনের উপর বহির্জগতের বিভিন্ন আঘাতের দ্বারা আমাদের ভিতর হইতেই উৎপন্ন। উহাদের ফলেই আমাদের বর্তমান চরিত্র গঠন, এই আঘাত-সমষ্টিকেই বলে কর্ম। আত্মার অভ্যন্তরস্থ অগ্নিকে বাহির করিবার জন্য, উহার নিজ শক্তি ও জ্ঞান প্রকাশের জন্য যে কোন মানসিক বা দৈহিক আঘাত প্রদত্ত হয়, তাহাই কর্ম; ‘কর্ম’ অবশ্য এখানে উহার ব্যাপকতম অর্থে ব্যবহৃত। অতএব আমরা সর্বদাই কর্ম করিতেছি। আমি কথা বলিতেছি—ইহা কর্ম। তোমরা শুনিতেছে—তাহাও কর্ম। আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলিতেছি—ইহা কর্ম, বেড়াইতেছি—কর্ম, কথা কহিতেছি—কর্ম, শারীরিক বা মানসিক যাহা কিছু আমরা করি, সবই কর্ম। কর্ম আমাদের উপর উহার ছাপ রাখিয়া যাইতেছে।

মানুষকে যতপ্রকার শক্তি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে হয়, তন্মধ্যে যে কর্মের দ্বারা তাহার চরিত্র গঠিত হয়, তাহাই সর্বাপেক্ষা প্রবল শক্তি। মানুষ যেন একটি কেন্দ্র, জগতের সমুদয় শক্তি সে নিজের দিকে আকর্ষণ করিয়া লইতেছে, ঐ কেন্দ্রেই উহাদিগকে দ্রবীভূত করিয়া একাকার করিতেছে, তাহার পর একটি বৃহৎ তরঙ্গকারে বাহিরে প্রেরণ করিতেছে। এরূপ একটি কেন্দ্রই প্রকৃত মানুষ, তিনি সর্বশক্তিমান্, সর্বজ্ঞ; আর তিনি তাঁহার নিজের দিকে সমগ্র জগৎ আকর্ষণ করিতেছেন। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ—সবই তাঁহার দিকে চলিয়াছে এবং তাঁহার চতুর্দিকে সংলগ্ন হইতেছে। তিনি ঐগুলির মধ্য হইতে ‘চরিত্র’-নামক মহাশক্তি গঠন করিয়া লইয়া উহাকে বহির্দেশে প্রক্ষেপ করিতেছেন। তাঁহার যেমন ভিতরে গ্রহণ করিবার শক্তি আছে, সেইরূপ বাহিরে প্রক্ষেপ করিবার শক্তিও আছে।

আমরা জগতে যতপ্রকার কার্য দেখিতে পাই, মনুষ্য-সমাজে যতপ্রকার আলোড়ন হইতেছে, আমাদের চতুর্দিকে যে-সকল কার্য হইতেছে, সবই চিন্তার প্রকাশমাত্র, মানুষের ইচ্ছার প্রকাশমাত্র। ছোট বড় যন্ত্র, নগর, জাহাজ, রণতরী—সবই মানুষের ইচ্ছার বিকাশমাত্র। এই ইচ্ছা চরিত্র হইতে উদ্ভূত, চরিত্র আবার কর্মদ্বারা নির্মিত। ইচ্ছার প্রকাশ কর্মের অনুরূপ। প্রবল-ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন যে-সকল মানব জগতে জন্মিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই প্রচণ্ড কর্মী ছিলেন। তাঁহাদের এত ইচ্ছাশক্তি ছিল যে, তাঁহারা জগৎকে ওলট-পালট করিয়া দিতে পারিতেন। ঐ শক্তি তাঁহারা যুগযুগব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন কর্মদ্বারা লাভ করিয়াছিলেন। বুদ্ধ বা যীশুর মত প্রবল ইচ্ছাশক্তি একজন্মে লাভ করা যায় না, আর উহাকে পুরুষানুক্রমিক শক্তি-সঞ্চারও (hereditary transmission) বলা যায় না; কারণ আমরা জানি তাঁহাদের পিতারা কিরূপ ছিলেন। তাঁহারা যে জগতের হিতের জন্য কখনও কিছু বলিয়াছিলেন, তাহা জানা নেই। যোসেফের ন্যায় লক্ষ লক্ষ সূত্রধর জীবন-লীলা সংবরণ করিয়াছে; লক্ষ লক্ষ এখনও জীবিত আছে। বুদ্ধের পিতার ন্যায় লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র রাজা জগতে ছিলেন। যদি ইহা কেবল পুরুষানুক্রমিক শক্তি-সঞ্চারের উদাহরণ হয়, তবে এই ক্ষুদ্র সামান্য রাজা—যাঁহাকে হয়তো তাঁহার ভৃত্যেরা পর্যন্ত মানিত না, তিনি কিরূপে এমন এক সন্তানের জনক হইলেন, যাঁহাকে জগতের অনেক লোক উপাসনা করিতেছে? সূত্রধর ও তাঁহার সন্তান—যাঁহাকে লক্ষ লক্ষ লোক ঈশ্বর বলিয়া উপাসনা করিতেছে—এ দুয়ের মধ্যে যে প্রভেদ, তাহাই বা কিরূপে ব্যাখ্যা করিবে? বংশানুক্রমিক মতবাদ দ্বারা উহার ব্যাখ্যা হয় না। বুদ্ধ ও যীশু জগতে যে মহাশক্তি সঞ্চার করিয়াছিলেন, তাহা কোথা হইতে আসিল? এই শক্তিসমষ্টি কোথা হইতে আসিল? অবশ্য উহা যুগযুগান্তর হইতে ঐ স্থানেই ছিল এবং ক্রমশঃ প্রবল হইতে প্রবলতর হইতেছিল। অবশেষে উহা বুদ্ধ বা যীশু নামে প্রবল শক্তির আকারে সমাজে আবির্ভূত হইল। এখনও ঐ শক্তি-তরঙ্গ প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে।

এই সবই কর্মদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উপার্জন না করিলে কেহ কিছু পাইতে পারে না। ইহাই সনাতন নিয়ম। আমরা কখনও কখনও মনে করিতে পারি, ব্যাপারটা ঠিক এরূপ নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদিগকে পূর্বোক্ত নিয়মে দৃঢ়বিশ্বাসী হইতে হয়। কোন ব্যক্তি সারা জীবন ধনী হইবার চেষ্টা করিতে পারে, এ জন্য সহস্র সহস্র ব্যক্তিকে ঠকাইতে পারে, কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারে, সে ধনী হওয়ার যোগ্য নয়। তখন তাহার নিকট জীবন কষ্টকর ও জঘন্য বলিয়া মনে হয়। আমরা আমাদের শারীরিক ভোগের জন্য অনেক কিছু সংগ্রহ করিতে পারি, কিন্তু আমরা নিজ কর্মের দ্বারা যাহা উপার্জন করি, তাহাতেই আমাদের প্রকৃত অধিকার। একজন নির্বোধ জগতের সকল পুস্তক ক্রয় করিতে পারে, কিন্তু সেগুলি তাহার পুস্তকাগারে পড়িয়া থাকিবে মাত্র, সে যেগুলি পড়িবার উপযুক্ত, শুধু সেগুলিই পড়িতে পারিবে, এবং এই যোগ্যতা কর্ম হইতে উৎপন্ন। আমরা কিসের অধিকারী বা আমরা কি আয়ত্ত করিতে পারি, আমাদের কর্মই তাহা নিরূপণ করে। আমাদের বর্তমান অবস্থার জন্য আমরাই দায়ী, এবং আমরা যাহা হইতে ইচ্ছা করি, তাহা হইবার শক্তিও আমাদের আছে। আমাদের বর্তমান অবস্থা যদি আমাদের পূর্ব কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে ইহাই নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হইবে যে, ভবিষ্যতে আমরা যাহা হইতে ইচ্ছা করি, আমাদের বর্তমান কর্ম দ্বারাই তাহা হইতে পারি। অতএব আমাদের জানা উচিত কিরূপে কর্ম করিতে হইবে। তোমরা বলিবে, ‘কর্ম কি করিয়া করিতে হয়, তাহা আবার শিখিবার প্রয়োজন কি? সকলেই তো কোন-না-কোন ভাবে এই জগতে কাজ করিতেছে।’ কিন্তু ‘শক্তির অনর্থক ক্ষয়’ বলিয়া একটি কথা আছে। গীতায় এই কর্মযোগ সম্বন্ধে কথিত আছে, ‘কর্মযোগের অর্থ কর্মের কৌশল—বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে কর্মানুষ্ঠান।’ কর্ম কি করিয়া করিতে হয়—জানিলে তবেই কর্ম হইতে সর্বাপেক্ষা ভাল ফল পাওয়া যায়। তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত, সকল কর্মের উদ্দেশ্য—মনের ভিতরে পূর্ব হইতে যে শক্তি রহিয়াছে তাহা প্রকাশ করা, আত্মাকে জাগাইয়া তোলা। প্রত্যেক মানুষের ভিতরে এই শক্তি আছে এবং জ্ঞানও আছে। এই-সকল বিভিন্ন কর্ম যেন ঐ শক্তি ও জ্ঞানকে বাহিরে প্রকাশ করিবার, ঐ মহাশক্তিগুলিকে জাগ্রত করিবার আঘাতস্বরূপ।

মানুষ নানা উদ্দেশ্যে কর্ম করিয়া থাকে। কোন উদ্দেশ্য ব্যতীত কার্য হইতে পারে না। কোন কোন লোক যশ চায়, তাহারা যশের জন্য কার্য করে। কেহ কেহ অর্থ চায়, তাহারা অর্থের জন্য কার্য করে। কেহ প্রভুত্ব চায়, তাহারা প্রভুত্বলাভের জন্য কার্য করে। অনেকে স্বর্গে যাইতে চায়, তাহারা স্বর্গে যাইবার জন্য কার্য করে। অপরে আবার মৃত্যুর পর নিজেদের নাম রাখিয়া যাইতে চায়। চীনদেশের রীতি—না মরিলে কাহাকেও কোন উপাধি দেওয়া হয় না। বিচার করিয়া দেখিলে ইহা অপেক্ষাকৃত ভাল প্রথা বলিতে হইবে। চীনে কোন লোক খুব ভাল কাজ করিলে তাহার মৃত পিতা বা পিতামহকে কোন সম্মানজনক উপাধি প্রদান করা হয়। কেহ কেহ এই উদ্দেশ্যে কাজ করিয়া থাকে। কোন কোন মুসলমান-সম্প্রদায়ের অনুগামিগণ মৃত্যুর পর একটি প্রকাণ্ড সমাধি-মন্দিরে সমাহিত হওয়ার জন্য সমস্ত জীবন কার্য করিয়া থাকে। আমি এমন কয়েকটি সম্প্রদায়ের কথা জানি, যাহাদের মধ্যে শিশু জন্মিবামাত্র তাহার জন্য সমাধি-মন্দির নির্মিত হইতে থাকে; ইহাই তাহাদের বিবেচনায় মানুষের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় কর্ম এবং ঐ সমাধি-মন্দির যত বৃহৎ ও সুন্দর হয়, সেই ব্যক্তি ততই ধনী বলিয়া বিবেচিত হয়। কেহ কেহ আবার প্রায়শ্চিত্তরূপে কর্ম করিয়া থাকে; সর্ববিধ অসৎ কার্য করিয়া শেষে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করিল অথবা পুরোহিতগণকে কিনিয়া লইবার জন্য এবং তাঁহাদের নিকট হইতে স্বর্গে যাইবার ছাড়পত্র পাইবার জন্য কিছু অর্থ তাঁহাদিগকে দিল। তাহারা মনে করে, এরূপ দানের দ্বারা তাহাদের পথ পরিষ্কার হইল, পাপ সত্ত্বেও তাহারা শাস্তি এড়াইয়া যাইবে। মানুষের কার্য-প্রবৃত্তির বহু উদ্দেশ্যের কয়েকটি মাত্র বলা হইল।

কর্মের জন্যই কর্ম কর। সকল দেশেই এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁহাদের প্রভাব সত্যই জগতের পক্ষে কল্যাণকর; তাঁহারা কর্মের জন্যই কর্ম করেন, নাম-যশ গ্রাহ্য করেন না, স্বর্গে যাইতেও চাহেন না। লোকের প্রকৃত উপকার হইবে বলিয়াই তাঁহারা কর্ম করেন। আবার অনেকে আছেন, যাঁহারা আরও উচ্চতর উদ্দেশ্য লইয়া দরিদ্রের উপকার ও মনুষ্য-জাতিকে সাহায্য করেন; কারণ তাঁহারা সৎ কার্যে বিশ্বাসী, তাঁহারা সদ্‌ভাব ভালবাসেন। নাম-যশের উদ্দেশ্যে কৃত কর্মের ফল কখনও সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না; সচরাচর দেখা যায়, যখন আমরা বৃদ্ধ হই এবং আমাদের জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, তখন আমাদের নাম-যশ হয়। কিন্তু যদি কেহ কোন স্বার্থপূর্ণ উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ করে, সে কি কিছুই লাভ করে না? হাঁ, সে সর্বাপেক্ষা বেশী লাভ করে। নিঃস্বার্থ কর্মেই অধিক লাভ, তবে ইহা অভ্যাস করিবার সহিষ্ণুতা মানুষের নাই। সাংসারিক হিসাবেও ইহা বেশী লাভজনক। প্রেম, সত্য, নিঃস্বার্থপরতা—এগুলি শুধু নীতি-সম্বন্ধীয় আলঙ্কারিক বর্ণনা নয়, এগুলি আমাদের সর্বোচ্চ আদর্শ; কারণ এগুলির মধ্যেই মহতী শক্তি নিহিত রহিয়াছে। প্রথমতঃ যে-ব্যক্তি পাঁচ দিন অথবা পাঁচ মিনিট কোন স্বার্থাভিসন্ধি ব্যতীত ভবিষ্যতের কোন চিন্তা—স্বর্গলাভের আকাঙ্ক্ষা, শাস্তির ভয় অথবা ঐরূপ কোন বিষয় চিন্তা না করিয়া কাজ করিতে পারেন, তাঁহার মধ্যে শক্তিমান্ মহাপুরুষ হইবার সামর্থ্য আছে। এই ভাব কার্যে পরিণত করা কঠিন, কিন্তু আমাদের অন্তরের অন্তস্তলে আমরা উহার মূল্য জানি, জানি উহা কত শুভফলপ্রসূ। এই কঠোর সংযমই শক্তির মহোচ্চ বিকাশ। সমুদয় বহির্মুখ কার্য অপেক্ষা আত্মসংযমেই অধিকতর শক্তির প্রকাশ। চতুরশ্ববাহিত একটি শকট কোন বাধা না পাইয়া পাহাড়ের ঢালু পথে গড়াইয়া যাইতেছে, অথবা শকটচালক অশ্বগণকে সংযত করিতেছে—ইহাদের মধ্যে কোন্‌টি অধিকতর শক্তির বিকাশ? অশ্বগণকে ছাড়িয়া দেওয়া বা উহাদিগকে সংযত করা? একটি কামানের গোলা বায়ুর মধ্য দিয়া উড়িয়া অনেক দূরে গিয়া পড়ে, অন্য একটি গোলা দেওয়ালে লাগিয়া বেশী দূরে যাইতে পারে না, কিন্তু এই সংঘর্ষে প্রবল তাপ উৎপন্ন হয়। এইরূপে মনের সমুদয় বহির্মুখ শক্তি স্বার্থের উদ্দেশ্যে ধাবিত হইয়া বিক্ষিপ্ত হয়, ঐগুলি আর তোমার নিকট ফিরিয়া আসিয়া তোমার শক্তি-বিকাশে সাহায্য করে না, কিন্তু ঐগুলিকে সংযত করিলে তোমার শক্তি বর্ধিত হইবে। এই সংযম হইতে মহতী ইচ্ছা-শক্তি উদ্ভূত হইবে; উহা খ্রীষ্ট বা বুদ্ধের মত চরিত্র সৃষ্টি করিবে। অজ্ঞ ব্যক্তিরা এই রহস্য জানে না, তথাপি তাহারা জগতের উপর প্রভুত্ব করিতে চায়। নির্বোধ ব্যক্তি জানে না যে, সে যদি কাজ করে এবং কিছুদিন অপেক্ষা করে, তবে সমুদয় জগৎ শাসন করিতে পারে। সে কয়েক বৎসর অপেক্ষা করুক, এবং এই অজ্ঞানসুলভ জগৎশাসনের ভাবকে সংযত করুক। ঐ ভাব সম্পূর্ণ চলিয়া গেলেই সে জগৎ শাসন করিতে পারিবে। অনেক পশু যেমন কয়েক পদ অগ্রে কি আছে, তাহার কিছুই জানিতে পারে না, আমাদের মধ্যে অনেকেই অল্প কয়েক বৎসর পরে কি ঘটিবে, তাহার কিছুই অনুমান করিতে পারে না। আমরা যেন একটি সঙ্কীর্ণ বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ—ইহাই আমাদের সমুদয় জগৎ। উহার বাহিরে আর কিছু দেখিবার ধৈর্য আমাদের নাই, এইভাবেই আমরা অসাধু ও দুর্বৃত্ত হইয়া পড়ি। ইহাই আমাদের দুর্বলতা—শক্তিহীনতা।

কিন্তু অতি সামান্য কর্মকেও ঘৃণা করা উচিত নয়। যে-ব্যক্তি উচ্চতর উদ্দেশ্যে কাজ করিতে জানে না, সে স্বার্থপর উদ্দেশ্যেই—নাম-যশের জন্যই কাজ করুক। প্রত্যেককে—সর্বদাই উচ্চ হইতে উচ্চতর উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হইতে হইবে, এবং ঐগুলি কি—তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিতে হইবে। ‘কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়’—ফল যাহা হইবার হউক। ফলের জন্য চিন্তা কর কেন? কোন লোককে সাহায্য করিবার সময় তোমার প্রতি সেই ব্যক্তির মনোভাব কিরূপ হইবে, সে বিষয়ে চিন্তা করিও না। তুমি যদি কোন মহৎ বা শুভ কার্য করিতে চাও, তবে ফলাফলের চিন্তা করিয়া উদ্বিগ্ন হইও না।


কর্মের বাপ্তি

হিন্দুশাস্ত্রমতে মানব-সাধারণের ধর্ম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিশেষ বিশেষ কর্তব্য আছে। হিন্দুকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছাত্ররূপে জীবন ...