সন্ধ্যার পর ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। মণিও ভক্তদের সহিত মেঝেতে বসিয়া আছেন। যোগের বিষয় — ষট্চক্রের বিষয় — কথা কহিতেছেন। শিব সংহিতায় সেই সকল কথা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার ভিতর সব পদ্ম আছে — চিন্ময়। যেমন মোমের গাছ, — ডাল, পালা, ফল, — সব মোমের। মূলাধার পদ্মে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি আছেন। চর্তুদল পদ্ম। যিনি আদ্যাশক্তি তিনিই সকলের দেহে কুলকুণ্ডলিনীরূপে আছেন। যেন ঘুমন্ত সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে! “প্রসুপ্ত-ভুজগাকারা আধারপদ্মবাসিনী!”
(মণির প্রতি) — ভক্তিযোগে কুলকুণ্ডলিনী শীঘ্র জাগ্রত হয়। কিন্তু ইনি জাগ্রত না হলে ভগবানদর্শন
হয় না। গান করে করে একাগ্রতার সহিত গাইবে — নির্জনে গোপনে —
‘জাগো মা কুলকুণ্ডলিনী! তুমি নিত্যানন্দ স্বরূপিণী,
প্রসুপ্ত-ভুজগাকারা আধারপদ্মবাসিনী।’
“গানে রামপ্রসাদ সিদ্ধ। ব্যাকুল হয়ে গান গাইলে ঈশ্বরদর্শন হয়!”
মণি — আজ্ঞা, এ-সব একবার করলে মনের খেদ মিটে যায়!
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা! খেদ মেটেই বটে।
“যোগের বিষয় গোটাকতক মোটামুটি তোমায় বলে দিতে হবে।”
[গুরুই সব করেন — সাধনা ও সিদ্ধি — নরেন্দ্র স্বতঃসিদ্ধ ]
“কি জান, ডিমের ভিতর ছানা বড় না হলে পাখি ঠোকরায় না। সময় হলেই পাখি ডিম ফুটোয়।
“তবে একটু সাধনা করা দরকার। গুরুই সব করেন, — তবে শেষটা একটু সাধনা করিয়ে লন। বড় গাছ কাটবার সময় প্রায় সবটা কাটা হলে পর একটু সরে দাঁড়াতে হয়। তারপর গাছটা মড়মড় করে আপনিই ভেঙে পড়ে।
“যখন খাল কেটে জল আনে, আর-একটু কাটলেই নদীর সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে, তখন যে কাটে সে সরে দাঁড়ায়, তখন মাটিটা ভিজে আপনিই পড়ে যায়, আর নদীর জল হুড়হুড় করে খালে আসে।
“অহংকার, উপাধি — এ-সব ত্যাগ হলেই ঈশ্বরকে দর্শন করা যায়। ‘আমি পণ্ডিত’, ‘আমি অমুকের ছেলে’, ‘আমি ধনী’, ‘আমি মানী’ — এ-সব উপাধি ত্যাগ হলেই দর্শন।
“ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য, সংসার অনিত্য — এর নাম বিবেক। বিবেক না হলে উপদেশ গ্রাহ্য হয় না।
“সাধনা করতে করতে তাঁর কৃপায় সিদ্ধ হয়। একটু খাটা চাই। তারপরই দর্শন ও আনন্দলাভ।
“অমুক জায়গায় সোনার কলসী পোতা আছে শুনে লোক ছুটে যায়। আর খুঁড়তে আরম্ভ করে। খুঁড়তে খুঁড়তে মাথায় ঘাম পড়ে। অনেক খোঁড়ার পর এক জায়গায় কোদালে ঠন্ করে শব্দ হল; কোদাল ফেলে দেখে, কলসী বেরিয়েছে কি না। কলসী দেখে নাচতে থাকে।
“কলসী বার করে মোহর ঢেলে, হাতে করে গণে — আর খুব আনন্দ! দর্শন, — স্পর্শন, — সম্ভোগ! — কেমন?”
মণি — আজ্ঞা, হাঁ।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন —
[আমার আপনার লোক কে? একাদশী করার উপদেশ ]
“আমার যারা আপনার লোক, তাদের বকলেও আবার আসবে।
“আহা, নরেন্দ্রের কি স্বভাব। মা-কালীকে আগে যা ইচ্ছা তাই বলত; আমি বিরক্ত হয়ে একদিন বলেছিলাম, ‘শ্যালা, তুই আর এখানে আসিস না।’ তখন সে আস্তে আস্তে গিয়ে তামাক সাজে। যে আপনার লোক, তাকে তিরস্কার করলেও রাগ করবে না। কি বল?”
মণি — আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নরেন্দ্র স্বতঃসিদ্ধ, নিরাকারে নিষ্ঠা।
মণি (সহাস্যে) — যখন আসে একটা কাণ্ড সঙ্গে করে আনে।
ঠাকুর আনন্দে হাসিতেছেন, বলিতেছেন, “একটা কাণ্ডই বটে”।
পরদিন মঙ্গলবার, ২৫শে ডিসেম্বর, কৃষ্ণপক্ষের একাদশী। বেলা প্রায় এগারটা হইবে। ঠাকুরের এখনও সেবা হয় নাই। মণি রাখালাদি ভক্তেরা ঠাকুরের ঘরে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — একাদশী করা ভাল। ওতে মন বড় পবিত্র হয়, আর ঈশ্বরেতে ভক্তি হয়। কেমন?
মণি — আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — খই-দুধ খাবে, — কেমন?
শ্রীরামকৃষ্ণ আজ রামচন্দ্রের নূতন বাগান দেখিতে যাইতেছেন। ২৬শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, (বুধবার, ১২ই পৌষ, কৃষ্ণা দ্বাদশী)।
রাম ঠাকুরকে সাক্ষাৎ অবতারজ্ঞানে পূজা করেন। দক্ষিণেশ্বরে প্রায় মাঝে মাঝে আসেন ও ঠাকুরকে দর্শন ও পূজা করিয়া যান। সুরেন্দ্রের বাগানের কাছে নূতন বাগান করিয়াছেন। তাই শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিতে যাইতেছেন।
গাড়িতে মণিলাল মল্লিক, মাস্টার ও আরও দু-একটি ভক্ত আছেন। মণিলাল মল্লিক ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। ব্রাহ্মভক্তেরা অবতার মানেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিলালের প্রতি) — তাঁকে ধ্যান করতে হলে, প্রথমে উপাধিশূন্য তাঁকে ধ্যান করবার চেষ্টা করা উচিত। তিনি নিরুপাধি, বাক্যমনের অতীত। কিন্তু এ ধ্যানে সিদ্ধ হওয়া বড় কঠিন।
“তিনি মানুষে অবতীর্ণ হন, তখন ধ্যানের খুব সুবিধা। মানুষের ভিতর নারায়ণ। দেহটি আবরণ, যেন লণ্ঠনের ভিতর আলো জ্বলছে। অথবা সার্সীর ভিতর বহুমূল্য জিনিস দেখছি।”
গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া বাগানে পৌঁছিয়া রাম ও ভক্তগণের সঙ্গে প্রথমে তুলসী-কানন দর্শন করিতে ঠাকুর যাইতেছেন।
তুলসী-কানন দেখিয়া ঠাকুর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বলিতেছেন, “বাঃ! বেশ জায়গা, এখানে বেশ ঈশ্বরচিন্তা হয়।”
ঠাকুর এইবার সরোবরের দক্ষিণের ঘরে আসিয়া বসিলেন। রামচন্দ্র থালায় করিয়া বেদানা, কমলালেবু ও কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন কাছে দিলেন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আনন্দ করিতে করিতে ফলাদি খাইতেছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে সমস্ত বাগান পরিক্রমা করিতেছেন।
এইবার নিকটবর্তী সুরেন্দ্রের বাগানে যাইতেছেন। পদব্রজে খানিকটা গিয়া গাড়িতে উঠিবেন। গাড়ি করিয়া সুরেন্দ্রের বাগানে যাইবেন।
পদব্রজে যখন ভক্তসঙ্গে যাইতেছেন, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিলেন যে পার্শ্বের বাগানে গাছতলায় একটি সাধু একাকী খাটিয়ায় বসিয়া আছেন। দেখিয়াই তিনি সাধুর কাছে উপস্থিত হইয়া আনন্দে তাঁহার সহিত হিন্দীতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সাধুর প্রতি) — আপনি কোন্ সম্প্রদায়ের — গিরি বা পুরী কোন উপাধি আছে?
সাধু — লোকে আমায় পরমহংস বলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বেশ, বেশ। শিবোঽহম্ — এ বেশ। তবে একটি কথা আছে। এই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় রাতদিন হচ্ছে — তাঁর শক্তিতে। এই আদ্যাশক্তি আর ব্রহ্ম অভেদ। ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তি হয় না। যেমন জলকে ছেড়ে তরঙ্গ হয় না। বাদ্যকে ছেড়ে বাজনা হয় না।
“যতক্ষণ তিনি এই লীলার মধ্যে রেখেছেন, ততক্ষণ দুটো বলে বোধ হয়। শক্তি বললেই ব্রহ্ম আছেন। যেমন রাতবোধ থাকলেই দিনবোধ আছে। জ্ঞানবোধ থাকলেই অজ্ঞানবোধ আছে।
“আর-একটি অবস্থায় তিনি দেখান যে ব্রহ্ম জ্ঞান-অজ্ঞানের পার — মুখে কিছু বলা যায় না। যো হ্যায় সো হ্যায়।”
এরূপ কিছু সদালাপ হইবার পর শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়ির দিকে যাইতেছেন। সাধুটিও সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গাড়িতে তুলিয়া দিতে আসিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন অনেকদিনের পরিচিত বন্ধু, সাধুর বাহুর ভিতর বাহু দিয়া গাড়ির অভিমুখে যাইতেছেন।
সাধু তাঁহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া নিজস্থানে চলিয়া আসিলেন।
এইবার সুরেন্দ্রের বাগানে শ্রীরামকৃষ্ণ আসিয়াছেন। ভক্তসঙ্গে আসন গ্রহণ করিয়া প্রথমেই সাধুর কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধুটি বেশ। (রামের প্রতি) — তুমি যখন যাবে সাধুটিকে দক্ষিণেশ্বরের বাগানে লয়ে যেও।
“সাধুটি বেশ। একটা গানে আছে — সহজ না হলে সহজকে চেনা যায় না।
“নিরাকারবাদী — তা বেশ। তিনি নিরাকার-সাকার হয়ে আছেন, আরও কত কি! যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা। সেই বাক্যমনের অতীত যিনি, তিনি নানা রূপ ধরে অবতীর্ণ হয়ে কাজ করছেন। সেই ওঁ হইতে ‘ওঁ শিব’, ‘ওঁ কালী’, ‘ওঁ কৃষ্ণ’ হয়েছেন। নিমন্ত্রণে কর্তা একটি ছোট ছেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন — তার কত আদর, কেন না সে অমুকের দৌহিত্র কি পৌত্র।”
সুরেন্দ্রের বাগানেও কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে ভক্তসঙ্গে যাইতেছেন।